হাওর বার্তা ডেস্কঃ দিনাজপুর থেকে ঢাকায় ভালো চিকিৎসার আশায় এসেছেন মোতালেব মিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে রায়হান তাকে রাজধানীর গ্রিন রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালের চেম্বারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহকে দেখিয়েছেন। বের হয়ে মোতালেব মিয়া খুব উৎফুল্ল হয়ে কথা বলছেন। তার ভাষ্য, ‘ছ্যার আসলেই গরিবের ডাক্তার। যেভাবে দেখলো এইভাবে কেউ দেহে না। তাও তিনশ টাহা নিলো। এখন তো আমাক গেরামেও তিনশ টাহায় কেউ রোগী দেহে না। এখন তো রোগ নিয়া ডাক্তারের কাছে গেলেই কতগুলা টাহা নিয়া নেয়।’ এই চিকিৎসকের চিকিৎসা ফি নিয়ে তিনি বেশ আনন্দিত।
কারণ টাকায় আটমণ চাল পাওয়া যেমন অসম্ভব ঠিক তেমনিভাবে ৩০০ টাকায় রাজধানীতে ভালো চিকিৎসক পাওয়া অনেকটা তেমনই কঠিন বিষয়। ঢাকার চিকিৎসকরা পাঁচশ টাকায় রোগী দেখেন খুব কম। এখন ভালো চিকিৎসক মানে লম্বা সিরিয়াল আর মোটা অঙ্কের টাকা। যার পরিমাণ এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকারও বেশি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর মালিবাগে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেলে জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিওলজির সহযোগী ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার, ধানমন্ডির পপুলারে ঢামেকের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. টিটু মিয়া, হারুন আই কেয়ার হাসপাতালে বারডেমের চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হজরত আলী এবং ধানমন্ডির দ্বীন মোহাম্মাদ চক্ষু হাসপাতালে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. দীপক কুমার নাথ ১৫০০ টাকা করে ফি নেন। এছাড়া মোহাম্মদপুর কেয়ার হাসপাতালে প্রসূতি ও বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. পারভীন ফাতেমার প্রথম ফি ১২০০ এবং দ্বিতীয় ফি ৭০০ টাকা।
ইডেন মাল্টিকেয়ার হাসপাতালের কলোরেক্টাল সার্জন অধ্যাপক ডা. ফজলুল হকের ভিজিট ১২০০ টাকা। আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের ক্যান্সার চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ এহতেশামুল হক নতুন রোগীর ফি ১২০০ এবং এক মাসের মধ্যে পুনরায় গেলে ৮০০ টাকা করে নেন। জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. রাশিদুল হাসান পপুলার হাসপাতালে (ধানমন্ডি) নতুন রোগীর কাছে ১২০০, তিন মাসের মধ্যে গেলে এক হাজার, ৯০ দিন পর ১১০০ ও রিপোর্ট দেখাতে হলে ৪০০ টাকা ভিজিট নেন।
বিষয়টি সম্পর্কে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢামেকের এক বিভাগীয় প্রধান বলেন, বিএসএমএইউর মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ সেন্ট্রাল হাসপাতালে মাত্র ৩০০ ও বিএসএমএমইউয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ৫০০ টাকা করে ভিজিট নেন। অন্যদিকে বিএসএমএমইউয়ের রিউমেটালজির অধ্যাপক সৈয়দ আতিকুল হক একই চেম্বারে (গ্রিন লাইফ) দুই হাজার টাকা ভিজিট নেন। এটা সত্যি কল্পনা করা যায় না।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনমিকস ইউনিটের তৈরি করা ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস ১৯৯৭-২০১৫’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে স্বাস্থ্য খাতে অর্থ ব্যয়ের মাত্র ২৩ ভাগ বহন করে সরকার, বাকি ৬৭ ভাগ ব্যয় করে ব্যক্তি নিজে। এমনকি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মানুষই স্বাস্থ্যের জন্য নিজের পকেট থেকে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। এসব বন্ধ করতে আইন তৈরি ও বাস্তবায়ন জরুরি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স ১৯৮২’ অনুযায়ী বর্তমান বেসরকারি চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু সেখানে চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ফলে বেসরকারি চেম্বারে ইচ্ছামতো অর্থ আদায় করছে একটি চিকিৎসা-বাণিজ্য সিন্ডিকেট। আবার নতুন স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন ২০১৯-এর খসড়ার ১০ অনুচ্ছেদে ফি নির্ধারণে গেজেট বা প্রজ্ঞাপনের কথা থাকলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সেবার নামে চিকিৎসা ব্যাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ‘বেসরকারি চিকিৎসাসেবা আইন- ২০১৬’-এর খসড়া তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। যেখানে রোগীদের মানসম্মত সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যয় কমানোর বিষয়টি গুরুত্বারোপ করা হয়। কিন্তু কাজটা সেখানে থেমে যায়। এরপর সেই খসড়াটি স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন ২০১৯ নামে গত অক্টোবর মাসে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে পাঠানো হয়। কিন্তু এর আলোকে নীতিমালা না থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজধানীর বড় হাসপাতাল থেকে শুরু করে নামকাওয়াস্তের ক্লিনিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও চেম্বারে চিকিৎসকরা লাগাম ছাড়া ফি নিচ্ছেন।
তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে সরেজমিন দেশের একাধিক নামিদামি বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সেখানে অধ্যাপক, সহযোগী-সহকারী অধ্যাপক চিকিৎসকদের ন্যূনতম ভিজিট ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। মোটা অংকের এই ফি আদায়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডক্টর চেম্বার কর্তৃপক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন-২০১৯ এর খসড়ায় বলা আছে, এই আইন পাস হলে সরকারি চাকরিতে কর্মরত কোনো চিকিৎসক অফিস সময়ে বেসরকারি হাসপাতাল বা ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসা দিতে পারবেন না। অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে এক লাখ টাকা এবং বেসরকারি হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে। এমনকি ছুটির দিনে চিকিৎসকদের নিজ নিজ কর্মস্থলের জেলার বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে বা ব্যক্তিগত চেম্বারে টাকার বিনিময়ে সেবা দিতেও সরকারের অনুমতি নিতে হবে।
এছাড়া প্রস্তাবিত খসড়া আইনের ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, রোগীদের চিকিৎসকের ফি সম্পর্কে জানাতে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফি তালিকা চেম্বারের সামনে টাঙানো ও উক্ত ফি-এর রশিদ রোগীকে দিতে বাধ্য থাকবেন। সেবাগ্রহীতা বা তার অভিভাবককে ওই রশিদের অনুলিপি প্রদান করতে হবে। চেম্বারে রোগ পরীক্ষার ন্যূনতম চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকতে হবে। অনুমোদিত ডিগ্রি ছাড়া অন্য কোনো ডিগ্রির বিবরণ সাইনবোর্ড বা নামফলক কিংবা ভিজিটিং কার্ডে উল্লেখ করা যাবে না। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ও ভিজিটিং কার্ডে বিএমডিসির নিবন্ধন নম্বর লেখা থাকতে হবে। মহিলা রোগীর পরীক্ষার জন্য মহিলা নার্স বা সহায়ক থাকতে হবে।
তবে জটিল পরিস্থিতিতে যৌক্তিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এই শর্ত শিথিলযোগ্য। এক্ষেত্রে আইন অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে এক লাখ টাকা জরিমানা। একইসঙ্গে আদালত সংশ্লিষ্ট বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের মালিককে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হবে।
স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি সহিংস কাজ করলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সেবাদানকারী ও প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পত্তির ক্ষতিসাধন, বিনষ্ট করা, ধ্বংসের মতো অপরাধের শাস্তি তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। বেসরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে জরুরি সেবা প্রদানের ব্যবস্থা না থাকলে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম শাস্তি ভোগ করতে হবে। চিকিৎসাকেন্দ্রে যদি রোগীর বসার স্থান না থাকে তা হলে ডাক্তারকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।
সেবাগ্রহীতাকে টাকার রশিদ না দিলে বা সার্ভিস চার্জ মূল্য হাসপাতালে সংরক্ষণ করা না হলে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টাকা জরিমানা ও ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হবে। এই আইনের যেকোনো ধারা লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘনে প্ররোচনা দিলে বা সহযোগিতা করলে দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের দুই লাখ টাকা জরিমানা এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা ও ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
খসড়া অনুসারে, রোগী ও রোগীর স্বজনদের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য দিতে হবে। প্রয়োজনে রোগীকে বিকল্প চিকিৎসা দিতে হবে এবং তা রোগীর স্বজনদের জানাতে হবে। চিকিৎসাকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং অস্ত্রোপচারের জটিলতা রোগীর স্বজনদের জানাতে হবে। চিকিৎসা ব্যয় অর্থাৎ কোন খাতে কত ব্যয় হবে তা রোগীর স্বজনদের জানাতে হবে। চিকিৎসা দেয়ার অনুমতি নিতে হবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সাবেক সভাপতি (স্বাচিপ) ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন আমার সংবাদকে বলেন, আইনজীবীদের তো ফি নির্ধারণ করা যায় না। তারা তাদের মতো করে ফি নির্ধারণ করে। ঠিক তেমনিভাবে চিকিৎসাও তো একটা স্বাধীন পেশা আইনজীবীদের ফি নির্ধারণ করা সম্ভব না হলে চিকিৎসকদের ফি কি নির্ধারণ করা সম্ভব নাকি। তারপরও সরকার চাইলে এখানে উভয়পক্ষের সঙ্গে আলাপচারিতার মাধ্যমে একটি ফি নির্ধারণ করে দিতে পারে। এখন বেশি কিছু বলতে চাই না। কারণ খসড়াটি হাতে পেলে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
খসড়া আইনে চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ও বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব আমার সংবাদকে বলেন, দেশে অনেক আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নাই। স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইনের এই খসড়া ২০১৬ সালে একবার করা হয়েছিলো। কিন্তু সেটা আর আলোর মুখ দেখেনি। এই যে দীর্ঘসূত্রতা এর জন্য কিন্তু সরকার দায় এড়াতে পারে না। আবার চিকিৎসকরা আইন না মানলে সেটাও সরকারের ব্যর্থতা। তবে পৃথিবীর কোথাও সরকার চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ করে দেয় না। ফলে এটা চিকিৎসক সংগঠন ও সরকার সমন্বয় করে করতে পারে।
বিষয়টি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে আইন পাস হতে হয়। এরপর সেই আইনের ওপর ভিত্তি করে প্রজ্ঞাপন বা বিধিমালা তৈরি করা হয়। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইনের খসড়া পূর্ণাঙ্গ করে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে পাঠানো হয়েছে। সেখানে পাস হওয়ার পর আমরা চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণের জন্য বিধিমালা তৈরি করে দেবো।