অবশেষে দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা বহুমুখী প্রকল্পের মূল সেতু এবং নদীশাসনের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার দুপুর ১২টায় লৌহজংয়ের মাওয়া পয়েন্টে কাজের উদ্বোধন করবেন।
মাওয়া ঘাট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদীর ওপরে ৭ নম্বর পিলারে মূল পাইলিং শুরু হবে। এটিই হবে সেতুর প্রথম মূল পাইল ড্রাইভিং। এ লক্ষ্যে এ পয়েন্টে পাইলিং কাজের সরঞ্জামাদি একসঙ্গে স্থাপন করার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে।
পদ্মার দুই পারে এখন উচ্ছ্বাসের জোয়ার, সাজ সাজ রব। একদিকে প্রকল্প এলাকায় চলছে বিশাল নির্মাণযজ্ঞ। অন্যদিকে পদ্মা সেতুর রূপকার বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বরণ করে নেওয়ার ব্যস্ততা। প্রধানমন্ত্রীর আগমনের খবরে এ এলাকার মানুষের মনে বইছে আনন্দের হাওয়া। তাদের প্রাণের দাবি পদ্মা সেতুর মূল কাজের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। তাই প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান ও স্বাগত জানাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এলাকাবাসী।
প্রধানমন্ত্রী প্রথমে জাজিরায় নদীশাসন কাজের উদ্বোধন করবেন। পরে মাওয়ায় পদ্মা সেতুর মূল নির্মাণকাজের ভিত্তিফলক উন্মোচন করবেন তিনি। এরপর লৌহজংয়ের খানবাড়ি মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন।
জনসভা উপলক্ষে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল মঞ্চ। মঞ্চ ঘিরে ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে গোটা এলাকা। সব মিলিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দলীয় নেতা-কর্মীদের যেন দম ফেলার সুযোগ নেই।
দুই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য ২ সহস্রাধিক পুলিশ সদস্য রয়েছে। এ ছাড়া র্যাব, সেনাবাহিনীসহ সাদাপোশাকে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য রয়েছে। সব ভেন্যুতেই থাকবে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুন্সীগঞ্জে আগমন উপলক্ষে মাওয়া থেকে দোগাছি পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকা নান্দনিকভাবে সাজানো হয়েছে। খানবাড়ি এলাকায় ৭ একর জায়গাজুড়ে জনসভা হবে। ঢাকা-মাওয়া সড়কে তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। লাগানো হয়েছে ছোট-বড় ব্যানার ও ফেস্টুন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের বিভিন্ন দফতর কাজ করে যাচ্ছে।
লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহম্মদ খলিকুজ্জামান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে আমাদের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। দুই সহস্রাধিক পুলিশ সদস্য এখানে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে এএসপি (সার্কেল) সামসুজ্জামান বাবু বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুন্সীগঞ্জে আগমন উপলক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি এবং নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে জেলার পুলিশ প্রশাসন। কয়েক স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পুরো এলাকায় ফোর্স নিয়োগ করা হয়েছে। কয়েকটি ভেন্যু আছে। সব জায়গায় ১৫-২০ দিন আগে থেকেই ফোর্স নিয়োজিত রয়েছে। যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।’
তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুপুর ১২টায় লৌহজংয়ের মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা বহুমুখী সেতুর মূল সেতুর এবং নদীশাসন কাজের উদ্বোধন করবেন। আধা ঘণ্টার এই অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী দোগাছি সার্ভিস এরিয়া-১ এ নামাজ আদায় ও মধ্যাহ্নভোজ করবেন। পরে দুপুর আড়াইটায় মাওয়া চৌরাস্তা গোলচত্বর সংলগ্ন মেদেনীমন্ডল খানবাড়ি এলাকায় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দেবেন। ভাষণ শেষে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন।
পদ্মার মাওয়া পাড় থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরত্বে নদীর মধ্যে অবস্থিত ৭ নম্বর ব্লক। যেটিকে পুরোপুরি প্রস্তুত করে তোলা হয়েছে মূল পাইলিংয়ের জন্য। ইতিমধ্যে নদীতে নিয়ে আসা হয়েছে ১৩৫ মিটার দৈর্ঘ্যের পাইল। নদীর পাড়ে জড়ো করা হয়েছে অন্য পাইলগুলোও।
৭ নম্বর সংখ্যাটিকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। আর পদ্মা সেতু যেহেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে আসছে। তাই হয়তো এই ৭ নম্বর ব্লককে নির্ধারণ করা হয়েছে আনুষ্ঠানিক মূল পাইলিংয়ের জন্য। আর এ রকম ৬টি পাইলের ওপর নির্মাণ করা হবে এক একটি পিলার। যেটি করতে সময় দরকার হবে ১ মাসেরও বেশি। আর পর্যায়ক্রমে এ রকম আরো ৪১টি পিলারের ওপর নির্মাণ করা হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু।
এর আগে মার্চ মাসে টেস্ট আর আগস্ট মাসে ট্রায়াল পাইল থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা হয়েছে মূল পাইলের নকশা। এক একটি পাইলকে নদীর তলদেশে পাঠানো হবে অত্যাধুনিক সব হ্যামার আর ক্রেন দিয়ে। এ জন্য ব্যবহার করা হবে চারটি আধুনিক ফ্লোটিং ক্রেন। এ ছাড়াও প্রায় ১০০টি ছোট-বড় ক্রেন এবং বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি হাইড্রোলিক হ্যামারও প্রস্তুত। পদ্মার দুই পারের মানুষগুলোর মতোই অপেক্ষার পালা শেষ সংশ্লিষ্টদেরও।
পদ্মা সেতু প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আবদুল কাদের জানান, গত বুধবার থেকেই পাইলিং কাজের সরঞ্জামাদি প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছে। প্রথমে ছয়টি সাপোর্ট পাইল স্থাপন করে প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করা হবে। তারপর পাইল ড্রাইভিংয়ের জন্য পিলারের কাছে ড্রাইভ ক্রেন স্থাপন করা হবে। শেষে পাইল বসিয়ে বিশাল সাইজের হ্যামার দিয়ে ড্রাইভ শুরু হবে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মাধ্যমে এটি শুরু হবে।
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, ৪২টি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ এ সেতু। এ ছাড়া দেড় কিলোমিটার করে উভয় পাড়ে তিন কিলোমিটার সংযোগ সেতুর জন্য আরো ২৪টি পিলার থাকবে। সেতুর ৪২টি পিলারে মোট ২৪০টি এবং দুই পাড়ের ১২টিতে ২৪টি পাইল বসানো হবে। সর্বমোট ২৬৪টি পাইল হবে। পাইলিংয়ের যন্ত্রপাতি সাজানোর কাজ চলছে। পাইল ড্রাইভিংয়ের পরই পদ্মা সেতুর ওপরের অংশের কাজ শুরুর প্রস্তুতি চলছে। এ ছাড়া নদীর দুই পাড়ে কয়েক লাখ ব্লক তৈরি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নদীশাসনের কাজের জন্য। নদীশাসনের কাজও এগিয়ে চলছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, মোট পাঁচটি প্রধান ভাগে হচ্ছে পদ্মা সেতুর কাজ। এখন পর্যন্ত মূল সেতু নির্মাণের ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং নদীশাসনের ১৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া সংযোগ সড়কের মধ্যে শরীয়তপুরের জাজিরায় ৫৯ শতাংশ এবং মাওয়ায় ৬৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রধান শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের মোট কাজের ২৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত গতিতে সেতুর কাজ চলছে। যেভাবে কাজ চলছে তাতে নির্ধারিত সময় ২০১৮ সালের শেষেই এর কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।’
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দ্বিতল এ সেতুর পুরোটা হবে স্টিল আর কংক্রিট স্ট্রাকচারে। সেতুর ওপরের তলায় থাকবে চার লেনের মহাসড়ক আর নিচ দিয়ে যাবে রেললাইন।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ, চীনের চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন, সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোমেন লি. ও মালয়েশিয়ার এইচসিএমের মাধ্যমে মূল সেতু, নদীশাসন ও অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজ বাস্তবায়ন চলছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত সরকারের জন্য ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। শেষ পর্যন্ত সে চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে স্বপ্নের সেতুটি নির্মাণের দিকে সরকার সফলভাবে এগিয়ে যাওয়ায় পদ্মার দুই পারেরর মানুষের মাঝে খুশির জোয়ার বইছে।