ঢাকা ১২:০৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জামাই সিরাজের সম্পদে হতবাক মুগদা এলাকাবাসী

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:৫০:০০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০১৯
  • ২২৮ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সিরাজুল ইসলাম ওরফে ভাট্টি পরিচিত ‘জামাই সিরাজ’ নামে। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। গত নির্বাচনে কাউন্সিলর হওয়ার পর তার হয়েছে শনৈ শনৈ উন্নতি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক স্থানীয় নেতা ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, একসময়ের ‘লজিং মাস্টার’ সিরাজের উন্নতি দেখে এখন সবাই বিস্মিত। রাজধানীর মুগদা-মাণ্ডা এলাকাতেই তার ছয়টি বাড়ি। এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির জন্য তার আলাদাভাবে লোক নিয়োগ দেওয়া আছে। এ ছাড়া ভর্তি বাণিজ্য, মাদক কারবার ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ এবং এলাকার বাড়িঘর নির্মাণে ঠিকাদারিসহ সবকিছুই তার হাতে। তবে তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাউন্সিলর সিরাজ। গতকাল শুক্রবার তিনি ফোনে দেশ রূপান্তরকে বলেন, সবাই এখন নতুন আওয়ামী লীগ। দল ও জনপ্রতিনিধির নাম ভাঙিয়ে তাদের অপকর্মের দায় তার ওপরও পড়ছে।

স্থানীয়দের ভাষ্য, আশির দশকে বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে সিরাজুল ইসলাম দক্ষিণ মুগদায় একটি মেসবাড়িতে থাকতেন। পরে স্থানীয় কদম আলীর বাড়িতে জায়গির (লজিং) থাকতে শুরু করেন। একপর্যায়ে গৃহকর্তার মেয়ে ফাতেমা বেগমকে বিয়ে করেন। এরপর তাদের আত্মীয় মুগদায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা এনাম

সর্দার ও নজরুল সর্দারের নজরে পড়েন সিরাজ। তাদের হাত ধরেই তিনি আসেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে।

তারা বলছেন, রাজনীতি বাদে কোনো কাজ ছাড়াই ‘জামাই সিরাজ’ এলাকায় ৫-৬টি বাড়ির মালিক হয়েছেন। এর মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া শ্যালক রুবেলের নামে খুলেছেন ‘ফ্যামিলি হাউজিং স্টেট লিমিটেড’ কোম্পানি। কাগজে-কলমে নাম না থাকলেও মূলত এটি তিনিই চালান। সাম্প্রতিক অভিযান শুরুর পর কাউন্সিলর সিরাজ সব টাকা-পয়সা মাটির নিচে লুকিয়ে ফেলেছেন।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় একাধিক নেতা বলেন, আইডিয়াল স্কুলের মুগদা শাখায় ভর্তি বাণিজ্যে জড়িত সিরাজ। আগে সেখানে ছাত্রছাত্রী ভর্তিতে ৩০-৫০ হাজার টাকা করে নিতেন। এখন নিচ্ছেন দুই থেকে তিন লাখ টাকা। এর মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ কামিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া প্রভাব খাটিয়ে তিনি অর্থের বিনিময়ে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে অনেককে চাকরি দিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে মাসিক বেতনের একটি অংশও নিয়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে।

তারা আরও জানিয়েছেন, কাউন্সিলর হওয়ার আগে সিরাজ স্বেচ্ছাসেবক লীগের স্থানীয় কার্যালয়ের জন্য ওয়াসার পাম্পের জায়গা দখল করেন। এখন ওয়াসার কর্মীরা সেখানে কাজ করতে পারছেন না। নিয়মিত আড্ডার পাশাপাশি চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণও হয় সেখান থেকে। ‘লাইনম্যান’ খ্যাত জয়নালকে দিয়ে এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় দোকান বসিয়ে নিয়মিত চাঁদা তোলেন সিরাজ। এ ছাড়া দখল-চাঁদাবাজিতে এলাকায় তার সহযোগীদের মধ্যে আছেন ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা শামীম, ফ্রিডম পার্টির সাবেক কর্মী রাজা ওরফে ফ্রিডম রাজা, যুবলীগের ওয়ার্ড সভাপতি নূরুল ইসলাম। সিরাজের আশীর্বাদে একসময় বাবুর্চি দলের খানসামা নূরুল ইসলাম এখন মুগদায় ছয়টি ফ্ল্যাট ও বাড়ির মালিক। তা ছাড়া বিভিন্ন স্থানে হাট বসিয়ে শ্রমিক লীগের ওয়ার্ড সভাপতি পরিচয়ে এনামুল হক প্রতিদিন চাঁদা তুলে সিরাজ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাগ দিয়ে আসছেন।

মুগদা এলাকায় বাড়ি নির্মাণ করতে এখন বাধ্যতামূলকভাবে সিরাজের লোকদের চাঁদা দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় ব্যাংক কলোনির এক বাসিন্দা জানান, বাড়ির কাজ শুরুর পর রাজা ও রাজিবের নেতৃত্বে মিষ্টি খাওয়ার কথা বলে তার কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করা হয়। তারা ইট-বালু সরবরাহেরও প্রস্তাব দেয়। পরে চাঁদার জন্য হুমকির মুখে তিনি র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করেন।

বেহাল এলাকার রাস্তাঘাট : সরেজমিনে গতকাল দেখা গেছে, মুগদা ও আশপাশের এলাকার সড়কগুলোর বেহাল দশা। বাসাবোর কদমতলা থেকে ওয়াসা রোড পর্যন্ত সড়কে একাধিক স্থানে স্যুয়ারেজ লাইনের সø্যাব ভেঙে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া মুগদা বিশ্বরোড থেকে মাণ্ডার প্রধান সড়কে বেশিরভাগ অংশের পিচ-ঢালাই উঠে গেছে। ইট-খোয়া বেরিয়ে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। অলিগলির সড়কগুলো কবে সংস্কার হয়েছে, তা বেমালুম ভুলে গেছেন এলাকার বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, সড়কগুলো বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত, আর শুকনো মৌসুমে থাকে ধুলায় ধূসরিত। যত্রতত্র গর্ত, পিচ ঢালাইহীন এসব রাস্তায় সবাই চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। মুগদা-মাণ্ডা খালটিও দীর্ঘ দিন পরিষ্কার করা হয় না। এলাকার বিভিন্ন ডোবা ও পুকুর যেন ‘মশার খামার’। সেখানে নিয়মিত ওষুধও ছিটানো হয় না।

‘কিশোর গ্যাং’-এর গডফাদার : কাউন্সিলর সিরাজের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এলাকায় বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, গ্যাংয়ের সদস্যরা তার মিছিল-মিটিংয়ে যায়। তাদের বয়স ১০-২০-এর মধ্যে। এসব কিশোর অপরাধী বিভিন্ন নামে গ্রæপ খুলে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, পথেঘাটে নারী উত্ত্যক্তসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের হাতে বেশ কয়েকটি খুনোখুনিও হয়েছে। গত আগস্ট মাসে র‌্যাবের অভিযানে ‘চান-যাদু (জমজ ভাই)’, ‘ডেভিল কিং ফুল পার্টি’, ‘ভলিয়ম টু’ এবং ‘ভাণ্ডারি গ্রæপ’সহ কয়েকটি গ্রæপের ২৩ জনকে আটক ও তিন মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

মাদকের কারবার : কাউন্সিলরের লোক পরিচয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রশ্রয় ও পুলিশের সহযোগিতায় মুগদা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা শামীম, যুবলীগ নেতা নূরুল ইসলামসহ কয়েকজন মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক তদন্তে মাদক কারবারের সঙ্গে মুগদা ও খিলগাঁও থানার কয়েক সদস্যের নামও উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের কয়েক নেতার ছত্রছায়ায় এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন মুসা, টুইল্যা রুবেল ও সাজু। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেন এএসআই সোহরাওয়ার্দী হোসেন, কনস্টেবল আসাদুর রহমান, খিলগাঁও থানার এএসআই মজনু হোসেন, মুগদা থানার সাবেক এসআই মিজানুর রহমান, খিলগাঁওয়ের এএসআই আবদুল ওয়াদুদ, এএসআই মো. সেলিম হোসেন, এএসআই জয়নুল আবেদীন, এএসআই খালেদুর রহমান ও এএসআই মো. আক্তারুজ্জামান। তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার ও সাময়িক বরখাস্ত করেছে ডিএমপি।

এ বিষয়ে মুগদা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম আল মামুন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মুগদা, মানিকনগর ও মাণ্ডার অলিগলিতে চলে মাদকের কারবার, এটা সত্য। তবে আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত কি না, তা জানা নেই। কারণ আমি এসবের সঙ্গে হাঁটি না, তাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগও হয় না।’

কাউন্সিলরের বক্তব্য : এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর সিরাজ ফোনে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন আর আওয়ামী লীগে নেই। বিএনপি, হাইব্রিড কাউয়া, মাদক ব্যবসায়ী সবাই এখন নতুন আওয়ামী লীগ। তারা আওয়ামী লীগ ও জনপ্রতিনিধির নাম ভাঙিয়ে এলাকায় বদনাম ছড়াচ্ছে। আওয়ামী লীগের কিছু হাইব্রিড নেতার তত্ত¡াবধানে এসব মাদক ব্যবসা, দখলবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম চলে। যার দোষ জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে আমার ওপরও দেয় সাধারণ মানুষ। আমি এসবের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নই।’

‘কিশোর গ্যাং’-এর নেপথ্যে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এর সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমি চাই এলাকা সুন্দর থাকুক।’ ‘লজিং মাস্টার’ থেকে কোটিপতি হওয়া প্রসঙ্গে কাউন্সিলর সিরাজ বলেন, ‘অফিসে আসেন সাক্ষাতে আলাপ করব।’

এলাকার উন্নয়ন নিয়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগে মুগদা এলাকায় খোলা ড্রেনেজ সিস্টেম ছিল। এখন সেগুলো পাইপ লাইনের মধ্যে নেওয়া হচ্ছে। এ কারণে কিছু রাস্তাঘাট কাটা আছে। উন্নয়নের স্বার্থে সাধারণ মানুষকেও সেটা মেনে নিতে হবে। বৃষ্টির কারণে উন্নয়নের কাজ বাধাগ্রস্ত ও সময় বেশি লাগছে। আমি প্রতিনিয়ত ঠিকাদারদের চাপের ওপর রাখি, যাতে তারা দ্রুত কাজ সম্পন্ন করেন।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

জামাই সিরাজের সম্পদে হতবাক মুগদা এলাকাবাসী

আপডেট টাইম : ০৩:৫০:০০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সিরাজুল ইসলাম ওরফে ভাট্টি পরিচিত ‘জামাই সিরাজ’ নামে। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। গত নির্বাচনে কাউন্সিলর হওয়ার পর তার হয়েছে শনৈ শনৈ উন্নতি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক স্থানীয় নেতা ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, একসময়ের ‘লজিং মাস্টার’ সিরাজের উন্নতি দেখে এখন সবাই বিস্মিত। রাজধানীর মুগদা-মাণ্ডা এলাকাতেই তার ছয়টি বাড়ি। এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির জন্য তার আলাদাভাবে লোক নিয়োগ দেওয়া আছে। এ ছাড়া ভর্তি বাণিজ্য, মাদক কারবার ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ এবং এলাকার বাড়িঘর নির্মাণে ঠিকাদারিসহ সবকিছুই তার হাতে। তবে তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাউন্সিলর সিরাজ। গতকাল শুক্রবার তিনি ফোনে দেশ রূপান্তরকে বলেন, সবাই এখন নতুন আওয়ামী লীগ। দল ও জনপ্রতিনিধির নাম ভাঙিয়ে তাদের অপকর্মের দায় তার ওপরও পড়ছে।

স্থানীয়দের ভাষ্য, আশির দশকে বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে সিরাজুল ইসলাম দক্ষিণ মুগদায় একটি মেসবাড়িতে থাকতেন। পরে স্থানীয় কদম আলীর বাড়িতে জায়গির (লজিং) থাকতে শুরু করেন। একপর্যায়ে গৃহকর্তার মেয়ে ফাতেমা বেগমকে বিয়ে করেন। এরপর তাদের আত্মীয় মুগদায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা এনাম

সর্দার ও নজরুল সর্দারের নজরে পড়েন সিরাজ। তাদের হাত ধরেই তিনি আসেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে।

তারা বলছেন, রাজনীতি বাদে কোনো কাজ ছাড়াই ‘জামাই সিরাজ’ এলাকায় ৫-৬টি বাড়ির মালিক হয়েছেন। এর মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া শ্যালক রুবেলের নামে খুলেছেন ‘ফ্যামিলি হাউজিং স্টেট লিমিটেড’ কোম্পানি। কাগজে-কলমে নাম না থাকলেও মূলত এটি তিনিই চালান। সাম্প্রতিক অভিযান শুরুর পর কাউন্সিলর সিরাজ সব টাকা-পয়সা মাটির নিচে লুকিয়ে ফেলেছেন।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় একাধিক নেতা বলেন, আইডিয়াল স্কুলের মুগদা শাখায় ভর্তি বাণিজ্যে জড়িত সিরাজ। আগে সেখানে ছাত্রছাত্রী ভর্তিতে ৩০-৫০ হাজার টাকা করে নিতেন। এখন নিচ্ছেন দুই থেকে তিন লাখ টাকা। এর মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ কামিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া প্রভাব খাটিয়ে তিনি অর্থের বিনিময়ে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে অনেককে চাকরি দিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে মাসিক বেতনের একটি অংশও নিয়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে।

তারা আরও জানিয়েছেন, কাউন্সিলর হওয়ার আগে সিরাজ স্বেচ্ছাসেবক লীগের স্থানীয় কার্যালয়ের জন্য ওয়াসার পাম্পের জায়গা দখল করেন। এখন ওয়াসার কর্মীরা সেখানে কাজ করতে পারছেন না। নিয়মিত আড্ডার পাশাপাশি চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণও হয় সেখান থেকে। ‘লাইনম্যান’ খ্যাত জয়নালকে দিয়ে এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় দোকান বসিয়ে নিয়মিত চাঁদা তোলেন সিরাজ। এ ছাড়া দখল-চাঁদাবাজিতে এলাকায় তার সহযোগীদের মধ্যে আছেন ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা শামীম, ফ্রিডম পার্টির সাবেক কর্মী রাজা ওরফে ফ্রিডম রাজা, যুবলীগের ওয়ার্ড সভাপতি নূরুল ইসলাম। সিরাজের আশীর্বাদে একসময় বাবুর্চি দলের খানসামা নূরুল ইসলাম এখন মুগদায় ছয়টি ফ্ল্যাট ও বাড়ির মালিক। তা ছাড়া বিভিন্ন স্থানে হাট বসিয়ে শ্রমিক লীগের ওয়ার্ড সভাপতি পরিচয়ে এনামুল হক প্রতিদিন চাঁদা তুলে সিরাজ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাগ দিয়ে আসছেন।

মুগদা এলাকায় বাড়ি নির্মাণ করতে এখন বাধ্যতামূলকভাবে সিরাজের লোকদের চাঁদা দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় ব্যাংক কলোনির এক বাসিন্দা জানান, বাড়ির কাজ শুরুর পর রাজা ও রাজিবের নেতৃত্বে মিষ্টি খাওয়ার কথা বলে তার কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করা হয়। তারা ইট-বালু সরবরাহেরও প্রস্তাব দেয়। পরে চাঁদার জন্য হুমকির মুখে তিনি র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করেন।

বেহাল এলাকার রাস্তাঘাট : সরেজমিনে গতকাল দেখা গেছে, মুগদা ও আশপাশের এলাকার সড়কগুলোর বেহাল দশা। বাসাবোর কদমতলা থেকে ওয়াসা রোড পর্যন্ত সড়কে একাধিক স্থানে স্যুয়ারেজ লাইনের সø্যাব ভেঙে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া মুগদা বিশ্বরোড থেকে মাণ্ডার প্রধান সড়কে বেশিরভাগ অংশের পিচ-ঢালাই উঠে গেছে। ইট-খোয়া বেরিয়ে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। অলিগলির সড়কগুলো কবে সংস্কার হয়েছে, তা বেমালুম ভুলে গেছেন এলাকার বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, সড়কগুলো বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত, আর শুকনো মৌসুমে থাকে ধুলায় ধূসরিত। যত্রতত্র গর্ত, পিচ ঢালাইহীন এসব রাস্তায় সবাই চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। মুগদা-মাণ্ডা খালটিও দীর্ঘ দিন পরিষ্কার করা হয় না। এলাকার বিভিন্ন ডোবা ও পুকুর যেন ‘মশার খামার’। সেখানে নিয়মিত ওষুধও ছিটানো হয় না।

‘কিশোর গ্যাং’-এর গডফাদার : কাউন্সিলর সিরাজের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এলাকায় বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, গ্যাংয়ের সদস্যরা তার মিছিল-মিটিংয়ে যায়। তাদের বয়স ১০-২০-এর মধ্যে। এসব কিশোর অপরাধী বিভিন্ন নামে গ্রæপ খুলে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, পথেঘাটে নারী উত্ত্যক্তসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের হাতে বেশ কয়েকটি খুনোখুনিও হয়েছে। গত আগস্ট মাসে র‌্যাবের অভিযানে ‘চান-যাদু (জমজ ভাই)’, ‘ডেভিল কিং ফুল পার্টি’, ‘ভলিয়ম টু’ এবং ‘ভাণ্ডারি গ্রæপ’সহ কয়েকটি গ্রæপের ২৩ জনকে আটক ও তিন মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

মাদকের কারবার : কাউন্সিলরের লোক পরিচয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রশ্রয় ও পুলিশের সহযোগিতায় মুগদা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা শামীম, যুবলীগ নেতা নূরুল ইসলামসহ কয়েকজন মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক তদন্তে মাদক কারবারের সঙ্গে মুগদা ও খিলগাঁও থানার কয়েক সদস্যের নামও উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের কয়েক নেতার ছত্রছায়ায় এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন মুসা, টুইল্যা রুবেল ও সাজু। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেন এএসআই সোহরাওয়ার্দী হোসেন, কনস্টেবল আসাদুর রহমান, খিলগাঁও থানার এএসআই মজনু হোসেন, মুগদা থানার সাবেক এসআই মিজানুর রহমান, খিলগাঁওয়ের এএসআই আবদুল ওয়াদুদ, এএসআই মো. সেলিম হোসেন, এএসআই জয়নুল আবেদীন, এএসআই খালেদুর রহমান ও এএসআই মো. আক্তারুজ্জামান। তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার ও সাময়িক বরখাস্ত করেছে ডিএমপি।

এ বিষয়ে মুগদা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম আল মামুন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মুগদা, মানিকনগর ও মাণ্ডার অলিগলিতে চলে মাদকের কারবার, এটা সত্য। তবে আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত কি না, তা জানা নেই। কারণ আমি এসবের সঙ্গে হাঁটি না, তাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগও হয় না।’

কাউন্সিলরের বক্তব্য : এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর সিরাজ ফোনে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন আর আওয়ামী লীগে নেই। বিএনপি, হাইব্রিড কাউয়া, মাদক ব্যবসায়ী সবাই এখন নতুন আওয়ামী লীগ। তারা আওয়ামী লীগ ও জনপ্রতিনিধির নাম ভাঙিয়ে এলাকায় বদনাম ছড়াচ্ছে। আওয়ামী লীগের কিছু হাইব্রিড নেতার তত্ত¡াবধানে এসব মাদক ব্যবসা, দখলবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম চলে। যার দোষ জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে আমার ওপরও দেয় সাধারণ মানুষ। আমি এসবের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নই।’

‘কিশোর গ্যাং’-এর নেপথ্যে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এর সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমি চাই এলাকা সুন্দর থাকুক।’ ‘লজিং মাস্টার’ থেকে কোটিপতি হওয়া প্রসঙ্গে কাউন্সিলর সিরাজ বলেন, ‘অফিসে আসেন সাক্ষাতে আলাপ করব।’

এলাকার উন্নয়ন নিয়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগে মুগদা এলাকায় খোলা ড্রেনেজ সিস্টেম ছিল। এখন সেগুলো পাইপ লাইনের মধ্যে নেওয়া হচ্ছে। এ কারণে কিছু রাস্তাঘাট কাটা আছে। উন্নয়নের স্বার্থে সাধারণ মানুষকেও সেটা মেনে নিতে হবে। বৃষ্টির কারণে উন্নয়নের কাজ বাধাগ্রস্ত ও সময় বেশি লাগছে। আমি প্রতিনিয়ত ঠিকাদারদের চাপের ওপর রাখি, যাতে তারা দ্রুত কাজ সম্পন্ন করেন।’