সেই দিনগুলোর স্মৃতি এখনো কষ্ট দেয় এরশাদকে। ক্ষমতা ছাড়ার পর নিজের সঙ্গে ‘অন্যায় হয়েছে’ দাবি করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ বলেছেন, এখনও তিনি সেই কষ্ট ভুলতে পারেন না। তিনি বলেন, “আমি ক্ষমতা ছেড়েছিলাম জাস্টিস শাহাবুদ্দিনের কাছে। এই শাহাবুদ্দিন, যার কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না, যে আমার কাছে শপথ নিয়েছিলেন তিনি আমার বিচার করলেন।জেলে দিলেন।কাজটা তিনি ঠিক করেননি। “আমাকে জেলে পাঠানো হল। আমি ছিলাম স্বর্গে… একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে। পড়লাম নরকে। কথা বলার লোক নেই, বই নেই… কিচ্ছু নেই। চুপচাপ বসে থাকতাম।” রোববার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় বলছিলেন এরশাদ। গণ আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতাচ্যুত হন তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদ। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো এই দিনটিকে ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ হিসেবে পালন করলেও জাতীয় পার্টি পালন করে ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে। জাতীয় পার্টি আয়োজিত ওই আলোচনা সভায় এরশাদ বলেন, “আজ আমার হৃদয় আনন্দে ভরপুর। আজকের দিনটি জাতীয় পার্টির জন্য একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ দিন। কারণ এই দিনে এক নব দিগন্তের সূচনা হয়েছিল। এই দিনে আমি সংবিধান সংরক্ষণের জন্য ক্ষমতা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।” তিনি বলেন, “আমি অতীতের কথা ভুলতে চাই। সামনে এগিয়ে যেতে চাই। কিন্তু ভুলতে পারি না। যে অন্যায় অবিচার আমার সঙ্গে, জাতীয় পার্টির সঙ্গে হয়েছে তা ভোলা যায় না।” বিএনপিকে উদ্দেশ করে এরশাদ বলেন, “১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেই আমার বিরুদ্ধে ৪২টি মামলা দিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল আমাকে ধ্বংস করা। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আজ তাদের নিজেদের দশাও আজ সে রকম।” বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের সমালোচনাও করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, “১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি ৩৩টি আসন পেয়েছিল। খালেদা জিয়া রাতের অন্ধকারে আমার কাছে লোক পাঠিয়েছিলেন, যেন আমি তাদের সমর্থন দিই। তিনি বলেছিলেন, আমি যা চাই আমাকে তা-ই দেওয়া হবে। কিন্তু আমি তাদের সমর্থন দিইনি; দিয়েছিলাম আওয়ামী লীগকে।” “সেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই আমাকে ছয় মাসের জন্য জেলে পাঠাল। আমার বিরুদ্ধে দুটি মামলা এখনও চলছে। ১৯৯৫ সালে খালেদা জিয়া মঞ্জুর হত্যা মামলা করেছিলেন। সেই মামলা এখনও শেষ হয় নাই। কোনো দিনও শেষ হবে না। কবরে গেলেও সমন যাবে। অবিচারের শেষ নাই।” বক্তৃতার এই পর্যায়ে সভায় উপস্থিত কর্মীদের মধ্যে হাস্যরস দেখা দিলে এরশাদ তাদের উদ্দেশে বলেন, “আমি আমার দুঃখের কথা বলছি, আর তোমরা হাসছ?” নয় বছরের শাসনামলে কোনো রাজনৈতিক হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলেও দাবি করেন এরশাদ। তিনি বলেন, “বলা হয় আমি দেলোয়ারকে মেরেছি। গাড়ি কি আমি চালাচ্ছিলাম। ওটা ছিল একটা দুর্ঘটনা। পুলিশের গাড়ি ব্রেক ফেল করেছিল। “নূর হোসেন মারা গিয়েছিল। আমি জেল থেকে বের হওয়ার পর তার বাবার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। প্রতি মাসে তার বাবাকে আমি পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছি। তার জন্য জিরো পয়েন্টি মনুমেন্ট করেছি। সেই মনুমেন্টে এখন আপনারা ফুল দেন; শ্রদ্ধা জানান।” “ডা. মিলনকে কারা খুন করেছে? আমি তো করিনি। কে করেছে খুঁজে বের করুন না, বিচার করুন। সেই সাহস আপনাদের আছে?” নিজের দলের কর্মীদের উদ্দেশে এরশাদ বলেন, “দেশে হিংসার রাজনীতি চলছে। একদল ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে, অন্যদল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মানুষ পুড়িয়ে মারছে। সাধারণ মানুষের কথা কেউ ভাবছে না। আমাদের মূল্যবোধ, বিবেক হারিয়ে গেছে। এই দোষ সাধারণ মানুষের নয়, যারা দেশ পরিচালনা করে তাদের। এর পরিবর্তন হতে হবে। এভাবে কোন দেশ, জাতি চলতে পারে না।” “আমি তোমাদের বারবার বলছি, অতীতের গ্লানি-বঞ্চনা ভুলে যাও। জনগণের কাছে যাও। দলকে শক্তিশালী করো, আমার পাশে দাঁড়াও। মনে রেখ, আল্লাহ সুযোগ দিয়েছেন। যদি গ্রহণ করতে না পারি তাহলে আল্লাহর দরবারে কৈফিয়ত দিতে হবে।” অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, জাতীয় পার্টি ঢাকা উত্তরের সভাপতি এস এম ফয়সল চিশতী, ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা প্রমুখ।