ঢাকা ০৮:৩৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিএনপিকে চাইলেই ভেঙে ফেলা যাবে না: ওসমান ফারুক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৫০:১৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ নভেম্বর ২০১৫
  • ৩৩৪ বার

কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে দেশের মানুষের মনে। বিরোধী শিবিরের দাবি, এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটই প্রকাশিত হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য দরকার রাজনৈতিক সংলাপ। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে রাজি নয় সরকার। গুঞ্জন উঠছে বিএনপিকে ভাঙার ষড়যন্ত্র চলছে সরকারের ভেতর। এদিকে ডিসেম্বরে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এতে প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন মন্ত্রী-এমপিরা। এ নিয়েও ভিন্নমত আছে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে।

এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক। সম্প্রতি তার গুলশানের বাসায় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন

দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ওসমান ফারুক: দেশে একাধারে সামাজিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট চলছে। তবে রাজনৈতিক সংকটের কারণে পরিস্থিতি ঘনীভূত হচ্ছে বেশি। তাই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে পরিস্থিতি দেখতে হবে সরকারকে। এটি আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমস্যা মনে করলে হবে না, এটা জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যার উদ্ভব বিনা ভোটের নির্বাচনে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে পরিস্থিতি এমন হতো না।

আসলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরই সরকারের বোধোদয় হওয়া উচিত ছিল। যদিও নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন, পরে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন করা হবে; কিন্তু সেখান থেকে তারা সরে আসেন। এখন তো তারা সেটা উচ্চারণই করেন না।

শুধু তাই নয়,বিরোধী রাজনৈতিক দলকে এখন সামান্যতম স্পেস দিচ্ছে না সরকার। সারা দেশে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে নেয়া হয়েছে জেলে। এভাবে একটি দেশের রাজনীতি চলতে পারে না।

৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লব ও সংহতি দিবসে জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে দেয়া হয়েছে; কিন্তু আলোচনা সভার অনুমতি দেয়া হয়নি। এগুলো অশুভ লক্ষণ। সরকারকে বুঝতে হবে, ব্যক্তিগতভাবে তারা একটি দলের হলেও সরকার হিসেবে তারা জনগণের, রাষ্ট্রের।

বিদেশি নাগরিক ও পুলিশ হত্যায় বিএনপিকে দায়ী করা হচ্ছে।

ওসমান ফারুক: কোনো হত্যাকাণ্ডই বিএনপি সমর্থন করে না। আর এ ধরনের হত্যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এর প্রতিকার করতে হবে। প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে অবশ্যই বিচার করতে হবে। এসব হত্যাকাণ্ডকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না।

কোনো মন্ত্রী যখন বলেন তিনি নিরাপদ নন, সেখানে সরকার কীভাবে বলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আছে, আমি বুঝি না। সরকার কথায় কথায় বলছে,উন্নত বিশ্বে এমন অনেক ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু সেখানকার সরকার-প্রধানসহ কর্তাব্যক্তিরা তথ্য-প্রমাণ ছাড়া বলেন না, এই হত্যায় অমুকে দায়ী, ওই হত্যায় তমুকে দায়ী। বিচারের আগেই সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এমন কথা বললে তদন্ত কর্মকর্তার হাত-পা বাঁধা হয়ে যায়। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। তাই এখনই জাতীয় ঐকমত্যে আসতে হবে। জাতীয় সংলাপে বসতে হবে। মোড়ে মোড়ে পুলিশ দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায় না।

বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহ্বান সরকার নাকচ করে দিয়েছে। তাহলে সমাধান কীভাবে হবে?

ওসমান ফারুক: এটা এখন আর বিএনপির একার নয়, সবার। তাই এমন অবস্থান থেকে সরকারকে বেরোতে হবে। সমাধান খুঁজতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব বেশি। সংলাপের জন্য বেগম খালেদা জিয়া আহ্বান জানিয়েছেন। বি. চৌধুরী সাহেব বলেছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দল এমনকি এরশাদও সংলাপের কথা বলছেন। জনগণের কথা বিবেচনা করে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সংলাপে কোনো বাধা খোঁজা কাজের কথা নয়।

সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের ঐতিহ্য কিন্তু আমাদের আছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠকে উনি গিয়েছিলেন। ৭ মার্চের পরে ইয়াহিয়া খান আমাদের সংসদ দিচ্ছে না জানার পরও তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন। যে ভুট্টো আমাদের এত অপমান করল তাকে প্রথম দিকে ঢাকায় দাওয়াত দিয়ে আনা হয়নি? আমাদের নেতারা তার সঙ্গে শালিমার গার্ডেনে বন্ধুত্বপূর্ণ বৈঠক করেননি? এগুলো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। রাজনীতিতে যে যতই শত্রু হোক, সমাধানের জন্য আলোচনায় বসতেই হবে। কাজেই আমি মনে করি, আমাদের একটা ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। আশা করব, প্রধানমন্ত্রী সবাইকে নির্দেশনা দেবেন যেন পরস্পবিরোধী কথাবার্তা না বলেন।

সমাধান না হলে?

ওসমান ফারুক: আমি আশাবাদী। অতীতে অনেক সমাধান হয়েছে। এরশাদের বিরুদ্ধে নব্বইয়ের আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগ-বিএনপি একসঙ্গে বসেছে। দুই দল একসঙ্গে বসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছে। ইচ্ছা থাকলে এবং দেশ ও জাতির কথা চিন্তা করলে সমাধান সম্ভব।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আসলে উন্নয়নের বিষয়টি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সব সরকারই কিছু না কিছু করে। এই যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের (এমডিজি) কথা বলা হচ্ছে, এর অনেকগুলো ২০০৩ সালে হয়ে গেছে। প্রাইমারি শিক্ষা ফ্রি করা হয়েছিল অনেক আগে। ১৯৯০ সালের পর মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে। এটাই নিয়ম। এক সরকার কিছু করবে, অন্য সরকার ভুলত্রুটি ঠিক করে আবার কিছু করবে। এভাবে ধারাবাহিকভাবে চলে। বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় গেলে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের ভালো কাজগুলোর প্রশংসা করবে। এগুলো হলো রাজনৈতিক ট্রাডিশন। পালাবদল ঘটবেই।

বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। চাইলেই তাদের ভেঙে ফেলা যাবে না। আওয়ামী লীগ পঁচাত্তরের পর ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। তারা কিন্তু সর্বস্বান্ত হয়ে যায়নি। তবে এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জনগণ নেই। অতীতে গণ-আন্দোলনেও সমস্যা সমাধানের নজির আছে।

বিএনপি আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তাব দেবে কি না?

ওসমান ফারুক: প্রয়োজন হলে সেটা দেখা যাবে। তবে ইতিমধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন তো বলেই দিয়েছেন। অতীত ভুলে সবাইকে ছাড় দিতে হবে। তাহলেই সমাধান আসবে। আর প্রধানমন্ত্রী চাইলেই সেটা সম্ভব। কারণ বিএনপিতে যেমন চেয়ারপারসনের কথার বাইরে যাই না আমরা, তেমনি আওয়ামী লীগেও শেখ হাসিনা কিছু বললে অন্যরা তার বাইরে যান না। আমরা নেত্রীকেন্দ্রিক দল হয়ে গেছি। এটা অন্য দেশেও হয়।

তবে সমাধানের জন্য দুই পক্ষকেই ব্যক্তিগত জেদাজেদির বাইরে আসতে হবে। টপ পদে থাকলে একটু ছাড় দিতে হয়। এটাই হলো রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। এতে ব্যক্তিগত মান-সম্মান খোয়া যায় না, বরং বাড়ে।

অনেকে বলেন কর্মসূচি দেয়ার বিভিন্ন সিদ্ধান্তে বিএনপির ভুল ছিল। আপনি কী মনে করেন?

ওসমান ফারুক: ভুল থাকতে পারে। তবে একটা জিনিস্- সফল হলে অনেক দাবিদার পাওয়া যায়, ব্যর্থ হলে একজনকে দায়ী করা হয়। হ্যাঁ, ভুল হলে সামনের দিনগুলোতে সেগুলো মাথায় রেখে এগোতে হবে। আমার মনে হয়, চেয়ারপারসনসহ শীর্ষ নেতাদের বর্তমান পদক্ষেপ অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। আমরা সমস্যার সমাধান করতে চাই। সেটা প্রথমে নিচের দিকে করা যায়। পরে উপরের দিকে। আবার প্রথমে উচ্চ পর‌্যায় থেকে এজেন্ডা ঠিক করে দেয়া যায়।

সমশের মবিন চৌধুরীর পদত্যাগ ও বিএনপি ভাঙার গুঞ্জন একসূত্রে গাঁথা বলে মনে করছে অনেকে।

ওসমান ফারুক: রাজনীতিতে যেমন স্বেচ্ছায় আসার সুযোগ আছে, সেভাবে স্বেচ্ছায় চলে যাওয়ারও সুযোগ রয়েছে। রাজনীতি করার কারণে আমার অবস্থান কেমন হয়েছে, মানুষের ভালোবাসা কতটা পেয়েছি, সেটা বিবেচনা করতে হবে। আর বিদায় নেয়াটা মানুষ কীভাবে দেখছে সেটাও ভেবে দেখতে হবে। সমশের মবিনের পদত্যাগের মধ্যে আমি কোনো উদ্দেশ্য আরোপ করতে চাই না। তবে সিদ্ধান্তটা সময়োপযোগী কি না সে নিয়ে প্রশ্ন আছে।

শুধু বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দল থেকেও অনেকে অনেক সময় চলে গেছেন। তাতে দলের কোনো ক্ষতি হয়নি। দল ভাঙার যে গুজবের কথা বলছেন, সেটা আমিও শুনি। কিন্তু এসব বাস্তব নয়, আমার কাছে গুজবই মনে হয়।

দল পুনর্গঠন ও জাতীয় কাউন্সিলের কী অবস্থা?

ওসমান ফারুক: চেয়ারপারসনের নির্দেশনা অনুযায়ী পুনর্গঠনের কাজ চলছে। তবে সরকারের কাছ থেকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কাউন্সিলে তো গণ্ডগোল লাগানো সহজ। আমরা হলরুম ব্যবহারেরও সুযোগ পাই না। জাতীয় কাউন্সিলের চিন্তা অনেক দিন ধরে চলছে। এ জন্যও হল নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকারের বাধায় তা করা যায়নি। চেয়ারপারসন দেশে ফিরলে হয়তো ভালোভাবে বলা যাবে।

পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে নেতাকর্মীদের কী নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে? আর জামায়াত দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে না পারলে বিএনপি কি লাভবান হবে বলে মনে করেন?

ওসমান ফারুক: বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু এই নির্বাচনে যেভাবে মন্ত্রী-এমপিদের প্রচারণার সুযোগ রাখা হচ্ছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। স্থানীয় নির্বাচনে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয়নি। সরকারের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা উচিত। আর যদি অটল থাকে, তাহলে দেশে-বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি আরো ক্ষুণ্ন হবে। তার পরও নেতাকর্মীরা যারা যোগাযোগ করছেন, তাদের নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে বলা হচ্ছে। আর জামায়াতের ভোট দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যায় না।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

বিএনপিকে চাইলেই ভেঙে ফেলা যাবে না: ওসমান ফারুক

আপডেট টাইম : ১১:৫০:১৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ নভেম্বর ২০১৫

কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে দেশের মানুষের মনে। বিরোধী শিবিরের দাবি, এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটই প্রকাশিত হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য দরকার রাজনৈতিক সংলাপ। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে রাজি নয় সরকার। গুঞ্জন উঠছে বিএনপিকে ভাঙার ষড়যন্ত্র চলছে সরকারের ভেতর। এদিকে ডিসেম্বরে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এতে প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন মন্ত্রী-এমপিরা। এ নিয়েও ভিন্নমত আছে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে।

এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক। সম্প্রতি তার গুলশানের বাসায় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন

দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ওসমান ফারুক: দেশে একাধারে সামাজিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট চলছে। তবে রাজনৈতিক সংকটের কারণে পরিস্থিতি ঘনীভূত হচ্ছে বেশি। তাই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে পরিস্থিতি দেখতে হবে সরকারকে। এটি আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমস্যা মনে করলে হবে না, এটা জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যার উদ্ভব বিনা ভোটের নির্বাচনে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে পরিস্থিতি এমন হতো না।

আসলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরই সরকারের বোধোদয় হওয়া উচিত ছিল। যদিও নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন, পরে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন করা হবে; কিন্তু সেখান থেকে তারা সরে আসেন। এখন তো তারা সেটা উচ্চারণই করেন না।

শুধু তাই নয়,বিরোধী রাজনৈতিক দলকে এখন সামান্যতম স্পেস দিচ্ছে না সরকার। সারা দেশে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে নেয়া হয়েছে জেলে। এভাবে একটি দেশের রাজনীতি চলতে পারে না।

৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লব ও সংহতি দিবসে জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে দেয়া হয়েছে; কিন্তু আলোচনা সভার অনুমতি দেয়া হয়নি। এগুলো অশুভ লক্ষণ। সরকারকে বুঝতে হবে, ব্যক্তিগতভাবে তারা একটি দলের হলেও সরকার হিসেবে তারা জনগণের, রাষ্ট্রের।

বিদেশি নাগরিক ও পুলিশ হত্যায় বিএনপিকে দায়ী করা হচ্ছে।

ওসমান ফারুক: কোনো হত্যাকাণ্ডই বিএনপি সমর্থন করে না। আর এ ধরনের হত্যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এর প্রতিকার করতে হবে। প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে অবশ্যই বিচার করতে হবে। এসব হত্যাকাণ্ডকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না।

কোনো মন্ত্রী যখন বলেন তিনি নিরাপদ নন, সেখানে সরকার কীভাবে বলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আছে, আমি বুঝি না। সরকার কথায় কথায় বলছে,উন্নত বিশ্বে এমন অনেক ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু সেখানকার সরকার-প্রধানসহ কর্তাব্যক্তিরা তথ্য-প্রমাণ ছাড়া বলেন না, এই হত্যায় অমুকে দায়ী, ওই হত্যায় তমুকে দায়ী। বিচারের আগেই সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এমন কথা বললে তদন্ত কর্মকর্তার হাত-পা বাঁধা হয়ে যায়। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। তাই এখনই জাতীয় ঐকমত্যে আসতে হবে। জাতীয় সংলাপে বসতে হবে। মোড়ে মোড়ে পুলিশ দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায় না।

বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহ্বান সরকার নাকচ করে দিয়েছে। তাহলে সমাধান কীভাবে হবে?

ওসমান ফারুক: এটা এখন আর বিএনপির একার নয়, সবার। তাই এমন অবস্থান থেকে সরকারকে বেরোতে হবে। সমাধান খুঁজতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব বেশি। সংলাপের জন্য বেগম খালেদা জিয়া আহ্বান জানিয়েছেন। বি. চৌধুরী সাহেব বলেছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দল এমনকি এরশাদও সংলাপের কথা বলছেন। জনগণের কথা বিবেচনা করে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সংলাপে কোনো বাধা খোঁজা কাজের কথা নয়।

সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের ঐতিহ্য কিন্তু আমাদের আছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠকে উনি গিয়েছিলেন। ৭ মার্চের পরে ইয়াহিয়া খান আমাদের সংসদ দিচ্ছে না জানার পরও তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন। যে ভুট্টো আমাদের এত অপমান করল তাকে প্রথম দিকে ঢাকায় দাওয়াত দিয়ে আনা হয়নি? আমাদের নেতারা তার সঙ্গে শালিমার গার্ডেনে বন্ধুত্বপূর্ণ বৈঠক করেননি? এগুলো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। রাজনীতিতে যে যতই শত্রু হোক, সমাধানের জন্য আলোচনায় বসতেই হবে। কাজেই আমি মনে করি, আমাদের একটা ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। আশা করব, প্রধানমন্ত্রী সবাইকে নির্দেশনা দেবেন যেন পরস্পবিরোধী কথাবার্তা না বলেন।

সমাধান না হলে?

ওসমান ফারুক: আমি আশাবাদী। অতীতে অনেক সমাধান হয়েছে। এরশাদের বিরুদ্ধে নব্বইয়ের আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগ-বিএনপি একসঙ্গে বসেছে। দুই দল একসঙ্গে বসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছে। ইচ্ছা থাকলে এবং দেশ ও জাতির কথা চিন্তা করলে সমাধান সম্ভব।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আসলে উন্নয়নের বিষয়টি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সব সরকারই কিছু না কিছু করে। এই যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের (এমডিজি) কথা বলা হচ্ছে, এর অনেকগুলো ২০০৩ সালে হয়ে গেছে। প্রাইমারি শিক্ষা ফ্রি করা হয়েছিল অনেক আগে। ১৯৯০ সালের পর মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে। এটাই নিয়ম। এক সরকার কিছু করবে, অন্য সরকার ভুলত্রুটি ঠিক করে আবার কিছু করবে। এভাবে ধারাবাহিকভাবে চলে। বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় গেলে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের ভালো কাজগুলোর প্রশংসা করবে। এগুলো হলো রাজনৈতিক ট্রাডিশন। পালাবদল ঘটবেই।

বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। চাইলেই তাদের ভেঙে ফেলা যাবে না। আওয়ামী লীগ পঁচাত্তরের পর ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। তারা কিন্তু সর্বস্বান্ত হয়ে যায়নি। তবে এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জনগণ নেই। অতীতে গণ-আন্দোলনেও সমস্যা সমাধানের নজির আছে।

বিএনপি আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তাব দেবে কি না?

ওসমান ফারুক: প্রয়োজন হলে সেটা দেখা যাবে। তবে ইতিমধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন তো বলেই দিয়েছেন। অতীত ভুলে সবাইকে ছাড় দিতে হবে। তাহলেই সমাধান আসবে। আর প্রধানমন্ত্রী চাইলেই সেটা সম্ভব। কারণ বিএনপিতে যেমন চেয়ারপারসনের কথার বাইরে যাই না আমরা, তেমনি আওয়ামী লীগেও শেখ হাসিনা কিছু বললে অন্যরা তার বাইরে যান না। আমরা নেত্রীকেন্দ্রিক দল হয়ে গেছি। এটা অন্য দেশেও হয়।

তবে সমাধানের জন্য দুই পক্ষকেই ব্যক্তিগত জেদাজেদির বাইরে আসতে হবে। টপ পদে থাকলে একটু ছাড় দিতে হয়। এটাই হলো রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। এতে ব্যক্তিগত মান-সম্মান খোয়া যায় না, বরং বাড়ে।

অনেকে বলেন কর্মসূচি দেয়ার বিভিন্ন সিদ্ধান্তে বিএনপির ভুল ছিল। আপনি কী মনে করেন?

ওসমান ফারুক: ভুল থাকতে পারে। তবে একটা জিনিস্- সফল হলে অনেক দাবিদার পাওয়া যায়, ব্যর্থ হলে একজনকে দায়ী করা হয়। হ্যাঁ, ভুল হলে সামনের দিনগুলোতে সেগুলো মাথায় রেখে এগোতে হবে। আমার মনে হয়, চেয়ারপারসনসহ শীর্ষ নেতাদের বর্তমান পদক্ষেপ অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। আমরা সমস্যার সমাধান করতে চাই। সেটা প্রথমে নিচের দিকে করা যায়। পরে উপরের দিকে। আবার প্রথমে উচ্চ পর‌্যায় থেকে এজেন্ডা ঠিক করে দেয়া যায়।

সমশের মবিন চৌধুরীর পদত্যাগ ও বিএনপি ভাঙার গুঞ্জন একসূত্রে গাঁথা বলে মনে করছে অনেকে।

ওসমান ফারুক: রাজনীতিতে যেমন স্বেচ্ছায় আসার সুযোগ আছে, সেভাবে স্বেচ্ছায় চলে যাওয়ারও সুযোগ রয়েছে। রাজনীতি করার কারণে আমার অবস্থান কেমন হয়েছে, মানুষের ভালোবাসা কতটা পেয়েছি, সেটা বিবেচনা করতে হবে। আর বিদায় নেয়াটা মানুষ কীভাবে দেখছে সেটাও ভেবে দেখতে হবে। সমশের মবিনের পদত্যাগের মধ্যে আমি কোনো উদ্দেশ্য আরোপ করতে চাই না। তবে সিদ্ধান্তটা সময়োপযোগী কি না সে নিয়ে প্রশ্ন আছে।

শুধু বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দল থেকেও অনেকে অনেক সময় চলে গেছেন। তাতে দলের কোনো ক্ষতি হয়নি। দল ভাঙার যে গুজবের কথা বলছেন, সেটা আমিও শুনি। কিন্তু এসব বাস্তব নয়, আমার কাছে গুজবই মনে হয়।

দল পুনর্গঠন ও জাতীয় কাউন্সিলের কী অবস্থা?

ওসমান ফারুক: চেয়ারপারসনের নির্দেশনা অনুযায়ী পুনর্গঠনের কাজ চলছে। তবে সরকারের কাছ থেকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কাউন্সিলে তো গণ্ডগোল লাগানো সহজ। আমরা হলরুম ব্যবহারেরও সুযোগ পাই না। জাতীয় কাউন্সিলের চিন্তা অনেক দিন ধরে চলছে। এ জন্যও হল নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকারের বাধায় তা করা যায়নি। চেয়ারপারসন দেশে ফিরলে হয়তো ভালোভাবে বলা যাবে।

পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে নেতাকর্মীদের কী নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে? আর জামায়াত দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে না পারলে বিএনপি কি লাভবান হবে বলে মনে করেন?

ওসমান ফারুক: বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু এই নির্বাচনে যেভাবে মন্ত্রী-এমপিদের প্রচারণার সুযোগ রাখা হচ্ছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। স্থানীয় নির্বাচনে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয়নি। সরকারের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা উচিত। আর যদি অটল থাকে, তাহলে দেশে-বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি আরো ক্ষুণ্ন হবে। তার পরও নেতাকর্মীরা যারা যোগাযোগ করছেন, তাদের নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে বলা হচ্ছে। আর জামায়াতের ভোট দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যায় না।