হাওর বার্তা ডেস্কঃ সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র তানভীর ইসলাম। ২০১৬ সালে সরকারি তিতুমীর কলেজে অনার্সে ভর্তি হন তিনি। ভর্তির পর আক্কাসুর রহমান আখি হলে উঠতে চেয়েছিলো তানভির। অজপাড়া গ্রাম থেকে আসা তানভিরের স্বপ্ন ছিলো পড়ালেখা করে অনেক বড় হবে। কিন্তু তানভীর যে অসহায়। কোনো বড়ভাই ছাড়া নাকি ছাত্রাবাসে ওঠা যায় না।
অবশেষে এক বড়ভাইয়ের সরণাপন্ন হয়ে ছাত্রাবাসে ওঠে তানভির। কিন্তু তানভীরের দিন নেই রাত নেই সমস্যা যেনো বাড়তেই থাকে। রাজনীতি না করা ছেলে তানভিরকে এখন নিয়মিত মিছিল মিটিংয়ে যেতে হয়। বড় ভাইদের কথা মতো কাজ করতে হয়। ভাইদের নির্দেশনা না মানলে নিয়মিত নির্যাতনের শিকার হন তিনি।
এটা শুধু তিতুমীর কলেজের চিত্র নয়, বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে একই চিত্র। দেশের সরকার পরিবর্তন হলেই দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রথম টার্গেট বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করা। এরপর তাদের রাজনীতির হাতে বন্দি হয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন অবস্থার মধ্যে হটাৎ গত রোববার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েটে) টর্চার রুমে বেধড়ক পিটিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনার পর থেকেই প্রকাশ্যে আসতে থাকে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্যাতনকেন্দ্রিক নানা ঘটনা।
তথ্যমতে, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট ১৯টি হল রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি হল ছেলেদের, ৫টি মেয়েদের এবং একটি ইন্টারন্যাশনাল হল। ঢাবির এই সকল আবাসিক হলগুলোর গেস্ট রুম ও গণরুমে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের নিজস্ব টর্চার সেল রয়েছে। এসব টর্চার সেলে প্রতিদিন ছাত্রলীগকর্মী দ্বারা জুনিয়র শিক্ষার্থীরা নির্যাতনের শিকার হন।
ওইসব ছাত্র সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন সময় হলে সিট বরাদ্দে আর্থিক লেনদেন, ভিন্নপস্থি ছাত্রদের কর্মসূচিতে জোরপূর্বক অংশগ্রহণ করানো, কর্মসূচিতে না গেলে সিট থেকে নামিয়ে দেয়া, জীবন নাশের ইঙ্গিতসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করেন অন্য শিক্ষার্থীদের। হল নিয়ন্ত্রণের নামে প্রশাসন থাকলেও মূলত নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে হল থাকায় গেস্টরুম-গণরুম নির্যাতন যেন নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) দেশের অন্যতম বৃহৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ১৭টি আবাসিক হল। এসব হলের সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ৩৬ হাজার শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়টির বাইরের পরিবেশ বর্তমানে শান্ত, হলের ভেতরের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। বিশেষ করে ১৭টি আবাসিক হলে ৩৬ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৯ হাজার শিক্ষার্থীর প্রতিদিন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের কাছে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। হলের সিটে ওঠা, বিভিন্ন অজুুহাতে মাসিক চাঁদা দেয়াসহ সংগঠনের বিভিন্ন মিছিল-মিটিং করতে হয় তাদের।
তবে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সামান্য সমস্যা হলেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর অমানসিক নির্যাতন করে। অনেক সময় দেয়া হয় প্রাণনাশের হুমকি। একই অবস্থা ছিলো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়েও। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলসহ সকল সুযোগ-সুবিধা দখলে রাখতেন ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের নেতারা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কুপিয়ে হত্যা, গুম, হাত-পায়ের রগ কাটাসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতেন তারা। তাদের নির্যাতনে অনেকটাই অসহয় ছিলো সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হলের প্রাধ্যক্ষ নাম প্রকাশে না করার শর্তে আমার সংবাদকে বলেন, দিন দিন পলিটিক্যাল ছাত্রের সংখ্যা বাড়ছেই। তারা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার কারণে যোগ্যতা না থাকলেও হলের সিট বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। সে জন্য অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী যাদের আবাসিক সুবিধা পাওয়ার যোগ্যতা থাকলেও বঞ্চিত হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক জাকারিয়া বলেন, অবৈধ সিট দখলের বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তবে এসব সমস্যা হলেও হল প্রাধ্যক্ষরা আমাদের জানায়নি।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর একক আধিপত্য বিস্তার করছে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ। হলে সিট বরাদ্দে আর্থিক লেনদেন, ভিন্নপস্থি ছাত্রদের ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে জোরপূর্বক অংশগ্রহণ করানো, কর্মসূচিতে না গেলে সিট থেকে নামিয়ে দেয়া, জীবন নাশের ইঙ্গিতসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। হল কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ রেজাল্টধারী, মেধাবীদের সিট বরাদ্দ দিলেও ছাত্রলীগের নেতাদের আধিপত্য থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলে থাকতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এই নির্যাতনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ছাত্র সংগঠন শিবিরের নেতাকর্মীরা। তারাও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের নির্যাতন করতেন। কলেজ ক্যাম্পাসের সবকিছু একক নিয়ন্ত্রণ করতেন শিবিরের নেতাকর্মীরা।
জানা যায়, গত বছরের মার্চ মাসে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হলের ৪১৯ নং কক্ষে সাব্বির আহমেদ বিশাল, আবদুল্লাহ হিমু, ওমর ফারুক ও মাহাদী নবীন শিক্ষার্থীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায় ছাত্রলীগের নেতারা। নির্যাতনের পাশাপাশি এক শিক্ষার্থীর মায়ের কাছে ফোন দিয়ে ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করে বলে অভিযোগ রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের গণরুমে থাকা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা বেশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, সিট সংকটের কারণে গণরুমে থাকা এসব শিক্ষার্থী প্রথম দিন থেকেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে র্যাগিংয়ের শিকার হন। ক্ষমতাশীন দলের ছাত্র সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা গণরুমে গিয়ে ওইসব শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।
সূত্রটি জানায়, পরিচিত হওয়া, পরিচয় দিতে শেখানো, আদব-কায়দা শেখানো, খোঁজখবর নেয়াসহ বিভিন্ন অজুহাতে গণরুমে যায় ছাত্র সংগঠনের নেতার। হলে বিভিন্ন নির্যাতনের ভয়াবহতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের বাইরে মেসে থেকে ক্লাস করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) হলগুলো যেন অস্ত্র মজুদের কারখানা। ছেলেদের প্রত্যেকটি হলেই দেশি অস্ত্রের পাশাপাশি রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদ। সংঘর্ষ বাধলেই শোনা যায় এসব অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি। বারবার ক্যাম্পাসে এমন অস্ত্রের মহড়া সংঘটিত হওয়ার পরও অস্ত্র উদ্ধারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। প্রতিটি সংঘর্ষ ঘটার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয় অস্ত্র উদ্ধারে হলে অভিযান পরিচালনা করা হবে। কিন্তু সেই অভিযান আর আলোর মুখ দেখেনি।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে উদ্যোগ না নিলে যেকোনো সময় ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। সর্বশেষ এক ছাত্রলীগকর্মীর গায়ে ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের শিক্ষার্থীরা। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী চলা এ সংঘর্ষে সামনে থেকে নের্তৃত্ব দেয় দুই হলের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এতে শিক্ষক, সাংবাদিক, পুলিশসহ আহত হন অন্তত ৮০ জন। দেশি বিভিন্ন অস্ত্রের পাশাপাশি এদিনও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়। অন্তত ৮-১০ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করেন ছাত্রলীগ নেতারা।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ-বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘটিত হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। প্রকাশ্য দিবালোকে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করতে দেখা যায় দুইপক্ষের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। তাদের হাতে ছিলো রামদা, রড, জিআই-পাইপ ও চাপাতির মতো দেশি অস্ত্রশস্ত্র। একই অবস্থা ছিলো বিএনপি সরকারের সময়।
সেসময় ছাত্রদলের নেতাদের অস্ত্রের কাছে বন্দি ছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকায় বর্তমানে খুব বেশি ক্যাম্পাসে দেখা যায় না তাদের।কোনো প্রকার নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্যবাহী ইডেন মহিলা কলেজের সিট বাণিজ্য করে আসছেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা। এদের মধ্যে অনেকের নেই ছাত্রত্ব, নেই কমিটির মেয়াদ তারপরও আবাসিক ছাত্রীনিবাসে সিট পেতে হলে এসব নেত্রীকে এককালীন সাত হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়।
অনেক শিক্ষার্থীর প্রতি মাসে সিট ভাড়া গুনতে হয় দুই হাজার টাকার মতো। কলেজের বাইরের শিক্ষার্থীরা এবং যাদের শিক্ষাজীবন শেষ তাদের মাসিক ভাড়ার বিনিময়ে ছাত্রীনিবাসে থাকার সুযোগ করে দেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা। এ ছাড়াও সাধারণ ছাত্রীরা দলীয় কোনো মিছিল মিটিংয়ে না যেতে চাইলে তাদের করা হয় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। তাদের নির্যাতনের কারণে অতিষ্ঠ সাধারণ ছাত্রীরা। ছাত্রলীগ এসব নেত্রীদের সিট-বাণিজ্যে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে কলেজ প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে আবাসিক হলের সিট বণ্টনের দায়িত্ব হল প্রভোস্টদের থাকলেও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে সিট বণ্টন করে ছাত্রনেতারা। হল প্রভোস্টদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা না থাকায় ছাত্রনেতাদের মাধ্যমে সিট বণ্টন অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে নির্ধারিত সিটের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সিটকে কেন্দ্র করে হলগুলোতে চলে ছাত্র রাজনীতি ও ক্ষমতার দাপট।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক গ্রুপগুলো ছাত্রদের প্রথম বর্ষেই হলে ওঠার সুযোগ করে দিলেও তাদের বিভিন্ন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। ১ম দিকে প্রায় ৬ মাস নবীনদের আদব- কায়দা শেখানোর নামে গেস্টরুম করানো হয়। যেখানে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, কানে ধরানো, ভয়ভীতিসহ চলে নানা রকম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। গেস্ট রুমে ছাত্রদের চড়-থাপ্পড় মারার অভিযোগও উঠেছে।
হলসূত্রে জানা যায়, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও ছাত্রনেতাদের অনুসারীরা তুলনামূলক ভালো সিট পেয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে নিয়মিত মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতে হয় তাদের। সিট নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় ১ম ও ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের। মিছিল-মিটিংয়ে না গেলে সিট ফেলে দেওয়ায় ভয় দেখানো হয়।
তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি কয়েকদিন আগে ভালো সিটে উঠেছিলাম। কিন্তু রাজনীতির সাথে যুক্ত না থাকায় আমাকে সরিয়ে আমার রাজনৈতিক সক্রিয় বন্ধুকে ঐ সিটে দেওয়া হয়েছে। যা খুবই কষ্টের বিষয়। এখন ক্যাম্পাসের নিয়মই এটা— যারা রাজনীতি করবে, মিছিল-মিটিংয়ে যাবে তারা ভালো সিট পাবে। সিট দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
গত রোববার রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার করে বুয়েট ছাত্রলীগের বেশ কয়েজন নেতা। আবরার হত্যার এ ঘটনায় শোকে মূহ্যমান ক্ষোভে উত্তাল সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ফুঁসে উঠেছে ইতোমধ্যে। আবরার হত্যার ঘটনাটি দেশসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও স্থান পায়। বিবিসি, রয়টার্স, ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, আল জাজিরা, গালফ নিউজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বুয়েটের বর্বর হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়েছে। উঠে এসেছে বাংলাদেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের খবরও।
আবরার হত্যার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে গত ১০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ (চবি) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে ২৪ জন শিক্ষার্থীর লাশ হওয়ার খবর । এই ২৪ জনের মধ্যে— চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আটজন, রাজশাহীতে পাঁচজন, ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইজন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইজন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনজন। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও তিন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
এসব হত্যাকাণ্ডের ১৭টি ঘটেছে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে! এর আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় ছাত্রদলের নির্যাতনে অনেক ছাত্র প্রাণ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করতে তৈরি করেছেন টর্চার সেল। অভিযোগ রয়েছে, এই টর্চার সেলে চলতো মদের আড্ডা। মদের নেশায় আসক্ত হয়েই সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন চালাতেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুর আমার সংবাদকে বলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আশার পর তাদের প্রথম টার্গেট থাকে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ ও একক আধিপত্য বিস্তারে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নির্যাতনের শিকার হন। তিনি বলেন, এ অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘সর্বসময় দেখা যায়, একটি রাজনৈকিত দল ক্ষমতায় এলেই তাদের অঙ্গ সংগঠনের কিছু বিপথগামী নেতাকর্মী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সাধারণ শিক্ষার্থীরা বেশি সমস্যার সম্মুখীন হন। এমনকি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। তাই এই সকল সমস্যা থেকে বের হতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজেদের আইনে শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবেই এই সকল সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন প্রায়োগ নয়, পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ আমার সংবাদকে বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্র রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু আজ ছাত্র রাজনীতির নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হচ্ছে। এটা ছাত্র রাজনীতি নয়, এটা নষ্ট রাজনীতির পরিবেশ, এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের নেতারা শিক্ষার্থীদের ওপর যে নির্যাতন করেছে, তার দায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নিতে হবে। তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্র সংগঠনের কাছে জিম্মি হয়ে থাকে। অভিযুক্ত ছাত্র সংগঠনের নেতাদের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই এসব অপকর্মের হাত থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মুক্তি পাবে।