হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধিকে স্থায়ী রূপ দিতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য ব্যতীত শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ পেতে পারে না।
তাই স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার সফল বাস্তবায়নে জাতীয় সংসদে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে।
বৃহস্পতিবার একাদশ জাতীয় সংসদের চলতি বছরের প্রথম অধিবেশনে দেয়া ভাষণে তিনি এই আহ্বান জানান। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় রাষ্ট্রপতি প্রবেশ করেন।
এ সময় বিউগলে তার আগমনী বার্তা বেজে ওঠে। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ সকল সংসদ সদস্য দাঁড়িয়ে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। সম্মান প্রদর্শন করেন সংসদ গ্যালারিতে উপস্থিত দেশি-বিদেশি অতিথিরাও।
এরপর জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। পরে রাষ্ট্রপতি স্পিকারের পাশে রাখা আসনে বসেন এবং ভাষণ দেন। টানা সোয়া ১ ঘণ্টা ভাষণের পর রাষ্ট্রপতি অধিবেশন ত্যাগ করেন। এরপর স্পিকার আগামী ১৩ জানুয়ারি বিকাল ৪টা পর্যন্ত সংসদ অধিবেশন মুলতবি করেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘জাতীয় সংসদ দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। এই প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা, আইনের শাসন ও অব্যাহত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণি ও পেশা নির্বিশেষে সবার ঐকমত্য গড়ে তোলার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’
সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ইতিমধ্যে দুর্নীতি, জুয়া, মাদক, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে।
এটি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিতও হয়েছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল দেশের শ্রেণিতে উত্তরণের সব যোগ্যতা অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। তিনি বলেন, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একাদশ জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণের বিপুল সমর্থনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। গত মহাজোট সরকারের ধারাবাহিকতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যআয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
মো. আবদুল হামিদ বলেন, দেশে আইনের শাসন সুসংহত ও সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় কার্যকর করা হয়েছে। পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলা এবং বিডিআর হত্যাকাণ্ড মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এছাড়া হলি আর্টিজান হামলা মামলা, নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রায় দ্রুত ঘোষণা করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথে আমরা হেঁটেছি, সেই পথেই বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে মধ্যআয়ের দেশ হিসেবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব।
আমাদের দৃষ্টি ২০২১ সাল ছাড়িয়ে আরও সামনের দিকে। ২০৪১ সালে বিশ্বসভায় বাংলাদেশ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে- এটাই জাতির প্রত্যাশা।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অজিত গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সমুন্নত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুজ্জ্বল রাখতে দেশ থেকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় বাঙালি জাতিকে আরও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
একাত্তরের শহীদদের কাছে আমাদের অপরিশোধ্য ঋণ রয়েছে। তাই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এবং দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে জাতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার মধ্য দিয়ে লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রপতি তার বক্তৃতায় আরও বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী সুশাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণ এবং সমাজের সকল স্তরে জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যসমূহ অর্জনসহ একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হব।’
তিনি বলেন, ‘উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সার্থক উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের যাত্রাপথে আলোর দিশারী। অনেক বাধা ও ষড়যন্ত্র পেরিয়ে তার বলিষ্ঠ ও প্রত্যয়ী নেতৃত্বে জনকল্যাণমুখী আধুনিক বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বের উন্নয়ন-বিস্ময়। আর্থ-সামাজিক সকল সূচকে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল।’
ভাষণের শুরুতেই রাষ্ট্রপতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করেন। স্মরণ করেন জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানসহ যারা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের।
শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের তিন মহান পুরুষ- শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে।
স্মরণ করেন ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকাণ্ডে নিহতদের। রাষ্ট্রপতি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জনসভায় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে পরিচালিত গ্রেনেড হামলায় শাহাদত বরণকারী সব নেতা-কর্মীকে স্মরণ করেন।
গত বছর জাতীয় জীবনের যে সব বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রয়াত হয়েছেন তাদেরকেও গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন রাষ্ট্রপতি। তাদের মধ্যে রয়েছেন একাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও মাননীয় সংসদ-সদস্য ডা. মো. ইউনুস আলী সরকার, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সদস্য মঈনউদ্দীন খান বাদলসহ রাজনীতিবিদ, প্রাক্তন মন্ত্রী, সাবেক সংসদ-সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, নাট্যকার, অভিনেতা, সঙ্গীত শিল্পী, চিত্রগ্রাহক ও সমাজসেবক।’
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন সুসংহত ও সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এবং যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় কার্যকর করা হয়েছে।
পলাতক আসামিদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলা এবং বিডিআর হত্যাকাণ্ড মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে এবং আদালত কর্তৃক দোষীদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে।
এ ছাড়া হলি আর্টিজান হামলা মামলা, নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রায় দ্রুত প্রদান করা হয়েছে। দুর্নীতি, জুয়া, মাদক, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে এবং জনজীবনে স্বস্তি বিরাজ করছে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ এশিয়ার সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ। পরপর তিনটি অর্থবছরে ৭ শতাংশের বেশি হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৮.১৫ শতাংশে।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ৮.২ শতাংশ। দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। দারিদ্র্যের হার দ্রুত কমে এসেছে।
২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে ২০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অতি দারিদ্র্যের হার কমে হয়েছে ১০.৫ শতাংশে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নসহ সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।