জাকির হোসাইনঃ বর্ষায় হাওরের শান্ত জলে শান্তশিষ্টের মতোই দাঁড়িয়ে থাকে হিজলগাছ। কখনো একাকী আবার কখনো সারিবদ্ধ থাকে। হেমন্তে হাওরের পানি শুকিয়ে চারদিক যখন বোরো জমিতে পরিণত হয়, তখনো একইভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে হিজল দলবল । এটি ভাটির হাওর অঞ্চলের চিরপরিচিত নৈসর্গিক দৃশ্য। এমন কোনো হাওর, বিল, নেই যেখানে হিজলগাছ নেই। দেশের হাওর অঞ্চলের সাতটি জেলার ৪০টি উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে ‘হিজলগাছের প্রাচীর’ রয়েছে। এ অঞ্চলের আগের কালের হিন্দু বাসিন্দারা বংশপরম্পরায় হিজলগাছ রোপণ করা শিখেছিল আদিপুরুষ কাছ থেকে। গাছটির আদি নিবাস ভারতবর্ষ, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। ‘হিজল’ শব্দটি বাংলা। এর সংস্কৃিত নাম ‘নিচুল’। এ ছাড়া ‘জলন্ত’, ‘নদীক্রান্ত’ এসব নামেও হিজলগাছ পরিচিত। নিসর্গবিদ এক কৃষিবিদ তাঁর বাংলাদেশের ফুল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘হিজল মাঝারি ধরনের ডালপালা ছড়ানো দীর্ঘজীবী গাছ। সাধারণত জলজ কাদা, পানিতে এই গাছ জন্মে। বীজ থেকে গাছ হয়। বাংলাদেশের সর্বত্র খাল, বিল, নদী, ডোবা, হাওর ইত্যাদি জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। হিজল ফুল দেখতে খুবই সুন্দর। হালকা গোলাপি রঙের ১০-১২ সেমি লম্বা পুষ্পদণ্ডের মাঝে অসংখ্য ফুল ঝুলন্ত অবস্থায় ফোটে। গভীর রাতে ফুল ফোটে, সকালে ঝরে যায়। ফুলে একধরনের মিষ্টি মাদকতাময় গন্ধ আছে।’
হিজলগাছের প্রাণশক্তি প্রবল। বন্যার পানি কিংবা তীব্র খরাতেও টিকে থাকে। এমনকি পানির নিচে কয়েক মাস নিমজ্জিত থাকলেও হিজলগাছ বেঁচে থাকে। হাওর অঞ্চলে এ গাছের ডাল মাছের অভয়রাণ্য তৈরিতে ব্যবহূত হয়। কবি জীবনানন্দ দাশ হিজলগাছের সৌন্দর্য নিয়ে একাধিক কবিতা রচনা করেছেন। তিনি বাংলার রূপের সঙ্গে হিজলগাছের ছায়াকে তুলনা করে লিখেছিলেন, ‘এমনই হিজল—বট—তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ’। উপমহাদেশের প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর গানে উল্লেখ করেছেন হিজলের কথা—‘হাওরের পানি নাই রে হেথায়, নাই রে তাজা মাছ,বিলের বুকে ডালা মেলা, নাই রে হিজল গাছ’।