হাওর বার্তা ডেস্কঃ নাম ছিল মিজানুর রহমান, পরে কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের জন্য নামের আগে জুড়ে যায় ‘পাগলা’ উপাধি। ১৯৭৪ সালে ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় এসে মিরপুরে হোটেল বয়ের কাজ নেন। এরপর মোহাম্মদপুর এলাকার ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করা শুরু করেন।
রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে ফ্রিডম পার্টির নেতা ছিলেন মিজান। ১৯৮৯ সালে ধানমন্ডিতে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার মামলার এজাহারভুক্ত আসামীও ছিলেন তিনি। সময়ের বিবর্তনে একসময় পাল্টে ফেলেন রাজনীতিরও খোলস, ফ্রিডম পার্টির নেতা থেকে বনে যান আওয়ামী লীগ নেতা। আওয়ামী লীগের ব্যানারে সক্রিয় রাজনীতির বদৌলতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হয়ে যান মিজান। সঙ্গে পাল্টে দেন নিজের নামটিও, হয়ে যান হাবিবুর রহমান মিজান।
যেভাবে আওয়ামী লীগ নেতা বনে যান ‘পাগলা মিজান’
পাগলা মিজান আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী। তিনি দল পাল্টে রাতারাতি হয়ে ওঠেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা। পরে নেতাদের আশীর্বাদে মোহাম্মদপুরে গড়ে তুলেন অপরাধ সাম্রাজ্য। ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে আওয়ামী লীগ নেত্রী রেজিয়া বেগমের খাবার লাথি দিয়ে ফেলে দিয়ে প্রথমবার আলোচনায় আসেন মিজান।
মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ১৯৯৬ সালে তিনি মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। হত্যা, মাদকের কারবার,ভূমি দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নাম।
মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান মিজান সম্পর্কে জানতে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মিয়া চানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।
১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্য রাতে ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা চালায় একটি চক্র। তারা সেখানে গুলি করে এবং বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। সেসময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাড়ির ভেতর অবস্থান করছিলেন। শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাকারীদের অন্যতম ছিলেন মিজানুর রহমান মিজান। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা হয়। ১৯৯৭ সালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলার অভিযোগপত্র দেয়। সেখানে মিজানুর রহমান ওরফে পাগলা মিজানকে হামলার পরিকল্পনাকারীদের একজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ম্যানহোলের ঢাকনা চোর থেকে টেক্সাস-সিডনিতে বিলাসবহুল বাড়ি
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হিসেবে পাওয়া সম্মানী ছাড়া দৃশ্যমান কোনো আয় না থাকলেও এক সময়কার ম্যানহোলের ঢাকনা চোর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ও অষ্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির তথ্য পেয়েছে র্যাব। দেশ থেকে অবৈধ আয়ের অর্থ পাচারের মাধ্যমে বিদেশে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন পাগলা মিজান, এমনটাই ধারণা করছেন তারা।
মোহাম্মদপুরে পাগলা মিজানের অপরাধ সাম্রাজ্য
মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে মাদক নিয়ন্ত্রণকারী, মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজি, চোরাই গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবসার নিয়ন্ত্রক হিসেবে পাগলা মিজান পরিচিত। বর্তমান সময়েও আদাবরে ইয়াবা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছিলেন। তার নামে মোহাম্মদপুর থানায় ১৯৯৬ সালে ইউনূস হত্যা, ২০১৬ সালে সাভার থানায় জোড়া হত্যা মামলা রয়েছে।
আইনশৃংঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর সূত্র জানায়, মহাজোট সরকার আমলে মিজান বাহিনী ৩০০-৪০০ কোটি টাকার টেন্ডারবাজি করেছে। ২০১৪ সালে মোহাম্মদপুরে ৬৫ বছরের বৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আহমেদ পাইন ও তার অসুস্থ স্ত্রী মরিয়ম বেগমকে তুচ্ছ ঘটনায় শত শত মানুষের সামনে জুতাপেটা করেন এই পাগলা মিজান।
মিজান যেভাবে ‘পাগলা’ মিজান
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মিজান মোহাম্মদপুরে এসেই শুরু করেন চাঁদাবাজি, ছিনতাই। ছিনতাইকারী হিসেবেই ১৯৭৪/৭৫ সালে তার বিশেষ পরিচিতি আসে। ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে খামারবাড়ি খেজুর বাগান এলাকায় ছিনতাই করতে গেলে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে লালমাটিয়ায় মসজিদের পাশে পুকুরে নেমে পড়েন। পুলিশ তাকে বারবার নির্দেশ দিলেও তিনি পুকুর থেকে উঠে আসেননি। ৪/৫ ঘণ্টা পর তিনি কোনো ধরনের কাপড় ছাড়াই উঠে আসেন। তার এ ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের জন্য পুলিশ তাকে ‘পাগলা’ আখ্যা দেয় এবং তাকে ছেড়েও দেয়। তখন থেকেই এলাকায় তার নাম ছড়িয়ে পড়ে পাগলা মিজান নামে।
শুক্রবার শ্রীমঙ্গল সীমান্ত থেকে পাগলা মিজানকে আটক করা হয়। তিনি ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। র্যাবের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় মিজানকে আটকের খবর জানানো হয়। বার্তায় বলা হয়, চলমান অভিযানের অংশ হিসেবে হাবিবুর রহমান মিজানকে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় শ্রীমঙ্গল থেকে আটক করা হয়েছে।