(১)
এথেন্সের জনগনের উচ্চকিত দাবীর মুখে বিচারকগণ কর্তৃক দার্শনিক সক্রেটিসের প্রাণদণ্ড ঘোষণার পর এক মাস দুইদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ঈশ্বরের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। সক্রেটিস ছিলেন এথেন্সের জনগণের জন্যে ঘোড়ার ডাঁশ পোকা স্বরূপ। ডাঁশ পোকা ঘোড়ার গায়ে হুল ফোটায় যাতে সে ঘুমিয়ে না পড়ে এবং সতেজভাবে তার নির্ধারিত পথে চলতে পারে। সক্রেটিস এথেন্সের জনগণকে বললেনঃ
“আমি তোমাদের ডাঁশ পোকা। আমার দংশন তোমাদের বিবেককে জাগ্রত করবে যখন তোমরা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যাও। ঘুমিয়ো না, ঘুমিয়ো না, এথেন্সের জনগণ; জেগে ওঠো এবং সত্যানুসন্ধানী হও।“
জনগণ খুবই বিরক্ত হলো এবং নিষ্ঠুরভাবে দাবী করে বসলো ডাঁশ পোকা থেকে মুক্ত হবার।
“যদি এমন হয়ে থাকে যে বাদী মেলেটাস ও এনিটাস দুজনেই ভুল করেছে, “আদালতের দন্ড ঘোষণার পর জনগণ সন্দেহ পোষণ করলো।
“কিন্তু তার মতবাদ কি বলে? কি করতে চান তিনি? আমাদের ভেতরে তিনি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন। আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রচলিত সকল বিশ্বাসকে তিনি ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। নতুন নতুন বিশ্বাস ও মূল্যবোধের কথা বলছেন এবং চাচ্ছেন যে আমরা সবাই সেগুলোকে মানি। তিনি নতুন ধরণের ঈশ্বরের কথা বলছেন, যার সম্পর্কে আমরা কস্মিনকালেও শুনিনি। ঈশ্বরের নামে অপবাদ সৃষ্টিকারী এই লোক ঈশ্বরের চেয়েও নিজেকে জ্ঞানী মনে করেন। আমাদের উচিৎ পুরাতন ঈশ্বরদের প্রতিই সর্বদা বিশ্বস্ত থাকা, যাদেরকে আমরা জানি। তাঁরা হয়তো সকল সময়ে সঠিক কাজটি করেন না; অনেক সময়েই তারা অন্যায্য হিংসায় মেতে উঠেন; পার্থিব মানুষদের স্ত্রীদের দিকে কুনজর দেন। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষরা কি তাদের সাথে মানিয়ে নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করেননি? তারা কি তাদের সাহায্য নিয়ে বীরত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করেননি? দেখো, এখন অলিম্পাসের দেবতাদের মুখ মলিন হয়ে গেছে। আমাদের পুরনো মূল্যবোধ ধ্বংসের মুখে। আমাদের কি উচিৎ না এই অধার্মিক ব্যক্তি ও তার অভিজ্ঞানকে চিরতরে শেষ করে দেয়া?”
গোধূলির নীল আলো নেমে আসলে এথেন্সের জনগণ পরস্পরের সাথে এভাবেই আলাপচারিতা করতে করতে আদালত প্রাঙ্গণ ত্যাগ করলো। তারা রায় দিয়েছে এই অস্থির ডাঁশ পোকাকে হত্যা করার, যাতে ঈশ্বরদের চেহারা পুনরায় উজ্জ্বলতা ফিরে পায়।
কিন্তু তাদের দৃষ্টির সামনে ভেসে উঠতে লাগলো নম্র একজন দার্শনিকের চেহারা। কিছু কিছু নাগরিক সাহসিকতার সাথে স্মরণ করলো কিভাবে তিনি তাদেরকে Potidaeর সমস্যা ও বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন; কিভাবে তিনি Arginusae বিজয়ের পর একাকী তাদেরকে অন্যায়ভাবে জেনারেলদেরকে হত্যা করা থেকে বিরত রেখেছিলেন; কিভাবে তিনি একাকী প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন যখন ১৫০০ সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছিলো।
“সেই মেষপালকই কি ভালো মেষপালকই নয় যে তার মেষপালকে পাহারা দিয়ে রাখে, যাতে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়? নাকি সেটাই ভালো মেষপালক যে এদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং সংখ্যা কমিয়ে দেয়? ভালো ধরণের শাসকরা কি কখনোই এধরণের করে থাকে তাদের প্রজাদের সাথে? এথেন্সের জনগণ, আমাদের উচিত এই প্রশ্নের উত্তর আহরণ করা।“
এধরণের একটা সংহতির প্রশ্নে অত্যাচারীরা নিবৃত হলেও নগরের যুবকদের চোখ আগুণের মতো জ্বলে উঠলো ক্রোধে ও অশ্রদ্ধায়।
সুতরাং রায় প্রদানের পর এথেন্সের অধিবাসীরা পুনরায় সক্রেটিসের ব্যাপারগুলো নিয়ে স্মরণ করলো এবং তাদের মনের ভেতরে সন্দেহ ঘনীভূত হলো। তারা ভাবতে লাগলো, “আমরা কি তার (সক্রেটিস) প্রতি নিষ্ঠূর ও ভুল আচরণ করিনি?”
অতঃপর এথেন্সবাসীরা পোতাশ্রয় ও সাগরের দিকে তাকালো। দেখতে পেলো গোধূলির আলোর ভেতরে বেগুনী পাল উড়িয়ে কয়েকটা জাহাজ দূর সাগরের ভেতরে ভাসছে। এই জাহাজগুলো যাত্রা করেছে Delian উৎসবে অংশগ্রহণের জন্যে। আগামী এক মাসের পূর্বে এই জাহাজগুলো এথেন্সে প্রত্যাবর্তন করবে না। তাদের মনে এলো যে, এই সময়কালে কারো রক্ত ঝরানো যাবে না। তা সে দোষী বা নির্দোষ যেই হোক না কেন। এই এক মাস শেষ হতে আরো অনেকদিন বাকী আছে। এই সময়ে সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও এই সময়ের পর তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা সম্ভব হবে না। কারণ এই সময়ের ভেতরেই সে জেল থেকে সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হবে। বন্ধু ও শিষ্যদের সহায়তায়। প্লেটো, Aeschines এবং অন্য শিষ্যদের পক্ষে খুবই সম্ভব জেলের পাহারাদারদের ঘুষ দিয়ে তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার। সে ক্ষেত্রে তিনি এথেন্স থেকে পালিয়ে বর্বরদের Thessaly অথবা Peloponnesus, এমনকি আরো দূরে মিশরেও চলে যেতে সক্ষম হবেন। তখন এথেন্সবাসীরা ইচ্ছে করলেও তাকে হত্যা করতে পারবে না। কিছু কিছু এথেন্সবাসী এটাকে মন্দের ভালো বলেই ধরে নিলো। কারণ প্রকারান্তরে এটা তাদেরকে অন্যায় করা থেকে বিরত রাখবে।
ফলে গোপনে গোপনে তারা আশা পোষণ করতে লাগলো যে, তাদের এই অস্থির দার্শনিক এথেন্স থেকে পলায়ন করবেন ও তার কষ্টদায়ক উপস্থিতি থেকে জনগণকে মুক্তি দেবেন। এবং এভাবেই তারা একজন নির্দোষ মানুষকে হতার দায় থেকেও রেহাই পাবে।
এরপর যথারীতি ৩২ বার সূর্য সমুদ্রের ভেতর থেকে উঠলো আর ডুবলো। উৎসব থেকে জাহাজগুলো ফিরে আসতে লাগলো পালগুলোকে নিম্নমুখী করে। যেনো তারা নিজেদের নগর নিয়ে লজ্জিত। আকাশে চাঁদ উঠলো না। সাগর অস্পষ্ট হয়ে গেলো গভীর কুয়াশার আবরণে। পাহাড়ের বাতিগুলো নিবু নিবু করে জ্বলতে থাকলো অপরাধবোধে আক্রান্ত মানুষদের মতো। কিন্তু একগুঁয়ে সক্রেটিস তাদেরকে তাদের পাপবোধ থেকে মুক্ত করলেন না।
“তোমরা তোমাদের পথে যাও, আমি আমার পথে। আমি মৃত্যুর দিকে এবং তোমরা জীবনের দিকে।এর ভেতরে কোনটা ভালো তা শুধু ঈশ্বরই জানেন, “ রায় ঘোষণার পর তিনি বিচারকদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
জাহাজগুলো পোতাশ্রয়ে ফিরে আসার সময়ে নাগরিকরা অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলো। এই একগুঁয়ে মানুষটা কি আসলেই মৃত্যুকে বরণ করে নেবে? তারা Aeschines, Phaedo এবং সক্রেটিসের অন্য শিষ্যদের কাছে গেলো।
“তোমরা কি তোমাদের শিক্ষককে মরার জন্যে অনুমতি দিচ্ছো?’ তিরস্কারের সুরে তারা তাদেরকে বললো। “ নাকি তোমরা পাহারাদারদের কিছু মূদ্রা ঘুষ হিসেবে দিতে কঞ্জুষপনা করছো?”
শিষ্য ক্রিটো (Crito) সক্রেটিসকে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে শেষ অনুরোধ করলো এই বলে যে এথেন্সের নাগরিকেরা তাদেরকে কৃপণ ও বন্ধুত্বের অনুভূতিহীন হিসেবে অভিযুক্ত করছে। কিন্তু প্রবল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী সক্রেটিস তার বা এথেন্সের নাগরিকদের অনুরোধ কোনটাই রাখলেন না।
“চলো আমরা নিরীক্ষা করে দেখি। যদি পালিয়ে যাওয়া শ্রেয়তর হয়, তবে আমি পালিয়ে যাবো। আর যদি মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া শ্রেয়তর হয়, তবে আমি মৃত্যুকেই বেছে নেবো। মনে রেখো আমি তোমাদেরকে একবার বলেছিলাম – জ্ঞানীদের মৃত্যুকে ভয় পাবার কিছুই নেই, শুধু মিথ্যা বা প্রতারণাকে ছাড়া। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের তৈরী করা নিয়মগুলো মিথ্যা প্রমাণিত না হয়, ততক্ষণ আমাদের উচিৎ সেগুলোকে অনুসরণ করা। আমার স্মৃতি যদি আমাকে প্রতারিত না করে থাকে, তবে আমি নিশ্চিত যে তোমাদেরকে আমি এই কথাগুলো বলেছিলাম।“
“হ্যাঁ, আমরা বলেছিলাম,“ তার শিষ্যরা উত্তর দিলো।
“এবং মনে হয় এবিষয়ে আমরা একমতও হয়েছিলাম।“
“হ্যাঁ।
“তাহলে কি অন্যদের জন্যে যা সত্য, তা আমাদের জন্যে সত্য নয়?”
“সত্য সবার জন্যেই এক, আমাদের জন্যেও।”
“তাহলে কি আমি যখন মরে যাবো, তখন সত্যগুলো অসত্য হয়ে যাবে?”
“জী না, সক্রেটিস, সত্য যে কোনো পরিস্থিতিতে সত্যই থাকে।”
শিষ্যরা তার প্রত্যেকটা কথা মেনে নেয়ার পর সক্রেটিস মৃদু হাসলেন এবং উপসংহার টানলেন।
“যদি তাই হয়, বন্ধুরা, আমার কি অবশ্যই এই মৃত্যুকে মেনে নেয়া উচিৎ নয়? নাকি আমার মস্তিষ্ক এতোই দুর্বল হয়ে গেছে যে, আমি যৌক্তিক উপসংহারে উপনীত হতে ব্যর্থ হচ্ছি? সে ক্ষেত্রে তোমরা আমাকে সংশোধন করো, যাতে আমার ভুল পথে ধাবিত হওয়া মস্তিষ্ক সঠিক পথে ফিরে আসে।”
শিষ্যরা সক্রেটিসের উত্তরীয় দিয়ে নিজেদের মুখ আবৃত করে সরে আসলো এবং বলল, “আমরা এখন বুঝতে পারছি যে আপনাকে মরতেই হবে।”
সেদিন অপরাহ্ণে সাগর উত্তাল হয় উঠলো। কুয়াশার কারণে প্রায়ান্ধকার হয়ে গেলো চারদিক। সাগর গর্জন করতে লাগলো। অদ্ভুত এক বাতাস বিস্মিতভাবে বেদনাতুর হয়ে জাহাজের পালগুলো নাড়াতে লাগলো। নাগরিকেরা তখন পরস্পরকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো,”তিনি কি মরে গেছেন?” তাদের কণ্ঠস্বরের ভেতরে তখন আশাহীনতা ব্যতীত আর কিছুই ছিলো না।
সুর্যাস্তের কালে তাদের কাছে মনে হলো ঈশ্বরদের মুখও মলিন হয় গেছে লজ্জায়। শুধুমাত্র একজন একগুঁয়ে মানুষের মৃত্যুকে আস্বাদন করার কারণে।
বাতাসের উদ্দামতা বাড়তে থাকলো। পুরো শহর ঢেকে গেলো কুয়াশার অন্ধকারে। রাগান্বিত বাতাস পোতাশ্রয়ে অপেক্ষমাণ জাহাজগুলোর পালগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে লাগলো। প্রতিশোধের দেবী এরিনেস নাগরিকদের অন্তরে বেদনার গান শোনাতে লাগলেন। পরিশেষে একটা প্রবল ঝড় এসে সক্রেটিসের সমালোচনাকারীদেরকে অভিভূত ও আবৃত করে ফেললো।
তবে অনুতাপের ভেতরেও নাগরিকদের বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা দূর হলো না। তারা সক্রেটিসের আরো দোষত্রুটি বের করতে থাকলো। কারণ তিনি Thessalyতে পালিয়ে যেয়ে তাদেরকে সন্তুষ্ট করেননি। তারা তার শিষ্যদের ওপরে বিরক্ত হলো। কারণ তারা সক্রেটিসের মৃত্যুর দিন কালো শোকের পোষাক পরে চলাফেরা করছিলো, যা ছিলো তাদের (এথেনিয়ানদের) প্রতি বিদ্রূপস্বরূপ। তারা বিচারকদের প্রতি বিরক্ত হলো। কারণ উত্তেজিত মানুষদের অন্ধ ক্রোধকে প্রতিহত করার সাহস ও জ্ঞান তাদের ছিলো না। এমনকি তারা ঈশ্বরদের প্রতিও তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে পিছপা হলো না। অনেকেই বললো, “ হে ঈশ্বর, তোমাকে উদ্দেশ্যে করেই তো আমরা এই বলিদান করেছিলাম, এখন তুমি আনুন্দ কর, হে অতৃপ্ত!”
সক্রেটিসের শেষ কথাগুলো নাগরিকদের প্রাণের ভেতরে বাজতে লাগলো। যেগুলো তিনি বিচারকগণ ও আদালতে উপস্থিত মানুষদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন। যদিও তিনি জেলের ভেতরে কাফনের নীচে স্থির হয়ে শুয়ে আছেন, শহরময় বিচরণ করছে শোক, লজ্জা আর ভয়। নিপীড়নের ওপারে গিয়ে সক্রেটিস পুনরায় আবির্ভুত হয়েছেন তাদেরকে পীড়নকারী ডাঁশ পোকা হিসেবে। তাকে হত্যা করা হলেও তার দংশন আরো ধারালোভাবে জনগণকে আঘাত করছে। প্রতিনিয়ত।
“ ঘুমিয়ো না, ঘুমিয়ো না এথেন্সের জনগণ! আজ রাতে তোমরা ঘুমিয়ো না! তোমরা এক অবিচার করেছো, চরম নিষ্ঠুর অবিচার। যাকে কখনোই মুছে ফেলা সম্ভব নয়!”
সেই দুঃখের দিনগুলোতে সক্রেটিসের এক শিষ্য সেনাপতি জেনোফোন ছিলো দূরদেশে। দশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে চেষ্টা করছিলো তার প্রিয় পিতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করতে।
সক্রেটিসের অপরাপর শিষ্য যেমন, Aeschines, CritO, Critobulus এবং Appollodorus তখন ব্যস্ত ছিলো সক্রেটিসের জন্যে একটা সাধারণ ধরণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করতে।
প্লেটো, সক্রেটিসের সেরা শিষ্য তখন ব্যস্ত ছিলো বাতি জ্বালিয়ে চামড়ার কাগজের উপরে তাঁর (সক্রেটিসের) শেষ সময়ের কর্ম, কথা ও শিক্ষাগুলোকে লিপিবদ্ধ করায়। তার উদ্দেশ্য ছিলো যাতে সক্রেটিসের কোনো চিন্তাই কালের গর্ভে হারিয়ে না যায়। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে তাঁর কর্তৃক উদ্ঘাটিত এই সত্যগুলোই একসময়ে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে।
এছাড়াও সক্রেটিসের আরেকজন শিষ্য ছিলো। নাম টেসিপপাস (Ctesippus)।
কিছুকাল পূর্বেও সে ছিলো খুবই অস্থির চিত্তের অধিকারী ও শুধুই পার্থিব আনন্দের অনুসন্ধানী। সৌন্দর্যকে সে তার একচ্ছত্র ঈশ্বর এবং Cliniasকে মনে করতো শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে। তবে সক্রেটিসের সাথে পরিচিত হবার কিছুকাল পরেই তার ভেতর থেকে সার্বক্ষণিক আনন্দ উপভোগ করার ইচ্ছা ও তার হালকা ধরণের স্বভাব দূর হয়ে গিয়েছিলো। ক্রমশ সে হয়ে উঠেছিল এসকল পার্থিব বিষয়ের প্রতি খুবই উদাসীন। অথচ তার বয়সী অন্যান্য যুবকেরা সে সময়ে তার অতীত স্বভাবগুলোকে অর্জন করে নিচ্ছিলো। তারই জায়গায়। তার নিকটে সক্রেটিসের চিন্তার উদারতা ও আত্মার প্রাচুর্যকে মনে হতে লাগলো Clinias এর কমনীয় সৌন্দর্যের চেয়ে শতগুণ শ্রেষ্ঠতর। ফলে নিজের সমস্ত আবেগ নিয়ে সে সক্রেটিসের প্রতি ভক্তিতে বুঁদ হয়ে রইলো, যে সক্রেটিস বিরাজমান সত্য সম্পর্কে তার ভেতরে সন্দেহের বীজ বপন করেছিলেন। যেমন করে যৌবনপ্রাপ্ত ওক গাছের কুঁড়ি তাজা বসন্তের বাতাসে উন্মোচিত হয়।
গুরুর মৃত্যুর পর টেসিপপাস নিজের আত্মা, রাস্তার অসহনীয় নির্জনতা কিংবা তার বন্ধুদের মধ্যে – কোথাও শান্তি খুঁজে পেলো না। সকল দেবতাদের প্রতি তার ঘৃণা ক্রমশ চরম রূপ ধারণ করতে লাগলো।
“আমি জানি না তোমরাই সেই দেবতা কিনা, যাদের প্রতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মানুষেরা ধূপ পুড়িয়েছে ও নির্মাল্য নিবেদন করেছে। আমি শুধু জানি যে, তোমাদের কারণে অন্ধ, উত্তেজিত মানুষেরা একটা উজ্জল সত্যের আলোকবর্তিকাকে নিভিয়ে দিয়েছে এবং মরণশীলদের ভেতরে তাদের শ্রেষ্ঠজনকে উৎসর্গ করেছে,” সে বললো।
টেসিপপাস এর কাছে মনে হতে লাগলো নগরের রাস্তাঘাট, এমনকি বাজারগুলো থেকেও অন্যায় বিচারের রায়গুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সে স্মরণ করলো কীভাবে এথেন্সের নাগরিকেরা ভিড় করেছিলো তাদের জেনারেলদের বিচার করার জন্যে, যারা তাদেরকে Argunisae এর বিরুদ্ধে জয় এনে দিয়েছিলো। সে স্মরণ করলো কীভাবে একাকী সক্রেটিস বিচারকদের দেয়া সেই অন্যায্য রায় ও উন্মত্ত নাগরিকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। অথচ কেউই তাদের পক্ষ হয়ে লড়তে আসেনি। টেসিপপাস নিজেকে ও নিজের বন্ধুদেরকেও দোষারোপ করতে লাগলো। সে প্রত্যেককে এড়িয়ে চলতে চাইলো। এমনকি সম্ভব হলে নিজেকেও।
সেদিন বিকেলে সে সাগর তীরে গেলো। কিন্তু সেখানেও তার কষ্ট কমার চেয়ে বরং বেড়ে গিয়ে হিংসাত্মক রূপ ধারণ করতে লাগলো। তার কাছে মনে হতে লাগলো Nereus এর ক্রন্দনরতা কন্যাগণ বেলাভূমিতে তাদের মাথা আছড়াচ্ছে। সেই শ্রেষ্ঠ এথেন্সবাসীর মৃত্যু ও প্রমত্ত নগরের মূর্খতার কারণে। তরঙ্গেরা শিলাময় সৈকতে ভেঙে পড়ছিলো আর্তনাদের হাহাকার নিয়ে। এই সকল উচ্চকিত ধ্বনি/শব্দমালাকেই তার কাছে মনে হচ্ছিলো কারো অন্ত্যেষ্টি সঙ্গীত।
এক সময়ে সে বেলাভূমি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে উল্টোদিকে যাত্রা শুরু করলো। সামনের কোনোকিছুকে গ্রাহ্য না করেই সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। সক্রেটিসের বেদনার্ত মুখ ছাড়া আর কিছুই তার মনে রইলো না। স্থান, কাল, নিজের অস্তিত্ব বা অহং – সকল কিছুই।
“গতকালও তিনি ছিলেন। গতকাল পর্যন্ত তার মৃদু বচন শোনা গেছে। তাহলে কি করে সম্ভব যে, আজ তিনি নেই? হে নিশীথ, হে কুয়াশায় আচ্ছাদিত দৈত্যকার পর্বতমালা, হে উথলে উঠা সাগর, হে অস্থির বাতাস – যে তুমি বহন করো সীমাহীন পৃথিবীকে নিজের ডানায়, হে মেঘমালা দিয়ে আবৃত নক্ষত্রের আকাশ – আমাকে তোমাদের কাছে নিয়ে যাও, এই মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন করো আমার নিকটে, যদি তোমরা তা জেনে থাকো। আর যদি না জানো, তবে আমার মূর্খ হৃদয়কে তোমাদের বিশাল উদাসীনতা দান কর। আমাকে এই অত্যাচারী প্রশ্নমালা থেকে উদ্ধার কর। উত্তর বা উত্তরের আশা ছাড়া এদের ভার বহন করার সামর্থ আমার নেই। কারণ, সক্রেটিসের ঠোঁট চিরতরে স্তব্ধ হবার ও তাঁর চোখের পাতায় শাশ্বত অন্ধকার নেমে আসার পর কে আর পৃথিবীতে অবশিষ্ট রয়েছেন এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার?”
এভাবেই টেসিপপাস ঘুমকাতর পৃথিবীপৃষ্ঠে ভ্রুক্ষেপহীন ও অদৃশ্যভাবে চিরকাল বয়ে চলা সাগর, পর্বত, এবং রাতের অমানিশার পানে তাকিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। অতঃপর অনেক সময় পেরিয়ে যাবার পর সে উপর পানে তাকালো এবং খেয়াল করে দেখলো অবচেতনের কালে তার পা তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে? একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ভয় তাকে গ্রাস করলো, যখন সে নিজের চারদিকে তাকালো।
(৩)
অনন্ত রাত্রির অজানা দেবতারা অধার্মিক প্রার্থনা শুনেছেন বলে মনে হল। টেসিপপাস চারদিকে তাকাল, কিন্তু কোথায় সে তা বুঝতে পারল না। নগরের বাতিগুলো অনেক পূর্বেই নিভে গিয়েছিল। সমুদ্রের গর্জনও অস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছিল।
Ctesippus এর উদ্বিগ্ন স্বত্বা স্মরণ করতেও সক্ষম হল না যে, আদৌ সে কিছু শুনেছিল কিনা। আসলে কোন শব্দই ছিল না। রাত্রিকালীন কোন পাখির ভয়ার্ত চিৎকার, পালকের শব্দ, গাছের পাতার মর্মর ধ্বনি অথবা ঝর্ণার আনন্দিত কুলু কুলু রব– কোনকিছুই শোনা যাচ্ছিল না। শুধুমাত্র একটা আলেয়ার আলোর শিখা নিঃশব্দভাবে শিলাখন্ডগুলোর উপর দিয়ে উড়াউড়ি করছিল। এদিক-সেদিক। এই ক্ষণস্থায়ী আলোতে অন্ধকার আরও জোরালো হচ্ছিল এবং মৃত মরুভূমির সীমারেখাকে স্পষ্টতর করে তুলছিল। বিসর্পিত কোন সাপের মত।
টেসিপপাসএর মনে হল সমস্ত আনন্দিত দেবতারা এই সবুজ উপবন, ঝর্ণা ও পর্বতের উপত্যকা হতে চিরতরে চলে গেছে। শুধুমাত্র প্রকৃতির বিশৃঙ্খলার মধ্যে একটা রহস্যময় পাতিল কোথাও লুকিয়ে থেকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে একটা ক্ষুদ্র পিঁপড়ার দিয়ে তাকিয়েছিল, যে পিঁপড়া মাত্র কিছুক্ষণ পূর্বে মৃত্যু ও জগতের গোপনীয়তা সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। অন্ধকার অনুভূতিহীন একটা ভয় টেসিপপাস এর আত্নাকে গ্রাস করল। যেমন করে ঝড়ের সময়ে জোয়ারের জল যেমন করে উপকূলের পাথরের উপরে আছড়ে পড়ে।
এটা কি স্বপ্ন না বাস্তব? নাকি অজানা কোন ঐশ্বরিক উদ্ঘাটন? টেসিপপাস এর মনে হল যে, মূহুর্তের ভেতরেই সে জীবনের সীমানা পেরিয়ে এক অনন্ত অবোধ্য ভয়ের সাগরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। কিন্তু সেই মূহুর্তেই সে পরিচিত কিছু শব্দ শুনল এবং বিদ্যুৎ চমকের আলোতে তার চোখ কয়েকটা মানুষের অবয়বকে চিনতে সমর্থ হল।
(৪)
পাহাড়ের ঢালুতে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত একজন মানুষ বসেছিলো। নিজের শরীরের পোষাক দিয়ে তার মস্তক আবৃত। ভূমির দিকে আনত হয়ে ছিলো। কেউ একজন তার দিকে এগিয়ে এলো। মৃদু পদক্ষেপে। খুব সতর্কতার সাথে এই ব্যক্তি উপরের দিকে আরোহণ করছিলো। প্রথম মানুষটি তার মুখমন্ডলকে অনাবৃত করলো এবং বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলোঃ
“এই মূহূর্তে আমি যাকে দেখছি, সে কে? তুমিই কি ভালোমানুষ সক্রেটিস? আমাকে অতিক্রম করে তুমি কোথায় যাচ্ছো? এই নিরানন্দ জায়গায় আমি অপেক্ষা করছি অনেক সময় ধরে। ভোরের আগমণের অপেক্ষায়। কিন্তু এখনো ভোর হচ্ছে না।”
“হ্যাঁ বন্ধু, আমি সক্রেটিস। এবং তুমি কি এলপিডিয়াস নও, যে আমার তিনদিন পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছিলো?”
“হ্যাঁ, আমিই এলপিডিয়াস। এক সময়ের এথেন্সের সবচেয়ে ধনী চর্ম ব্যবসায়ী। অথচ এই মূহূর্তে আমি ক্রীতদাসদের চেয়েও দুর্দশাগ্রস্ত। এই প্রথবারের মতো আমি বুঝতে পারছি কবির কথাগুলো, ‘ক্ষীণালোকিত পাতালপুরীর রাজা হবার চেয়ে পৃথিবীতে দাস হওয়া উত্তম’।”
“তোমার যদি এই জায়গা এতোই খারাপ লেগে থাকে, তাহলে তুমি অন্য কোথাও চলে যাচ্ছো না কেনো?”
“সক্রেটিস, আমি তোমাকে দেখে সত্যিই অবাক হচ্ছি – কিভাবে তুমি এই আনন্দহীন স্থানে বিচরণ করছো? আমি এখানে কষ্ট ও বেদনায় পরিপূর্ণ হয়ে আছি এবং জীবনের অপসৃয়মান আনন্দগুলোর জন্যে ক্রন্দন করছি।”
“বন্ধু এলপিডিয়াস, আমিও তোমার মতো বেদনার্ত হয়ে পড়েছিলাম যখন আমার দৃষ্টি থেকে পার্থিব সকল আলো নিভিয়ে ফেলা হয়েছিলো। কিন্তু আমার ভেতর থেকে কেউ আমাকে বললো,” কোনোরুপ কালবিলম্ব না করে তুমি নতুন পথের অনুসন্ধান করো, এবং আমি অনুসন্ধান শুরু করলাম।”
“কিন্তু কোথায় যাবে, সক্রেটিস? এখানে কোনো পথ নেই, কোনো আলোকরশ্মিও নেই। আছে শুধু অন্ধকার, শিলার গর্জন, কুয়াশা আর বেদনা।”
“সত্য বলেছো এলডিপিয়াস, কিন্তু তুমি কি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছো যে, তোমার বর্তমান পরিস্থিতিতে তোমার জন্যে সবচেয়ে পীড়াদায়ক বিষয়টি কি?”
“নিঃসন্দেহে এই নিরানন্দ, কুৎসিত অন্ধকার।”
“সেক্ষেত্রে তোমার উচিৎ হবে আলোর অনুসন্ধান করা। দৈবাৎভাবে হলেও মৃত মানুষেরা এখানে আলোর উৎস পেয়ে যেতে পারে। তুমি কি মনে করো না যে, অন্ধকারে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে আলোর অনুসন্ধান করা অধিকতর উত্তম? আমি তাই মনে করি। সেকারণেই আমি হাঁটছি। বিদায়, বন্ধু।”
“হে ভালো মানুষ সক্রেটিস, আমাকে ছেড়ে চলে যেয়ো না। তুমি নিশ্চিত পদক্ষেপে এই পথহারা পাতালপুরীর বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছো। আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও।”
“তুমি যদি মনে কর যে, এটা তোমার জন্যে ভালো হবে, তবে আমাকে অনুসরণ করতে পারো।”
এবং অতঃপর দুটো ছায়া সামনের দিকে হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগলো। এই সময়ে টেসিপাসের আত্মা ঘুমের ভেতরে তার পার্থিব শরীর থেকে মুক্ত হয়ে তাদের পেছনে ছুটতে লাগলো। লোভাতুরভাবে সক্রেটিসের পরিষ্কার কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে।
“তুমি কি সাথে আছো, সক্রেটিস?” এলপিডিয়াসের কণ্ঠস্বর পুনরায় শোনা গেলো। “তুমি চুপ করে আছো কেনো? আমি হারকিউলিসের শপথ করে বলছি যে আমি কখনোই এতো ভয়ানক ধরণের পথ অতিক্রম করিনি। তুমি কথা বললে আমাদের পথ সংক্ষিপ্ত হবে।”
“প্রশ্ন করো, বন্ধু এলপিডিয়াস। জ্ঞানের জন্যে প্রশ্ন করলে তা উত্তর বয়ে আনবে এবং আলাপচারিতারও সৃষ্টি করবে। “এলপিডিয়াস কিছুক্ষণের জন্যে নীরব থাকলো এবং নিজের ভাবনাকে গুছিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ ঠিক, এই কথাটাই আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। ওরা কি তোমাকে ভালোভাবে সমাধিস্থ করেছিলো?”
“ আমি দুঃখিত এলপিডিয়াস। তোমার এই ঔৎসুক্যকে নিবারণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
“আমি বুঝতে পারছি, সক্রেটিস যে, এতে তোমার কিছু যায়-আসে না। আমার বিষয়টা আসলেই অন্যরকমের ছিলো। আমি অবাক হই কী অসাধারনভাবেই না তারা আমাকে সমাধিস্থ করেছিলো। আমি এখনো আমার মৃত্যুর পরের সেই আনন্দময় মূহূর্তগুলোকে স্মরণ করি। প্রথমে ওরা আমাকে স্নান করিয়েছিলো। তারপর আমার শরীরে সুগন্ধী আঁতর ছিটিয়ে দিয়েছিলো। এরপর আমার প্রিয়তমা লারিসা আমাকে সবচেয়ে সুন্দর বুননের পোশাক দিয়ে আমার শরীরকে আবৃত করে দিয়েছিলো। নগরের শ্রেষ্ঠ শোক-নারীরা আমার জন্যে তাদের মাথার চুল ছিঁড়েছিলো, কারণ তাদেরকে ভালো পুরষ্কার দেয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছিলো। আমার পারিবারিক সমাধির মধ্যে তারা ব্রোঞ্জের হাতল দিয়ে তৈরি একটা সুন্দর পাত্রও স্থাপন করেছিলো। এছাড়াও তারা রেখেছিলো এক বোতল …”
“থামো এলপিডিয়াস, আমি বুঝতে পেরেছি যে, তোমার বিশ্বস্ত লারিসা তার ভালোবাসাকে অলংকারে রুপান্তরিত করে তোমার সমাধিকে ঐশ্বর্যে পূর্ণ করে দিয়েছিলো। তারপরেও …”
“ঠিক বলেছো। দশটি মূল্যবান অলংকার এবং চারটি রৌপ্যমুদ্রা। এছাড়াও অতিথিদের জন্যে ছিলো বাহারি ধরণের পানীয়। ইতিপূর্বে আমার চেয়ে ঐশ্বর্যশালী কোনো চর্মব্যবসায়ী মৃত্যুর পর এতোটা সম্মান নিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের সামনে হাজির হতে পেরেছিলো বলে আমি কখনোই মনে করি না।”
“বন্ধু এলডিপিয়াস, তুমি কি মনে কর না যে, তোমার অর্থ-সম্পদগুলো এই মূহুর্তে তোমার চেয়ে এথেন্সের গরীব জনগণের জন্যেই বেশী উপকারে আসতো?”
“স্বীকার করি, সক্রেটিস। তবে তুমি আমাকে হিংসা করে কথাগুলো বলছো,” দুঃখিত স্বরে এলডিপিয়াস প্রত্যুত্তর করলো। আমি তোমার জন্যে সত্যিই দুঃখিত সক্রেটিস। আমি বিশ্বাস করি তোমার উপযুক্ত শাস্তিই তুমি পেয়েছো। আমার পরিবারের সদস্যদের আমি তখনই বলেছিলাম যে, তোমার অধার্মিক কাজকর্মের সমাপ্তি হওয়া উচিৎ। কারণ …”
“থামো বন্ধু, আমার ধারণা তুমি সরল পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছো। আসলে তুমি কি বলতে চাচ্ছো?”
“আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমি তোমার জন্যে দুঃখিত। এক মাস পূর্বে জনসমক্ষে আমি তোমার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলাম। কিন্তু আমরা যারা তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলাম তারা কখনোই চাইনি যে তোমার এতো বড় শাস্তি হোক। বিশ্বাস কর, আমি এখনো তোমার জন্যে দুঃখিত, হে অসুখী দার্শনিক।”
“ধন্যবাদ তোমাকে। তবে আমাকে বলতো তোমার চোখে কি কোনো আলো দেখতে পাও?”
“না, বরং আমার চোখের সামনে এতোই আঁধার যে, আমার সন্দেহ হয় এটা জাহান্নামের অন্ধকার কিনা।”
“তার মানে হলো এই পথ আমার জন্যে যতটা অন্ধকার, তোমার জন্যেও তাই।”
“সম্পূর্ণ সঠিক।”
“ আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে তুমি আমার পরিচ্ছদের কাপড় ধরে আছো।”
“সত্য।”
“তাহলে তুমি আর আমি একই স্থানে অবস্থান করছি, তাই না ? দ্যাখো, তোমার পূর্বপুরুষেরা কেউই তোমার আড়ম্বরপূর্ণ সমাধিকর্মের গল্প নিয়ে আনন্দিত ভাব প্রদর্শন করছে না। তাহলে তোমার আর আমার ভেতরে পার্থক্য কি বন্ধু?”
“কিন্তু সক্রেটিস, ঈশ্বরগণ কি তোমার বিচার-বিবেচনার বোধকে এতোটাই লুপ্ত করে দিয়েছেন যে, তোমার আর আমার ভেতরের পার্থক্যকে তুমি বুঝতে পারছো না?”
“বন্ধু, পরিস্থিতি যদি তোমার কাছে স্পষ্ট হয়ে থাকে তবে তুমি সামনে আসো এবং এই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের ভেতরে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও।”
“উপহাস করা বন্ধ কর, সক্রেটিস। আমার সাথে কৌতুক করো না এবং আমার মতো নিজের বিছানায় মৃত্যুবরণকারী কারো সঙ্গে নিজেকে তুলনা করো না।”
“আমার ধারণা আমি তোমাকে বুঝতে শুরু করেছি। কিন্তু আমাকে বল এলডিপিয়াস যে, তুমি কি এখনো তোমার বিছানায় শুয়ে আনন্দফুর্তি করার চিন্তা কর?”
“না, করি না।“
“এমন কি কখনো হয়েছে যে, তুমি তোমার বিছানায় ঘুমাওনি?”
“হয়েছে, যেবারে আমি এজিসিলিয়াস থেকে অর্ধেক মূল্যে জিনিস কিনেছিলাম। তুমি তো জানো এজিসিলিয়াস একজন বড় ধরণের দুর্বৃত্ত…”
“আমার ধারণা এজিসিলিয়াস তোমার জিনিসগুলো এক চতুর্থাংশ মূল্যে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। কাজেই এটা কি সত্য নয় যে, তুমি জীবনের একটা খন্ড অংশ মাত্র বিছানার মালিক ছিলে?”
“তুমি সঠিক বলেছো।“
“আমারো একটা বিছানা ছিলো, যেটায় শুয়ে আমি মৃত্যুবরণ করেছিলাম। জেলখানার প্রহরী প্রোটিয়াস আমাকে সেটা ধার দিয়েছিলো কিছুদিনের জন্যে।“
“আমি যদি জানতাম যে, তোমার কথাবার্তার মধ্য দিয়ে তোমার কি উদ্দেশ্য তুমি পূরণ করছো, তাহলে তোমার এই অসংলগ্ন প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি কখনোই দিতাম না। এই ধরণের অশ্রদ্ধা আমি কখনোই দেখি নাই। তুমি নিজেকে আমার সাথে তুলনা করছো। আমি যদি বুঝতে পারতাম, তবে মাত্র একটা শব্দ দিয়ে তোমার সাথে সকল আলাপচারিতা শেষ করে দিতাম।“
“বলো, এলডিপিয়াস। তোমার কথা কোনোভাবেই হেমলকের চেয়ে বেশী বিধ্বংসী হবে না।“
“এটাই আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম যে, তুমি একজন অভাগা ব্যক্তি। তোমাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে আদালতের নির্দেশে এবং হেমলক পান করে।“
“আমি তো এটা আমার মৃত্যুর দিন থেকেই জানি। এমনকি তারও অনেক পূর্ব হতে। কিন্তু তুমি আসলেই ভাগ্যহীন এলপিডিয়াস। বলো তো কি কারণে তোমার মৃত্যু হয়েছিলো?”
“ ওহ, আমার মৃত্যু হয়েছিলো তোমার মৃত্যুর চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। তুমি হয়তো জানো যে আমার শোথ রোগ (যে রোগে জলীয় পদার্থ জমে শরীরের কোনো অংশ ফুলে ওঠে।) হয়েছিলো। ‘করিন্থ’ থেকে একজন নামী চিকিৎসককে ডাকা হয়েছিলো, যে দুই ‘মিনা’ অর্থের বিনিময়ে আমাকে রোগমুক্ত করে দেবে বলে বলেছিলো। ঐ অর্থের অর্ধেকটাই আমি তাকে অগ্রিম হিসেবে দিয়েছিলাম। আমার ধারণা ‘লারিসা’ তার অভিজ্ঞতার কারণে বাকী অর্ধেকটাও তাকে দিয়ে দিয়েছিলো…”
“তার মানে হলো যে, চিকিৎসক তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেননি।“
“ঠিক।“
“তুমি কি শোথ রোগেই মৃত্যুবরণ করেছিলে?”
“ বিশ্বাস কর, সক্রেটিস, তিন তিনবার এই রোগ আমাকে পরাস্ত করতে চেয়েছিলো এবং শেষ পর্যন্ত আমার জীবন প্রদীপকেই নিভিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে।“
“তাহলে আমাকে বল – শোথ রোগের মৃত্যু কি তোমাকে আনন্দ দিয়েছিলো?”
“ধূর্ত সক্রেটিস, আমাকে নিয়ে কৌতুক করো না। আমি তোমাকে বলেছি যে, সেটা আমাকে তিনবার পরাজিত করতে চেয়েছিলো। আমি এতোটাই অতিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম যে, আমি দেবতার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যাতে যথাশীঘ্র সম্ভব আমাকে মৃত্যু দেয়া হয়।
“আমি অবাক হচ্ছি না। কিন্তু তোমার কথা থেকে আমি কি উপসংহারে আসতে পারি যে, শোথ রোগে মৃত্যু হেমলক পান করে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে আনন্দময় ছিলো?”
“তুমি দেখি আবার আমাকে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে দিয়েছো। তোমার মতো পবিত্র প্রথা বিনষ্টকারীর সাথে কথা বলে আমি আর দেবতাগণকে রুষ্ট করতে চাই না।“
অতঃপর দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে গেলো। কিন্তু একটু পরেই এলপিডিয়াস পুনরায় আলাপচারিতা শুরু করলো।
“চুপ করে আছো কেন হে ভালো মানুষ সক্রেটিস?”
“বন্ধু, তুমিই কি চাওনি যে আমি চুপ করে থাকি?”
“আমি কোনো অহংকারী মানুষ নই, এবং যারা আমার চেয়েও খারাপ মানুষ তাদের সাথেও ভালো আচরণ করতে সক্ষম। আসো, আমরা বিবাদে লিপ্ত না হই।“
“আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করিনি, বন্ধু এলপিডিয়াস এবং এমন কিছুই বলতে চাইনি যা তোমাকে অপমানিত করতে পারে। আমি শুধু তুলনার মধ্য দিয়ে সত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করছিলাম। যেহেতু আমার নিজের পরিস্থিতি আমার কাছে স্পষ্ট নয়, সেহেতু তোমার পরিস্থিতিটা কিভাবে অধিকতর ভালো তা আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। এটা করতে গিয়ে যদি কোনো সত্য বেরিয়ে আসে, তা নিয়ে তোমার কষ্ট পাবার কিছুই নেই।“
“ঠিক আছে। এবিষয়ে আর নয়।“
“তুমি কি ভয় পাচ্ছ, এলপিডিয়াস? আমি মনে করি না আমার ভেতরের এই মূহূর্তের অনুভূতিকে ভয় হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।“
“যদিও দেবতাদের কোপানলে পড়ার সম্ভাবনা তোমার চেয়ে আমার কম, তথাপিও আমি ভয় পাচ্ছি। কিন্তু তুমি কি মনে কর না যে, এই বিশৃঙ্খল অবস্থার ভেতরে আমাদেরকে পরিত্যাগ করে দেবতাগণ আমাদেরকে আশাহত করার মধ্য দিয়ে আমাদের সাথে প্রতারণা করেছেন?”
“সেটা নির্ভর করে সেই আশাটা কেমন ছিলো তার উপরে। তুমি দেবতাগণের নিকট থেকে কি আশা করেছিলে, এলপিডিয়াস?”
“আমি দেবতাদের কাছ থেকে কি আশা করেছিলাম? কি অদ্ভূত সব প্রশ্ন কর তুমি সক্রেটিস? একজন মানুষ যদি সারা জীবন ধরে পুজা-অর্চনা করে এবং ধার্মিক হৃদয় নিয়ে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে ঈশ্বরদের কি উচিৎ নয় তাকে সম্ভাষণ করে নিয়ে আসার জন্যে কাউকে প্রেরণ করা? অন্তত পক্ষে একজনকে তো পাঠানো উচিৎ যে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। এখন আমার মনে পড়ছে জীবনে কতবারই না আমি নিভৃতে বা জনাকীর্ণস্থানে দেবতাদের কাছে উত্তম ভাগ্যের জন্যে প্রার্থণা করেছিলাম, এমনকি পশু বলিও দিয়েছিলাম……”
“কিন্তু সৌভাগ্য তোমার কাছে আসেনি, তাই তো?”
“ঠিক বলেছো সক্রেটিস। আমি ভাগ্যবান ছিলাম, কিন্তু সৌভাগ্য…”
“আমি বুঝতে পেরেছি, তোমার কাছে কোনো বলির পশু ছিলো না।“
“কি গাধার মতো কথা বলছো, সক্রেটিস? আমি ছিলাম একজন ধনী চর্মব্যবসায়ী। আর আমার কাছে বলির পশু থাকবে না?”
“আমি এখন বুঝতে পারছি। তুমি ভাগ্যবান ছিলে। তোমার কাছে বলির পশু ছিলো, কিন্তু সেগুলোকে তুমি নিজের জন্যে রেখে দিয়েছিলে। ফলে দেবতারা কিছুই পাননি।“
“এর আগেও আমি বলেছি যে, তুমি খুবই চালাক মানুষ। মৃত্যুর পূর্বে দেবতাদের কাছে আমার করা দশটা উৎসর্গের প্রতিজ্ঞার মধ্যে তিনটা পালন করে এসেছিলাম। তুমিও সম্ভবত তাই করেছো। এবং সম্ভবত সেকারণেই দেবতারা আমাদের দুজনকেই পরিত্যাগ করেছেন। আমি লারিসাকে বলে এসেছিলাম যে, আমার মৃত্যুর পর আমার সকল পশুগুলোকেই যেনো দেবতাদের নামে উৎসর্গ করা হয়।“
“ওটা তো লারিসার ব্যাপার যে সে তা পালন করেছে কি করে নাই। কিন্তু বন্ধু এলপিডিয়াস, লারিসা তো প্রতিজ্ঞা করেনি। প্রতিজ্ঞা করেছিলে তুমি।“
“সত্য বলেছো সক্রেটিস। কিন্তু তুমি আর আমি কি এক হলাম? ঈশ্বরহীন তোমার সঙ্গে কি ঈশ্বরের ভয়ে ভীত আমার মতো চর্মব্যবসায়ীর তুলনা চলে?”
“ প্রিয় বন্ধু, আমি জানি না যে, আমাদের ভেতরে কে দেবতাদের সাথে বেশী অসদাচরণ করেছে। প্রথমতো আমি প্রতিজ্ঞা করা ছাড়াই ঈশ্বরের জন্যে অর্ঘ নিয়ে এসেছিলাম। কাজেই ঈশ্বরদের নিকটে আমাকে প্রতিজ্ঞাও ভাঙতে হয়নি, বলির পশুও দিতে হয়নি।“
“কি বললে? একটা বলির পশুও তুমি উৎসর্গ করোনি?”
“ঠিক বন্ধু, ঈশ্বরকে যদি আমার উৎসর্গ করা পশুর খেয়ে বাঁচতে হয়, তাহলে আমি নিশ্চিত যে তিনি খুবই কৃশকায় হয়ে পড়তেন।“
“বুঝতে পেরেছি। তোমার যেহেতু কখনোই পশু ছিলো না, সেহেতু দেবতাদেরকে তুমি অন্য কিছু উৎসর্গ করেছিলে। সম্ভবত কিছু মিনা, যা তোমার শিষ্যরা তোমাকে দিয়েছিলো।“
“তুমি তো জানো যে, শিষ্যদের কাছ থেকে আমি কিছুই নিতাম না, এবং আমি যা করতাম তা দিয়ে আমার জীবন ধারণ করাই কঠিন ছিলো। আমি নিশ্চিত যে, দেবতারা যদি আমার খাবারের অবশিষ্টাংশ নিতে চাইতেন, তাহলে তারা খুবই ভুল করতেন।“
“ হে অভিশপ্ত মানুষ, তোমার ভক্তির সাথে তুলনা করে আমি অহংকার বোধ করছি। হে ঈশ্বরেরা, এই মানুষের কান্ড দ্যাখো। কিছু কিছু সময়ে আমি তোমাদের সাথে প্রতারণা করেছি সত্য, কিন্তু জীবিত অবস্থায় এবং মৃত্যুর পরেও আমি আমার ভাগ্যকে তোমাদের সাথে ভাগ করে নেয়ার চেষ্টা করেছি। যে তোমাদের নিকটে উৎসর্গ করেছে, সে কি কখনো এই অভিশপ্ত লোকের সাথে তুলনীয় হতে পারে, যা কিছুই দেয়নি? সক্রেটিস, আমার ভয় হচ্ছে যে, তোমার সাথে অবস্থানের কারণেই দেবতাদের নিকটে আমার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। “
“ তোমার যা ইচ্ছে, তাই করতে পার এলপিডিয়াস। আমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি যে, আমি তোমাকে আমার সঙ্গী হতে অনুরোধ করিনি। আমার কাপড় ছাড় এবং বিদায়। আমি একাই এগিয়ে যাবো।“
এবং সক্রেটিস নিশ্চিত পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রতিটি পদক্ষেপে ভূমিকে অনুভব করতে করতে।
কিন্তু এলপিডিয়াস তাৎক্ষণিকভাবে চিৎকার করে উঠলোঃ
“অপেক্ষা কর, অপেক্ষা কর, আমার ভালো নাগরিক। এ রকমের একটা ভয়ানক জায়গায় একজন এথেনিয়ানকে ছেড়ে যেয়ো না। আমি শুধুই কৌতুক করছিলাম। আমি অবাক হই ভেবে যে, তুমি কিভাবে এই নারকীয় অন্ধকারের ভেতরে দেখতে সক্ষম হচ্ছো।“
“আমার চোখকে আমি অন্ধকারের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি, বন্ধু।“
“ভালো, কিন্তু তারপরেও আমি দেবতাদেরকে কিছুই তোমার কিছুই উৎসর্গ না করার বিষয়টি মেনে নিতে পারছি না। আমি নিশ্চিত যে, তোমার মরহুম পিতা তোমার যৌবনে তোমাকে অনেক ভালোকিছু শিখিয়েছিলেন এবং প্রার্থনাকর্মে তোমাকে আমি অংশগ্রহণ করতে দেখেছি।“
“হ্যাঁ, সকল সময়েই আমি আমাদের সকল উদ্দেশ্যগুলোকে নিরীক্ষা করে দেখি এবং যেগুলোকে যৌক্তিক মনে হয় শুধু সেগুলোকেই গ্রহণ করে থাকি। এবং একদিন আমি আমাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ সক্রেটিস তুমি তো অলিম্পাসের দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে থাকো। কেনো তুমি এই প্রার্থনা করছো?’”
এলপিডিয়াস অট্টহাসি দিলো।
“আসলেই তোমরা দার্শনিকরা অনেক সময়েই সহজ প্রশ্নের উত্তরও জান না। অথচ দ্যাখো, একজন সাধারণ চর্মব্যবসায়ী হয়েও এবং দর্শনশাস্ত্র সম্পর্কে কিছুই না পড়েও আমি জানি যে কীভাবে অলিম্পাসের দেবতাদের সম্মান জানাতে হয়।“
“তাহলে খুব তাড়াতাড়ি আমাকে বল, কেন তুমি এটা কর? “
“কেন? হা ! হা ! জ্ঞানী সক্রেটিস।“
“সহজ হলে তো আরো ভালো, কিন্তু তোমার তোমার অভিজ্ঞানকে শুধু নিজের কাছে ধরে রেখো না। বল আমাকে- কেন তুমি দেবতাদেরকে সম্মান কর?”
“কেন আবার ? প্রত্যেকেই করে, তাই আমিও করি।“
“বন্ধু, তুমি খুব ভালো করেই জান যে, প্রত্যেকেই দেবতাদেরকে সম্মান করে না। এটা কি বলা উচিৎ নয় যে, ‘অনেকেই’ করে।“
“ঠিক আছে, অনেকেই।“
“কিন্তু আমাকে বলো, বেশীর মানুষই কি ভালো মানুষদের চেয়ে খারাপ মানুষদের সংস্পর্শে আসে না?”
“ঠিক, পৃথিবীতে ভালো মানুষদের চেয়ে খারাপ মানুষদের সংখ্যাই বেশী।“
“সুতরাং অধিকাংশ মানুষকে যদি তুমি অনুসরণ করে থাকো, তাহলে আসলে তুমি খারাপ মানুষদেরকেই অনুসরণ করছো। তাই নয় কি?”
“কি বলছো, তুমি?”
“আমি বলছিনা, তুমিই বলছো। কিন্তু আমি মনে করি যে কারণে মানুষেরা অলিম্পাসের দেবতাদেরকে সম্মান করে থাকে, তা এই জন্যে নয় যে বেশীর ভাগ মানুষ তা করে থাকে। আমাদের আরো যৌক্তিক কারণ দরকার। আমার ধারণা তুমি বলতে চেয়েছো যে, তারা সম্মান পাওয়ার যোগ্য।“
“ঠিক, আমি তাই বলতে চেয়েছি।“
“ভালো, সেক্ষেত্রে একটা নতুন প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারেঃ তারা কেন সম্মান পাওয়ার জন্যে যোগ্য?”
“ কারণ তারা বিশাল বা মহান।“
“ হ্যাঁ, এটার সম্ভাবনাই বেশী। আমার মনে হচ্ছে খুব সত্বরই আমি তোমার সাথে একমত হব। আমাকে তুমি শধু বল মহান বলতে আমরা কি বুঝে থাকি। এটা একটা কঠিন প্রশ্ন, তাই নয় কি? এক্ষেত্রে আস, আমরা দুজনে মিলে এর উত্তর খুঁজি। মহাকবি হোমার বলেছেন যে, দেবী পালাস এথিনার ছুঁড়ে দেওয়া প্রস্তর খন্ডের আঘাতে দেবতা এরিস ভূমিতে শুয়ে পড়েছিলেন। তখন তার শরীরের ক্ষেত্রফল এতোই প্রসারিত হয়েছিলো যে, সাত রাত সাতদিনেও হেঁটে তা অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না। তাহলে ধারণা কর, কী বিশাল জায়গা ছিল তা।“
“এটাকে কি বিশাল বলা যাবে?”
“সেক্ষেত্রে আরেকটা প্রশ্ন ঊঠে। তোমার কি ক্রীড়াবিদ থিওফানটেস এর কথা মনে আছে? সে একজন দন্ডায়মান জীবন্ত মানুষের মাথার উপরে সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো। একইভাবে পেরিক্লিস (এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক যিনি এথেন্সকে গ্রীসের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন) তোমার আমার কারো চেয়েই বড় ছিল না। এই তিনজনের মধ্যে কাকে তুমি বিশাল বলবে?”
“ঠিক, আমি বুঝতে পারছি যে, বিশালতা শুধুমাত্র শরীরের আয়তনের উপরে নির্ভর করে না। সম্ভবত বিশালতা বলতে গুণকেই বোঝায়।“
“অবশ্যই।“
“আমিও তাই ভাবি।“
“সুতরাং কার নিকটে আমাদের আনত হওয়া উচিৎ? বড়দের সামনে ছোটদের, নাকি দুষ্টদের সামনে গুণীদের?”
“উত্তরটা এখন আমার কাছে স্পষ্ট।“
“আমার কাছেও তাই মনে হয়। এখন আমরা তাই বিষয়টাকে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখবো। এলপিডিয়াস, আমাকে সত্য করে একটা কথা বলত, তুমি কি ধনুক ছুঁড়ে কারো শিশু সন্তানকে হত্যা করেছো কখনো?”
“কখনোই না। তুমি কি আমাকে এতোটাই খারাপ মনে কর?”
“আমি বিশ্বাস করি যে, তুমি কর নাই। তবে তুমি কি কখনো অন্য মানুষের স্ত্রীকে প্রলুব্ধ করেছো?”
“আমি একজন সোজাসাপ্টা চর্মব্যবসায়ী এবং ভালো স্বামী ছিলাম। তুমি কি তা ভুলে গেছো নাকি, সক্রেটিস?”
“তুমি কখনোই তেমন ছিলে না। আমার জানামতে এমনকি তুমি তোমার বিশ্বস্ত লারিসার সাথে প্রতারণাও করনি, যার কারণে সে কোন নারী বা শিশুর উপরে প্রতিশোধ নিতে পারে।“
“সত্যিকারভাবেই তুমি আমাকে ক্ষেপিয়ে দিচ্ছো, সক্রেটিস।“
“কিন্তু তুমি সম্ভবত তোমার পিতার কাছ থেকে জোর করে সম্পদ কেড়ে নিয়ে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলে।“
“কখনই না। তুমি আমাকে এধরণের অপমানজনক প্রশ্ন করছ কেন?”
“অপেক্ষা কর, বন্ধু। সম্ভবত আমরা দুজনে মিলেই একটা উপসংহারে পৌঁছতে সক্ষম হব। বল, তুমি কি এই ধরণের কোন মানুষকে মহান বলে ভাবতে পারতে, যাদের সম্পর্কে আমি এখন বললাম?”
“না, কখনই না। এদেরকে আমি বদমাশ বলেই ডাকতাম এবং তাদের বিরুদ্ধে নালিশ করতাম যাতে জনসমক্ষে তাদের বিচার করা হয়।“
“ঠিক আছে, এলপিডিয়াস, সেক্ষেত্রে তুমি কেন দেবতা জিয়ুস এবং অলিম্পাসের অন্য দেবতাদের বিরুদ্ধে কেন অভিযোগ আননি? ক্রোনসের পুত্র তার পিতার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেছিল এবং মানব কন্যাদের জন্যে তার ছিল তীব্র পাশবিক কামনা। দেবী হেরা প্রতিশোধ নিয়েছিলেন নির্দোষ কুমারীদের উপরে। ক্রোনসের পুত্র ও হেরা, দুজনে মিলে কি ইনাচোসের অসুখী মেয়েটিকে কি গরুতে পরিণত করেনি? এপোলো কি তার তীরের আঘাতে নিবোর সন্তানদের হত্যা করেনি? ক্যালিনাস কি ষাঁড় চুরি করেনি? তাহলে এলপিডিয়াস, যদি এটাই হয় যে, যাদের কম গুণ আছে তারা অধিকতর বেশী গুণীদেরকে সম্মান করবে, সেক্ষেত্রে তোমার পরিবর্তে অলিম্পাসের দেবতাদেরই কি উচিৎ ছিল না তোমাকে পূজা করার?”
“অভিশপ্ত আচরণ কর না, সক্রেটিস! চুপ থাক। কী দুঃসাহস তোমার যে তুমি দেবতাদের কাজকে বিচার কর?”
“বন্ধু, আমি নই, উচ্চতর কোন শক্তি তাদের বিচার করেছে। এসো, আমরা আমাদের প্রশ্নগুলো নিরীক্ষা করি। দেবত্ব বলতে আমরা কি বুঝে থাকি? আমার মনে হয় তুমি বলেছ যে, মহত্ত্ব বা বিশালতা গুণ দিয়ে দেবত্ব তৈরী। এবং এটাই সেই বিশালতা, যা মানুষকে স্বর্গীয় আলোতে উদ্ভাসিত করে। কিন্তু আমরা যদি মানুষের ক্ষুদ্র বিচারগুণ দিয়েই বুঝতে পারি যে, বিচারকরা যারা দেবতাদেরকে বিচার করছে তারাই দেবতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর, তবে এর অর্থ কি এই নয় যে, আমাদের চেয়েও দেবতারা খারাপ? এবং তারাই দোষী বা নিম্নতর গুণের অধিকারী। তাহলে ……”
“তাহলে কি?”
“তাহলে আমার মতে তারা দেবতা নন, দেবতাদের ভ্রান্তিকর কোন অপচ্ছায়া মাত্র। যাদেরকে আমরা আমাদের স্বপ্নের মধ্যে তৈরী করেছি। তাই নয় কি, বন্ধু?“
“বুঝতে পেরেছি পাদুকাহীন দার্শনিক! কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে তুমি এখানেই আসতে চেয়েছিলে। আমি এখন নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছি যে, লোকে তোমার সম্পর্কে যা বলতো, তা মিথ্যে ছিল না। তুমি হচ্ছ সেই মাছ, যে তার দৃষ্টি দিয়ে মানুষকে বন্দী করে ফেলে এবং তারপর আত্মার ভেতরে অবিশ্বাস ঢুকিয়ে দেয়। ইতিমধ্যেই তুমি দেবতা জিয়ুসের প্রতি আমার বিশ্বাসকে টলানোর চেষ্টা করেছ। আমি আর তোমার প্রশ্নের একটাও উত্তর দেব না। ইচ্ছে হলে তুমি নিজে নিজে কথা বলতে পারো।“
“ক্রুদ্ধ হয়ো না, এলপিডিয়াস। আমি তোমার ভেতরে কোন পাপাচার ঢোকানোর চেষ্টা করছি না। কিন্তু তুমি যদি আমার সাথে যৌক্তিক উপসংহারে পৌঁছতে ক্লান্তি বোধ করে থাক, তাহলে আমি এক মাইলেশিয়ান যুবকের একটা রুপক গল্প তোমাকে শোনাতে চাই। আমার ধারণা রুপক মানুষের মনকে শান্ত করে এবং তা আমাদের অন্তরের জন্যে ক্ষতিকারক নয়।“
“যদি তোমার গল্প খুব দীর্ঘ এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়ে থাকে, তাহলে তা তুমি আমাকে শোনাতে পার।“
“উদ্দেশ্য একটাই, বন্ধু এলপিডিয়াস, সত্যের অনুসন্ধান। আমি তোমাকে সংক্ষেপে গল্পটা শোনাব। অনেক অনেক দিন পূর্বে, বলতে পার প্রাচীনকালে মিলেটাস নামের দেশটা অসভ্য মানুষদের আক্রমণের মুখে পড়েছিল। তারা সাম্রাজ্যের সবচেয়ে জ্ঞানী ও উত্তম একজন ব্যক্তির যুবক সন্তানকে ধরে করে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পথিমধ্যে যুবকটি খুবই অসুস্থ ও অজ্ঞান হয়ে পড়লে সেই বর্বর মানুষেরা তাকে তারা মূল্যহীন লুটের মালের মত ফেলে দিয়ে চলে চলে যায়। গভীর রাতে যুবকটির জ্ঞান ফিরে। সে দেখতে পায় যে, কোন এক মরুভূমির শেষ প্রান্তে শুয়ে আছে। তার উপরে জ্বলজ্বল করছে রাতের তারারা। দূর থেকে কিছু শিকারী পশুর গর্জন ভেসে আসছে। এবং সেই বিশাল প্রান্তরের ভেতরে যুবক শুধুই একা।
“যুবকটি তার বিগত জীবনের সকল স্মৃতিই বিস্মৃত হয়েছিল এবং বৃথাই সে অন্তহীন অন্ধকার ও শূন্য মরুভূমির ভেতরে সেগুলোকে মনে করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এটা করতে যেয়ে দূরে কোথাও তার কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্ট চেতনার মধ্যে তার উত্তম চরিত্রের পিতা ও হারিয়ে যাওয়া বাড়ির দৃশ্যকে অনুভব করতে লাগল। এমনকি এক সময়ে তার হৃদয়ের ভেতর থেকে অস্পষ্টভাবে ‘পিতা’ শব্দটি উচ্চারিত হল। তোমার কি মনে হয় না যে, যুবকটির ভাগ্য মানব জাতির অদৃষ্টের মতো?”
“কিভাবে?”
“আমরা কি সারাজীবন পৃথিবীতে অন্য কোন জগতের স্মৃতি নিয়ে জেগে থাকি না? এবং আমাদের আত্মার সামনে কি সেই অজ্ঞাত জগতের দৃশ্যপট ঘুরতে থাকে না?”
“বলে যাও, সক্রেটিস, আমি শুনছি।“
“যুবক পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং সতর্ক পদক্ষেপে সামনের দিকে এগুতে লাগলো, বিপদকে এড়ানোর জন্যে। দীর্ঘ সময় ধরে হেঁটে বেড়ানোর কারণে এক সময়ে তার প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল এবং সে দূরে অন্ধকারের ভেতরে একটা আগুনের আলো দেখতে পেল, যা অন্ধকার ও শীতলতাকে দূরীভূত করেছিল। এই সময়েই একটা অস্পষ্ট আশা তার উদ্বিগ্ন অন্তরের ভেতরে প্রবেশ করলো এবং পিতা ও বাসস্থানের স্মৃতি তার হৃদয়ের ভেতরে জেগে উঠল। এমতাবস্থায়, যুবক আলোর দিকে হেঁটে গেল, এবং চিৎকার করে বলে উঠলো, “এটা তো তুমিই পিতা, তুমিই!”
“ওটা কি আসলেই তার পিতার বাসস্থান ছিল?”
“না, ওটা ছিল বেদুঈনদের রাত্রিকালীন থাকার জায়গা। সুতরাং তাদের কাছে ধরা পড়ার পর আরো অনেক বছর তাকে বন্দী দাস হিসেবে জীবন অতিবাহিত করতে হল। মৃৎশিল্পের কারিগর হিসেবে। এই দীর্ঘ সময়কালে যুবক শুধুমাত্র স্বপ্নের ভেতরেই তার দূরবর্তী বাসস্থান ও পিতার স্নেহময় কোলকে দেখতে পারতো। অনেক সময়ে সে তার কল্পনার ভেতরে উড়তে থাকা কিছু মুখ বা অবয়বকেও কাদামাটি, কাঠ বা পাথরের ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনার চেষ্টা করত। এমনকি কখন কখন সে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠত এবং নিজের করা মৃৎশিল্পগুলোকে আলিঙ্গন করে কান্নাকাটি করত। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার চোখের জলে সেগুলো ভিজে যেত। কিন্তু পাথরগুলো কঠিন পাথরই রয়ে যেত। এভাবেই বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার স্বপ্নগুলোও ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছিল। অবশেষে ভাগ্য তাকে একজন ভাল বর্বর মানুষের ক্রীতদাস বানিয়ে দিল। সে তাকে একদিন তার অনবরত কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করল। যুবক তখন তার নিকটে পিতা ও তার বাসস্থান সম্পর্কে তার স্বপ্ন ও নিজের আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ করল। অসভ্য হলেও মানুষটা জ্ঞানী ছিল। সে যুবকটিকে বললঃ
“আমি জানি না যে মানুষ ও দেশ সম্পর্কে তুমি বলছ, তা আদৌ পৃথিবীতে আছে কিনা। তবে তুমি যদি সেখানে পৌঁছতে পার, তাহলেও তুমি তোমার পিতাকে কিভাবে চিনবে?”
“’সেই দেশে’ যুবক উত্তর দিল, ‘ সেই দেশে সকলেই জ্ঞান ও গুণকে সম্মান করে এবং আমার পিতাকে তাদের নেতা বলে মনে করে।‘
“’ ঠিক আছে,’ বর্বর লোকটি উত্তর দিল, ‘সেক্ষেত্রে আমি নিশ্চিত যে তোমার পিতার শিক্ষার সারবস্তু তোমার ভেতরে সুপ্ত অবস্থায় রয়ে গেছে। কাজেই আমি তোমাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। তুমি পর্যটকের পোষাক পরে তাকে অনুসন্ধান করতে বের হয়ে যেতে পার। শুধু একটা উপদেশ, সত্যিকারের জ্ঞানকে অনুসন্ধান করবে এবং যখন তুমি তাদের সন্ধান পাবে, তখন তুমি পর্যটকের পোষাক পরিত্যাগ করবে। আমার বিশ্বাস ওখানেই তুমি তোমার পিতা ও বাসস্থানকে খুঁজে পাবে।‘
“এবং যুবক দিনের শেষে পথে নামল……”
“যাদেরকে অনুসন্ধান করছিল, তাদেরকে কি সে পেয়েছিল?”
“সে এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছে। অনেক দেশ, অনেক নগর এবং অনেক মানুষদেরকে সে দেখেছে। বিভিন্ন দেশের সকল পথকে সে চিনেছে; উত্তাল সাগরকে পরিভ্রমণ করেছে; আকাশের তারাদের গতিপথ অনুসরণ করে কীভাবে তীর্থযাত্রীরা অন্তহীন মরুভূমিকে অতিক্রম করে থাকে, তাও সে জেনেছে। প্রতিবার ভ্রমণেই ক্লান্তিকর পথের শেষে অন্ধকারের ভেতরে তার চোখের সামনে একটা অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে এবং দ্রুত তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। সাথে সাথে আশা তার অন্তরের ভেতরে এসে ভর করে। ‘ওটাই আমার পিতার অতিথিপরায়ণ বাসস্থান,’ সে চিন্তা করে।
“এবং যখনই কোন অতিথিপরায়ণ আমন্ত্রণকারী এই ক্লান্ত ভ্রমণকারীকে সম্ভাষণ করত এবং তাকে তার ঘরের আশ্রয় দিত, তখন যুবক তার পায়ে পড়ত এবং আবেগপূর্ণভাবে তাকে বলতঃ ‘ ধন্যবাদ, পিতা। আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া সন্তান। তুমি কি আমাকে চিনতে পারনি?”
“অনেকেই প্রস্তুত ছিল তাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করার জন্যে। কারণ, সেটা ছিল এমন সময় যখন প্রায়শই শিশুদেরকে অপহরণ করা হত। কিন্তু তাদের প্রাথমিক উদ্দীপনার ঝলক কেটে যাবার পর যুবক তাদের মধ্যে অসম্পূর্ণতা, এমনকি ধূর্ততাও আবিষ্কার করত। তখন সে আমন্ত্রকারীকে বিচার ও অবিচার বিষয়ে প্রশ্ন করে তদন্ত ও নিরীক্ষা করে দেখত, এবং অতিসত্বরই পুনরায় ক্লান্তিকর পথে তার ভ্রমণ শুরু হত। অনেকবারই সে নিজেকে বলেছে,’এই বাসস্থানেই আমার ভ্রমণ শেষ হবে, এখানেই আমার বিশ্বাস টিকে যাবে। এটাই হবে আমার পিতার বাসস্থান।‘
“তুমি জান, সক্রেটিস যে সেটা মেনে নেয়াই তার জন্যে সবচেয়ে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হত।“
“ হ্যাঁ, এভাবেও সে কোন কোন সময়ে চিন্তা করত। কিন্তু তদন্ত/নিরীক্ষা করার অভ্যাস ও পিতাকে নিয়ে তার বিভ্রান্তিকর স্বপ্ন তাকে শান্তি পেতে দিত না। বারংবার সে পদধূলি সরিয়ে স্থিত হতে চাইলেও বারংবারই তাকে ভ্রমণকারীর পরিচ্ছদ পরিধান করতে হয়েছিল। ফলে প্রায় প্রতিটা ঝড়ের রাতেই তাকে আশ্রয়হীন থাকতে হয়েছিল। তোমার কি মনে হয় না যে, এই যুবকের ভাগ্যের সাথে মানবজাতির ভাগ্যের অভূতপূর্বে মিল রয়েছে?”
“কেন?”
“মানবজাতির সদস্যরা কি অজানাকে জানার সময়ে এই ধরণের শিশুসুলভ পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে না? তারা কি কাঠ, পাথর, প্রথা ও ঐতিহ্য দিয়ে তাদের স্রষ্টাকে বিনির্মাণ করার চেষ্টা করে না? কিন্তু যখন তারা তাদের সৃষ্ট আকৃতিকে অপূর্ণ হিসেবে দেখতে পায়, তখন কি তারা সেগুলোকে ধ্বংস করে দেয় না? এবং অতঃপর কি তারা পুনরায় সন্দেহের মরুভূমিতে বিচরণ করে না? অনুসন্ধানের প্রকৃত উদ্দেশ্যই হচ্ছে অধিকতর ভাল বস্তুর খোঁজ করা …”
“হে চতুর ঋষি, আমি এখ বুঝতে পারছি তোমার রুপক গল্প বলার উদ্দেশ্য! আমি তোমার মুখের উপরে বলতে চাই যে, এই অন্ধকারের ভেতরে একটা আলোর রশ্মিও যদি প্রবেশ করত, আমি ঈশ্বরকে এই ধরণের অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে বিব্রত করতাম না।‘
“বন্ধু, আলো কিন্তু ইতিমধ্যেই জ্বলা শুরু করেছে,” সক্রেটিস জবাব দিল।
(৫)
দার্শনিকের কথা ফলে যাচ্ছে বলে মনে হল। আকস্মিকভাবে দূর-দিগন্তে পর্বতের উপরে একটা অদ্ভূত আলোকরশ্মি কুয়াশার মত আচ্ছাদনকে ভেদ করে দৃশ্যমান হল। পরক্ষনেই তা পর্বতের পেছনে মিলিয়ে গেল। পর পর তিনবার ঘটল এই ব্যপারটি। অতঃপর পর্বতের উপরে অন্ধকারের ভেতরে কিছু একটাকে উড়াউড়ি করতে দেখা গেল। উজ্জল আত্মা সদৃশ কিছু। মনে হল বিরাট কোন রহস্য উদঘাটিত হতে যাচ্ছে। সেই অনুষ্ঠানেরই প্রারম্ভিক আয়োজন চলছে। কিন্তু সেটা অনেক দূরে। পর্বতের উপরে ছায়া নেমে এল। ঘন থেকে ঘনতর হয়ে। কুয়াশার মত মেঘেরা একত্রিত হয়ে বিশাল পিন্ড তৈরি করল। পুনরায় পৃথক হয়ে গেল। অবিশ্রান্তভাবে পরস্পরকে তাড়া করতে লাগল। নিরন্তর।
একটা নীল রঙের আলোকরস্মি দূরের কোন শৃঙ্গ হতে গভীর গিরিখাতের ভেতরে পতিত হল। ঠিক একই সময়ে মেঘেরা পুরো আকাশকে আবৃত করে ফেলল। ঠিক সক্রেটিসের মাথার উপর পর্যন্ত।
আলোকের রশ্মিগুলো ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে গিয়ে দূরে কোথাও গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করল। মনে হল ছায়াচ্ছন্ন ও ভয়ংকর উপতক্যা থেকে তারা নিজেরাই পালিয়ে গেল। সক্রেটিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিষন্নভাবে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। এলপিডিয়াস ভয়ার্তভাবে উপরের পর্বতের শৃঙ্গপানে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল।
“সক্রেটিস, তুমি পর্বতের উপরে কি দেখছ?”
“বন্ধু,” দার্শনিক উত্তর দিল,” আস, আমরা আমাদের পরিস্থিতি নিরীক্ষণ করি। যেহেতু আমরা হাঁটছি, সেহেতু আমরা নিশ্চয়ই কোন গন্তব্যে পৌঁছাব। কারণ সকল পার্থিব অস্তিত্বেরই শেষ আছে। আমি বিশ্বাস করি যে, এই শেষকে পাওয়া সম্ভব সেখানেই, যেখানে দুটো শুরু পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে গেছে। আমার ধারণা আলো ও অন্ধকারের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অধ্যাবসায়ের কারণে শেষ পর্যন্ত আমরাই বিজয়ী হব। যেহেতু মুক্ত চিন্তার অধিকার এখনও আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়নি, আমি এটাও বিশ্বাস করি যেই স্বর্গীয় স্বত্বা আমাদেরকে চিন্তা করার শক্তি দিয়েছেন, তিনিই চাচ্ছেন আমরা যেন আমাদের অধ্যাবসায়ের উদ্দেশ্যকে নিরীক্ষণ করে দেখি। সুতরাং, এলপিডিয়াস, এস আমরা মর্যাদার সাথে মেঘের ওপারে যে প্রত্যূষ আছে, তার সাথে সাক্ষাৎ করতে এগিয়ে যাই।“
“হে, আমার বন্ধু, ওটাই যদি প্রত্যূষ হয়ে থাকে, তবে এই দীর্ঘ নিরানন্দ রাত যাকে আমি এতকাল ধরে সহ্য করে এসেছি, সেটাই আমার কাছে ভাল। আমি এখানেই থাকতে চাই। কারণ এটা নীরব ও শান্তিপুর্ণ। তুমি কি মনে কর না যে, এখানে শিক্ষামূলক আলাপচারিতার ভেতর দিয়ে আমাদের সময় মোটামুটি সহনীয়ভাবেই কেটে যাচ্ছে? ঝড় যতই এগিয়ে আসছে, ততই আমার আত্মা সত্যিকারের আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে যাচ্ছে। তুমি যাই বল সক্রেটিস, আমাদের সামনে আর কখনই সাধারণ ছায়া ও রাতের আগমন হবে না।“
দেবতা জিয়ুস নীচের সীমাহীন সাগরের ভেতরে বিদ্যুতের তীর নিক্ষেপ করলেন।
টেসিপপাস ( Ctesippus) উপরের শৃঙ্গের পানে তাকাল, এবং তার আত্মা ভয়ে-আতঙ্কে জমে গেল। বিষন্ন চেহারার অলিম্পাসের দেবতারা পর্বতের উপরে বৃত্তাকারে এসে ভীড় করেছেন। একটা সর্বশেষ আলোকরশ্মি মেঘ এবং কুয়াশার দিকে নিক্ষিপ্ত হল এবং পথিমধ্যেই তা অস্পষ্ট স্মৃতির মত মৃত্যুবরণ করল। প্রবল ঝড় এগিয়ে আসতে থাকল, এবং রাতের শক্তি উর্ধ্বগামী হতে লাগল। অন্ধকার অবয়ব দিয়ে পুরো আকাশ আবৃত হয়ে গেল। এর কেন্দ্রে টেসিপপাস দেখতে পেল ক্রোনস এর সন্তান সক্রেটিসকে। জ্যোতির্ময় এক রঙের বলয়ের ভেতরে। বিষন্ন চেহারার বর্ষীয়ান দেবতারা ক্রুদ্ধ উত্তেজনা নিয়ে তাকে ঘিরে আছে। গোধূলির সময়ে নীড়ে ফিরে আসা পাখিদের মত ঝড়ের তোড়ে ধূলার ঘুর্ণিবর্ত অথবা উত্তরবায়ুর কারণে ঝরে যাওয়া শরৎকালের পাতাদের মত অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেবতারা মেঘের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং আকাশ দখল করে আছেন।
ক্রমশ মেঘেরা পর্বতের শৃঙ্গ থেকে আতঙ্ককে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দিল। টেসিপপাস তার হাঁটুর উপরে উপবেশন করল। পরবর্তীতে সে স্বীকার করেছিল যে, সেই ভয়ানক মূহুর্তে সে তার শিক্ষকের (সক্রেটিস) শেখানো সকল সিদ্ধান্ত ও উপসংহারগুলো সে সম্পূর্ণরুপে বিস্মৃত হয়েছিল। তার সাহস শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং আতঙ্ক তার আত্মাকে গ্রাস করেছিল।
সে তখন শুধুমাত্রই শুনছিল।
যেখানে একটু পূর্বেই নীরবতা বিরাজ করছিল, সেখানে দুটো কণ্ঠস্বরকে সে শুনতে পেল। একটা কণ্ঠস্বর পরাক্রমশালী ও আতংকসৃষ্টকারী ঈশ্বরের। অন্য কণ্ঠস্বরটা একটা দূর্বল মানুষের, যেটা বাতাসের ভর করে ভেসে আসছিল পর্বতের ঢালু থেকে। এখানেই টেসিপপাস সক্রেটিসকে শেষবার দেখেছিল।
(শেষ পর্ব)
(পুরো গল্পের ভাষাই কঠিন। বিশেষ করে এই শেষ অংশের। প্রায় শতাব্দীকাল পূর্বের শেক্সপিয়ারিয়ান ইংরেজি ভাষা। চার্লস ডিকেন্সের ইংরেজির মত। আমার পক্ষে অনেক বাক্যের সরাসরি অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব ছিল না। কাজেই বুঝতে পারা থেকে শুধুই ভাবটা লিখেছি। আক্ষরিক অনুবাদ হয়নি। কিন্তু যেহেতু আমি সক্রেটিসের অধ্যাবসায় নিয়ে শুরু করেছিলাম আমার পাঠকদের সবার সাথে শেয়ার করে নেয়ার জন্যে, সে কারণেই কষ্ট হলেও অনুবাদ কর্মটি আজ শেষ করলাম। তবে এটা ঠিক যে, গল্পের শেষপ্রান্তে এসে আমার মনে হয়েছে আমার চেষ্টা একেবারেই বৃথা ছিল না। ধন্যবাদ সবাইকে সাথে থাকার জন্যে।)
মেঘের ভেতর থেকে একটা গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে আসল,“ তুমিই কি সেই অভিশপ্ত সক্রেটিস, যে কিনা স্বর্গ ও পৃথিবীর দেবতাদের বিরুদ্ধাচরণ করে আসছে? কিছুকাল পূর্বেও জগতে আমাদের মত অবিনশ্বর ও আনন্দিত কেউই ছিল না। কিন্তু কিছুকাল যাবত আমরা অন্ধকারের ভেতরে অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছি। পৃথিবীতে আমাদেরকে নিয়ে অবিশ্বাস ও সন্দেহের কারণে। এর কারণ তুমি সক্রেটিস। এথেন্সে তোমার পূর্বে কখনই কেউ আমাদেরকে ঘিরে এমন অস্পষ্টতা সৃষ্টি করেনি। সেকারণেই এই জনপদকে আমরা আন্তরিকভাবে পছন্দ করতাম। বল, সক্রেটিস, তুমি কেন তোমার পিতা সোফ্রনিসকাসের নির্দেশ পালন করনি? তিনি তো খুবই উত্তম মানুষ ছিলেন। যৌবনেও তার পাপের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার দেয়া উৎসর্গ সমূহের গন্ধও আমরা দেবতারা যথেষ্টই উপভোগ করতাম…”
“দাঁড়াও, সক্রেটিস, তোমাকে আজ সকল সন্দেহের নিরসন করে দিতে হবে। আমাদের এই ধারণা কি সত্য নয় যে, তুমি সত্য অনুসন্ধানের নামে আসলে ভন্ডামি বা প্রতারণা করছ?” পুনরায় ভেসে আসল মেঘের ভেতর থেকে গর্জন।
এই প্রশ্নের পর বজ্রধ্বনির অভিঘাতে সৃষ্ট নিনাদে পাহাড়-পর্বতগুলো কাঁপতে লাগল। ঝড়ের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ দূরের গিরিসঙ্কটের মধ্যে ছড়িয়ে গেল। পর্বতেরাও ভয়ে কাঁপতে লাগল, কারণ তাদের উপরে উপবিষ্ট দেবতা ক্রোধে কাঁপছিলেন। এমনকি পৃথিবীর পেটের ভেতরে শৃঙ্খলিত দানবেরাও গর্জন করতে লাগল, সক্রেটিস পৃথিবীপৃষ্ঠের উপরে দাঁড়িয়ে আছে বলে।
“কোথায় তুমি, হে অধার্মিক প্রশ্নকারী?’ আকস্মিকভাবে বিদ্রুপের কন্ঠে বলে উঠলেন অলিম্পাসের ঈশ্বর।
“আমি অপেক্ষা করছি তোমার উত্তরের জন্যে, সক্রেটিস। তোমার উত্তর ছাড়া কোন কিছুই আমাকে এখান থেকে সরাতে পারবে না আজ।”
বজ্রেরা গর্জন করতে লাগল, যেমন করে একটা বন্য পশুরা গর্জন করতে কোন ভয়হীণ মাহুতের অগ্রসরের সময়ে। কয়েক মূহুর্ত পর সেই কণ্ঠস্বর পুনরায় আকাশের ভেতর ভেসে আসতে লাগলঃ
“সক্রেটিস, তুমি পৃথিবীতে তুমি এতই অবিশ্বাস ছড়িয়েছ যে, তোমার সন্দেহের মেঘগুলো অলিম্পাস পর্বতের শিখরেও পৌঁছেছে। এতবারই তুমি আমাদেরকে নিয়ে বাজার, শিক্ষাঙ্গন অথবা বিহারভূমিতে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলে যে, আমাদের কাছে মনে হয়েছে তুমি পৃথিবীর সকল বেদীসমূহকে ইতিমধ্যেই ধ্বংস করে দিয়েছ এবং ধ্বংসস্তূপ থেকে নির্গত ধুঁয়া এখানে এসে পৌঁছেছে। শুধু তাই নয় ! তোমার অবিশ্বাসের কারণে অবিনশ্বর দেবতাদের শক্তিও আর দৃশ্যমান নেই…”
“ দেবতা জিয়ুস, আমি জানি তুমি আমার উপরে ক্রুদ্ধ। কিন্তু তারপরেও আমি তোমার কাছ থেকে জানতে চাই কোন সে দেবতা, যিনি আমার সারাজীবনভর আমার চিন্তচেতনাকে প্রভাবিত করেছেন এবং আমাকে অশ্রান্তভাবে সত্যানুসন্ধানে বাধ্য করেছেন?
একটা রহস্যময় নীরবতা নেমে আসল মেঘের ভেতরে। পুনরায় সক্রেটিসের কন্ঠস্বর শোনা গেলঃ
“সেটা কি তুমিই নও, দেবতা জিউস? তাহলে নীরব হয়ে আছ কেন? আমি পরীক্ষা করে বুঝতে চাই যে, আমার এই স্বর্গীয় চিন্তার প্রারম্ভ হয়েছিল তোমার থেকে, নাকি অন্য কারো থেকে? যদি তা তোমার থেকে হয়ে থাকে, তাহলে আমি তা তোমাকে উৎসর্গ করব। কারণ আমি তোমাকেই নিবেদন করতে চাই আমার জীবনের এই পরিপক্ক ফলকে এবং সেই শিখাকে যা তোমার ইন্ধনেই জ্বলে উঠেছিল। হে জিয়ুস, এটা তোমারই দেয়া উপহার, যাকে আমি আমার হৃদয়ের ভেতরে প্রতিপালন করেছিলাম। বীজ হিসেবে। তাহলে তুমি কেন তা গ্রহণ করবে না? আমি কি তাহলে তোমাকে সেই ভাগ্যহীন শিক্ষক হিসেবে ধরে নেব যিনি বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত হবার কারণে দেখতে সমর্থ নন যে, তার ছাত্র বাধ্যগতভাবে তার নির্দেশই অনুসরণ করেছে? কেনই বা তুমি এখন আমাকে আলোর শিখা জ্বালাতে বাঁধা দিচ্ছ, যে শিখা আমার জীবনকে আলোকিত করেছে পবিত্র চিন্তা দিয়ে? সুর্য কি কখনই নক্ষত্রদেরকে বলে, ‘নিভে যাও, কারণ আমি এখন উঠব?’ সুর্য উদয়ের পর সূর্যের প্রখর আলোতে নক্ষত্রের ম্লান আলো তো এমনিতেই মুছে যায়। দিন কখনই মশালকে বলে না, ‘ নিভে যাও, তুমি আমার জন্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করছ।
‘যে স্বর্গীয় বিষয়গুলো নিয়ে আমি প্রশ্ন করেছি, সেগুলো নিয়ে তো তোমার ভীত হবার কথা নয়। আমার মতে সেগুলো হল সুর্য এবং দিনের আলোর মত। নিজেরাই জ্বলজ্বল করতে থাকে, অন্যদেরকে না নিভিয়েই। আমি সেই ঈশ্বরকেই অনুসন্ধান করছি, যিনি আমাকে বলবেন,’পর্যটক, তুমি আমাকে তোমার মশাল দিয়ে দাও। ওটার আর প্রয়োজন নেই তোমার, কারণ আমিই সকল আলোর উৎস। হে সত্যের অনুসন্ধানকারী, আমার বেদীতে তোমার সন্দেহের বীজকে উপস্থাপন কর, কারণ আমাতেই আছে এর মিমাংশা। তুমি যদি সেই ঈশ্বর হয়ে থাক, তবে আমার প্রশ্নগুলো শ্রবণ কর। আমার সন্দেহগুলোই হল শাশ্বত আত্মার শাখা-প্রশাখা, যার অপর নাম সত্য।‘
“কাল মেঘ বিদীর্ণ করে আগুনের শিখা দৃশ্যমান হল এবং প্রবল ঝড়ের মধ্য হতে পুনরায় পূর্বের সেই শক্তিশালী কণ্ঠস্বর শোনা গেলঃ
“কোন পথে তোমার সন্দেহকে ধাবিত করছ, হে অহংকারী দার্শনিক? পার্থিব সকল ভদ্রতা ও নম্রতাকে অস্বীকার করে? তোমার সঙ্গীদের বিশ্বাসপ্রবণ সরলতাকে ত্যাগ করে একাকী তুমি সন্দেহের মরুভূমিতে বিচরণ করছ। দেবতাদেরকে অশ্রদ্ধা করে তুমি কি অর্জন করতে চাও, তুমি? পৃথিবীকে আরও সৌন্দর্যমন্ডিত করতে চাও? পুরাতন ঈশ্বরদের স্থলে নতুন ঈশ্বরদেরকে স্থাপন করতে চাও? সরল আত্মাদের বিশ্বাসের জগত ছেড়ে কেন তুমি অতিক্রম করার চেষ্টা করছ চিরন্তন সন্দেহের রাত এবং জীবনহীন মৃত মরুভূমি, হে অভিশপ্ত দার্শনিক?
অতঃপর কিছুই শোনা গেল না, শুধুমাত্র ঝড়ের গর্জন ছাড়া। এক সময়ে বজ্র ধ্বনি থেমে গেল, বাতাস তার পাখা বন্ধ করল এবং অন্ধকারের ভেতরে প্রবল বর্ষণ শুরু হল। সেই বর্ষণে পৃথিবী ভেসে যাওয়ার উপক্রম!
টেসিপপাসের কাছে মনে হল যে তার শিক্ষক সম্পুর্ণরুপে পরাজিত হয়েছেন। তার প্রশ্নকারী ভয়হীন, অশান্ত সত্ত্বাকে চিরকালের জন্যে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কয়েক মূহুর্তকাল পরে পুনরায় তিনি পুনরায় কথা বলে উঠলেন। একই জায়গা হতে।
“হে দেবতা জিউস, তোমার কথার ধ্বনি দেখি বজ্রের ধ্বনির চেয়েও উচ্চকিত। যে চিন্তাগুলো তুমি আমার ভীতসন্ত্রস্ত আত্মার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলে, সেগুলোর ভারে আমি এতই ভারাক্রান্ত ছিলাম যে, মনে হত অসহ্য যন্ত্রণায় আমার আত্মা বিদীর্ণ হয়ে যাবে। হ্যাঁ, আমি অবশ্যই আমার বন্ধুদের বিশ্বাসী সারল্যকে পরিত্যাগ করেছিলাম। হ্যাঁ, আমি দেখেছি যে, জীবন্ত দেবতারা সন্দেহের কারণে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু, তারপরেও আমি ভয়হীনভাবে হেঁটে গেছি, কারণ আমার দেবতাই আমাকে পথ প্রদর্শন করেছিলেন। এখন আস, আমরা আমার প্রশ্নগুলোকে নিরীক্ষণ করে দেখি। তোমার বেদীতে যে ধূপ পোড়ানো হয়, তা নিবেদন করা হয়ে থাকে যিনি জীবন দান করেছেন তার উদ্দেশ্যে? তার মানে কি এই না যে, তুমি অন্যদের জিনিস চুরি করছ? কিন্তু বিশ্বাসীরা সরলভাবে মনে করছে তারা তাকেই দিচ্ছে। তুমি ঠিকই বলেছ। আমি স্থপতি বা কোন মন্দিরের নির্মাতা নই। আমি শুধুমাত্রই একজন মৃত্তিকা খননকারী। কিন্তু আমার বোধ আমাকে বলে যে, মাটি খননও ভবিষ্যৎ মন্দির তৈরীর জন্যে দরকারী। কাজেই, নির্মাণ শেষে যখন জমকালো অট্টালিকা পবিত্র স্থানের উপরে মাথা তুলে দাঁড়াবে এবং বিশ্বাসীরা তাতে নতুন ঈশ্বরের সিংহাসন স্থাপন করবে, তখন একজন মাটি খননকারী হিসেবে আমিও তার কাছে যাব এবং বলব, ‘আমাকেও স্বীকৃতি দাও হে ঈশ্বর, যদিও মাটি খননের সময়ে আমার ভেতরে এই অট্টালিকা সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণাই ছিল না। তখন কি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দেবে?”
একটা আশ্চর্য রকমের নীরবতা। এরপর সক্রেটিস তার কন্ঠস্বর উঁচু করে পুনরায় বলা শুরু করলেনঃ
“আমার কর্দমাক্ত ডোবার উপরে যখন আলো পড়ে, তখন আলোর বাষ্পগুলো মাটির আশ্রয় ছেড়ে সুর্যের দিকে ধাবিত হয় এবং ইথারের ভেতরে মিশে যায়। তুমি সুর্যের আলোকরশ্মি দিয়ে আমার কর্দমাক্ত আত্মাকে তুমি স্পর্শ করার কারণে আমি তোমার দিকে ধাবিত হই, যদিও আমি তখনও তোমার নাম জানি না। তখনও আমি তোমাকে খুঁজি, কারন তুমিই সত্য, তোমাকেই লাভ করার চেষ্টা করি, কারণ তুমিই সুবিচার, তোমাকেই ভালবাসি, কারণ তুমিই ভালবাসা, তোমার জন্যেই আমি মৃত্যবরণ করি, কারণ তুমিই জীবনের উৎস। হে অজানা ঈশ্বর, তুমি কি আমাকে ফিরিয়ে দেবে? আমার অসহনীয় সন্দেহ, আমার সত্যানুসন্ধান, আমার কঠিন জীবন, আমার ইচ্ছামৃত্যু – সবকিছুই যে তোমার কাছে আমার আমার নিবেদন করা নৈবেদ্য।“
আবার ঝড় শুরু হল। ঝড়ের শব্দ পাহাড় থেকে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল এবং এক সময়ে উপতক্যার ভেতরে মিলিয়ে গেল।
টেসিপপাস অবাক নয়নে উপরের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টির সামনে এক্ষণে সে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখতে পেল, যা মানুষেরা কখনই দেখেনি! সে দেখতে পেল, অকস্মাৎ রাত্রি অন্তর্হিত হয়ে গেছে। মেঘেরা সরে গেছে অন্য কোথাও। দেবতারা সোনালী অলংকার ও উজ্জ্বল পোষাক পরে আকাশের ভেতরে উড়ছে। নদী ও পাহাড়ের উপর দিয়ে। এলপিডিয়াসকে দেখা গেল একটা পাহাড়ের চূড়া থেকে দেবতাদের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে মিলিয়ে যাওয়া দেবতাদের কাছে তার ভাগ্যের সমাধান চাচ্ছে।
অবশেষে রহস্যময় কুয়াশার ভেতর দিয়ে একটা পাহাড়ের চূড়া দেখা গেল। গভীর নীল উপতক্যার উপর দিয়ে তাকে মশালের মত উজ্জ্বল মনে হচ্ছিল। দেবতা জিউস বা অলিম্পাসের দেবতাদের কাউকেই সেখানে দেখা যাচ্ছিল না। শুধুমাত্র উজ্জ্বল সুর্যালোকের নীচে নীচে সক্রেটিস একাকী দাঁড়িয়ে ছিলেন।
টেসিপপাস চারদিকে জীবনের জয়গান দেখে বিস্মিত হল। একটা উজ্জ্বল ভোরের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল সেখানে। অপরিসীম মুগ্ধতা নিয়ে টেসিপপাস দাঁড়িয়ে থাকল সেখানে।
কয়েক মূহুর্ত পরে সকল কিছুই মিলিয়ে গেল। এবং একটা সাধারণ দিন টেসিপপাসের সামনে এসে হাজির হল। একটা নিরানন্দ গোধূলির মত।
একটা গভীর নির্জনতার ভেতরে সক্রেটিসের শিষ্যরা টেসিপপাসের অসাধারণ আবৃত্তি শুনতে পেল। সক্রেটিসের প্রধান শিষ্য প্লেটো নির্জনতা ভঙ্গ করে বলে উঠলোঃ
“আস, আমরা সবাই মিলে স্বপ্নটির গুরুত্ব অনুসন্ধান করে দেখি।“
“ আস, আমরা অনুসন্ধান করি,” অন্য সকল শিষ্যেরা সাড়া দিল।