ঢাকা ১০:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হৃদরোগী বাড়ছে বাদ যাচ্ছে না শিশু ও তরুণরা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৪৯:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯
  • ২২০ বার

গত পাঁচ মাসে আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হন মোহাম্মদ হোসেন। তার বয়স ৪২ বছর। হৃদরোগের চিকিৎসার পর তিনি এখন কিছুটা সুস্থ আছেন। তিনি ধূমপান করতেন না। কিন্তু তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি তার খাদ্যাভাস ও জীবন-যাপনে কিছু পরিবর্তন এনেছেন। অপর মধ্য বয়সী সারোয়ারকে হার্ট অ্যাটাকের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান। তার স্বজনরা জানিয়েছেন, তার উচ্চরক্ত চাপ ছিল। ধূমপাানেরও অভ্যাস ছিল। মাত্র ৪০ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

শুধু মোহাম্মদ হোসেন বা সরোওয়ার নন,বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশ ঘটছে অসংক্রামক ব্যাধি থেকে। অসংক্রামক ব্যাধিগুলোর মধ্যে আবার শীর্ষে রয়েছে হৃদরোগ। হৃদরোগকে খাদ্যবাহিতও রোগ বলা হয়। তারা বলেন, দুশ্চিন্ত ও অত্যাধিক মানসিক চাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই পরিবার ও সমাজে সবার সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। বর্তমান বিশ্বে হৃদরোগকে একনম্বর ঘাতকব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবছর ১ কোটি ৭৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় এই রোগে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২ কোটি ৩০ লাখে। অথচ হৃদরোগের ভয়াবহতার ব্যাপারে সেইভাবে প্রচারণা নেই। ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, স্বাস্থ্যকর খাবার এবং ধূমপানমুক্ত পরিবেশ ছাড়া একজন ব্যক্তির পক্ষে হৃদরোগের ব্যাপারে ঝুঁকিমুক্ত থাকা কঠিন। তাই সকলে মিলেই সুস্থ হার্টবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। হৃৎপিণ্ড হচ্ছে মানুষের  শরীরের একমাত্র অঙ্গ, যেটা আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে বাঁচিয়ে রাখে, কেননা মানুষের মস্তিষ্কের মৃত্যু হলেও আমরা তাকে জীবিত বলতে পারি যতক্ষণ পর্যন্ত হৃৎপিণ্ডের কার্য ক্ষমতা সচল থাকবে। বর্তমানে, মানুষে মৃত্যুর যত কারণ আছে, হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালি জনিত রোগের কারণে মৃত্যু হলো সবচেয়ে বেশি। এক সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যায়, ২০০০ সালের শুরু থেকে প্রতিবছর ১৭ মিলিয়ন লোক মারা যায় এই হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালিজনিত রোগের কারণে। দেখা যায়, হৃৎপিণ্ডে রক্তনালির ও মস্তিষ্কের স্ট্রোক জনিত কারণে মৃত্যুর হার ক্যানসার, এইচআইভি-এইডস্‌ এবং ম্যালেরিয়া থেকেও বেশি। বর্তমানে ৩১ শতাংশ মৃত্যুর কারণ ধরা হয় এই হৃদরোগ ও রক্তনালি জনিত রোগের কারণে এবং অল্প বয়সে মৃত্যুর ৮০ শতাংশ  কারণও এ হৃদরোগকে দায়ী করা হয়।

হৃদরোগের প্রাথমিক লক্ষণ হলো এনজাইনা, শ্বাসকষ্ট হওয়া, অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন হওয়া ইত্যাদি। এনজাইনা হচ্ছে, রোগীর সাধারণত বুকে ব্যথা, বুকে চাপ অনুভব করা, বুক ভার ভার হওয়া, দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হওয়া ইত্যাদি। কারো করোনারি আর্টারি বা হার্টের রক্তনালির ৭০ শতাংশ ব্লক হয়ে গেলে তখনই এনজাইনা হয়ে থাকে। কখনো কখনো এনজাইনা থেকে হা্‌র্ট অ্যাটাক হয়। আবার করোনারি ধমনি যখন ১০০ শতাংশ ব্লক হয়, তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের ফলেও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক একটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা, যেখানে জীবন ও মৃত্যু খুব কাছাকাছি চলে আসে। এটি সাধারণত বয়স্কদের রোগ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সী মানুষের এটি হয়ে থাকে। আমাদের এদেশে ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের এটি হয়ে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে আমাদের দেশের লোকের ১০ বছর আগেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে বলে বিশেষজ্ঞরা তুলে ধরেছেন। এখন ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী, এমনকি ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীরাও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হচ্ছে। যার অন্যতম কারণ হলো- স্বাস্থ্য সম্মত খাবার না খাওয়া, ধূমপান ও তামাক জাতীয়  দ্রব্য সেবন, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম না করা ও অ্যালকোহল পান করা। দেশের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম  মোস্তফা জামান তার এক প্রবন্ধে বলেন, দেশে বয়স্কদের মধ্যে ১৭ শতাংশ লোক হৃদরোগে ভুগছেন। ছোটদের মধ্যে হাজারে ৮ থেকে ১০ জন এই রোগের দেখা মিলছে। বাংলাদেশে এখন বড়দের সঙ্গে ছোটদেরও হৃদরোগ হচ্ছে। যা চিকিৎসকদের ভাবিয়ে তুলছে। তিনি আরো জানান, আমাদের দেশে ৫০ থেকে ৬০ বছরের বয়সীদের হৃদরোগ বেশি হচ্ছে। তবে ২০ থেকে ২২ বছরের তরুণ রোগীও আমরা পাচ্ছি। বহু শিশু জন্মগত হার্টের সমস্যা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের হৃদরোগ বেশি হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। সবাই মনে করেন এটি ধনীদের রোগ। বিষয়টি সঠিক নয়। এটা গরীব মানুষেরও হয়ে থাকে।

খাদ্যাভাস বাজে হওয়ার কারণে গরীবদের মধ্যে এই রোগ দেখা যাচ্ছে।  চিকিৎসকদের গবেষণার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ভৌগোলিক কারণে আমাদের দেশেও র্হাট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি। নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য মেনে এ দেশের মানুষের উচ্চতা কম। এ কারণে আমাদের করোনারি ধমনীর ভেতরকার পরিসর বেশ ছোট। করোনারি ধমনীর পরিসর ছোট হতে হতে একবারে বন্ধ হয়ে গেলেই সমস্যাটা হয়।এ দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের সংখ্যাটা বেশি। ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের সংখ্যাটাও ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। শিশুদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। এর কারণ, কায়িক পরিশ্রমের অভাব এবং জাঙ্ক ফ্রুড খাওয়ার অভ্যাস। শিশুদের এ অভ্যাস পাল্টাতে না পারলে দেশে হৃদরোগীর সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। ধূমপান করার কারণে ঝুঁকি বাড়ছে এবং যেসব পরিবারে উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, সেই পরিবারে হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় হলো- ধূমপান ত্যাগ করা, হাঁটাহাঁটি করা, সাইকেলিং, সাঁতার কাটা, খাদ্যাভাসের পরিবর্তন করা, বেশি বেশি সাক-সবজি খাওয়া, চর্বিযুক্ত খাবার কম খাওয়া, আঁশযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শিশু এবং নারীরাই বেশি হৃদরোগের ঝুঁকিতে থাকে। সে কারণেই বারবার শিশু ও নারীর ওপর বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার কথা বলে থাকেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ। তাদের মতে, এই রোগ থেকে বাঁচতে হলে গোটা জীবন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। হার্ট সুস্থ রাখার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উগ্যোগে ২০১৭ সালে প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিনের পরিসংখ্যান মতে, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটন ও হাসপাতালে হৃদরোগীর সংখ্যা বছর বছর বাড়ছেই। ২০০৯ থেকে ২০১৬ এই আট বছরে হাসপাতালটির বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেয়া ও ভর্তির ক্ষেত্রে রোগীর সংখ্যা  বাড়ার চিত্র তুলে ধরা হয়। ২০০৯ সালে বহির্বিভাগ থেকে সেবা নিয়েছিল এক লাখ ৬০ হাজার ৮ জন এবং ভর্তি হয়েছিল ৪১ হাজার ৫৫৪ জন, ২০১০ সালে বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেয়ার সংখ্যা ছিল  এক লাখ ৬১ হাজার ৯৫৮ জন এবং ভর্তি হন ৪২ হাজার ৭৭৯ জন। ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল  এক লাখ ৬৩ হাজার ৮১৩ জন ও ৪৩ হাজার ২৭৫ জন। ২০১২ সালে বহির্বিভাগ  থেকে চিকিৎসা নিয়েছিল এক লাখ ৭৪ হাজার ৩৬৬ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি হন ৪৪ হাজার ৫৫৯ জন। ২০১৩ সালে বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেয়ার সংখ্যা ছিল এক লাখ ৭২ হাজার ২৬৯ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৪৩ হাজার ৩৪১ জন, ২০১৪ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ ৫৩৩ এবং ৪৯ হাজার ২৮৩ জনে। ২০১৫ সালে বহির্বিভাগ দিয়ে চিকিৎসা নিয়েছিল দুই লাখ ২২ হাজার ১৮৬ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৩ হাজার ৩৯০ জন হৃদরোগী। ২০১৬ সালে বহির্বিভাগ দিয়ে চিকিৎসা নিয়েছিল দুই লাখ ২৬ হাজার ১৩৮ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৪ হাজার ৯০৬ জন হৃদরোগী। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগে ২৯শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস পালন করা হচ্ছে। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে-‘আমার হার্ট, তোমার হার্ট সুস্থ  রাখতে অঙ্গীকার করি এক সাথে’।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হৃদরোগী বাড়ছে বাদ যাচ্ছে না শিশু ও তরুণরা

আপডেট টাইম : ১২:৪৯:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

গত পাঁচ মাসে আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হন মোহাম্মদ হোসেন। তার বয়স ৪২ বছর। হৃদরোগের চিকিৎসার পর তিনি এখন কিছুটা সুস্থ আছেন। তিনি ধূমপান করতেন না। কিন্তু তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি তার খাদ্যাভাস ও জীবন-যাপনে কিছু পরিবর্তন এনেছেন। অপর মধ্য বয়সী সারোয়ারকে হার্ট অ্যাটাকের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান। তার স্বজনরা জানিয়েছেন, তার উচ্চরক্ত চাপ ছিল। ধূমপাানেরও অভ্যাস ছিল। মাত্র ৪০ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

শুধু মোহাম্মদ হোসেন বা সরোওয়ার নন,বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশ ঘটছে অসংক্রামক ব্যাধি থেকে। অসংক্রামক ব্যাধিগুলোর মধ্যে আবার শীর্ষে রয়েছে হৃদরোগ। হৃদরোগকে খাদ্যবাহিতও রোগ বলা হয়। তারা বলেন, দুশ্চিন্ত ও অত্যাধিক মানসিক চাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই পরিবার ও সমাজে সবার সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। বর্তমান বিশ্বে হৃদরোগকে একনম্বর ঘাতকব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবছর ১ কোটি ৭৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় এই রোগে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২ কোটি ৩০ লাখে। অথচ হৃদরোগের ভয়াবহতার ব্যাপারে সেইভাবে প্রচারণা নেই। ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, স্বাস্থ্যকর খাবার এবং ধূমপানমুক্ত পরিবেশ ছাড়া একজন ব্যক্তির পক্ষে হৃদরোগের ব্যাপারে ঝুঁকিমুক্ত থাকা কঠিন। তাই সকলে মিলেই সুস্থ হার্টবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। হৃৎপিণ্ড হচ্ছে মানুষের  শরীরের একমাত্র অঙ্গ, যেটা আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে বাঁচিয়ে রাখে, কেননা মানুষের মস্তিষ্কের মৃত্যু হলেও আমরা তাকে জীবিত বলতে পারি যতক্ষণ পর্যন্ত হৃৎপিণ্ডের কার্য ক্ষমতা সচল থাকবে। বর্তমানে, মানুষে মৃত্যুর যত কারণ আছে, হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালি জনিত রোগের কারণে মৃত্যু হলো সবচেয়ে বেশি। এক সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যায়, ২০০০ সালের শুরু থেকে প্রতিবছর ১৭ মিলিয়ন লোক মারা যায় এই হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালিজনিত রোগের কারণে। দেখা যায়, হৃৎপিণ্ডে রক্তনালির ও মস্তিষ্কের স্ট্রোক জনিত কারণে মৃত্যুর হার ক্যানসার, এইচআইভি-এইডস্‌ এবং ম্যালেরিয়া থেকেও বেশি। বর্তমানে ৩১ শতাংশ মৃত্যুর কারণ ধরা হয় এই হৃদরোগ ও রক্তনালি জনিত রোগের কারণে এবং অল্প বয়সে মৃত্যুর ৮০ শতাংশ  কারণও এ হৃদরোগকে দায়ী করা হয়।

হৃদরোগের প্রাথমিক লক্ষণ হলো এনজাইনা, শ্বাসকষ্ট হওয়া, অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন হওয়া ইত্যাদি। এনজাইনা হচ্ছে, রোগীর সাধারণত বুকে ব্যথা, বুকে চাপ অনুভব করা, বুক ভার ভার হওয়া, দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হওয়া ইত্যাদি। কারো করোনারি আর্টারি বা হার্টের রক্তনালির ৭০ শতাংশ ব্লক হয়ে গেলে তখনই এনজাইনা হয়ে থাকে। কখনো কখনো এনজাইনা থেকে হা্‌র্ট অ্যাটাক হয়। আবার করোনারি ধমনি যখন ১০০ শতাংশ ব্লক হয়, তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের ফলেও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক একটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা, যেখানে জীবন ও মৃত্যু খুব কাছাকাছি চলে আসে। এটি সাধারণত বয়স্কদের রোগ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সী মানুষের এটি হয়ে থাকে। আমাদের এদেশে ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের এটি হয়ে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে আমাদের দেশের লোকের ১০ বছর আগেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে বলে বিশেষজ্ঞরা তুলে ধরেছেন। এখন ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী, এমনকি ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীরাও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হচ্ছে। যার অন্যতম কারণ হলো- স্বাস্থ্য সম্মত খাবার না খাওয়া, ধূমপান ও তামাক জাতীয়  দ্রব্য সেবন, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম না করা ও অ্যালকোহল পান করা। দেশের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম  মোস্তফা জামান তার এক প্রবন্ধে বলেন, দেশে বয়স্কদের মধ্যে ১৭ শতাংশ লোক হৃদরোগে ভুগছেন। ছোটদের মধ্যে হাজারে ৮ থেকে ১০ জন এই রোগের দেখা মিলছে। বাংলাদেশে এখন বড়দের সঙ্গে ছোটদেরও হৃদরোগ হচ্ছে। যা চিকিৎসকদের ভাবিয়ে তুলছে। তিনি আরো জানান, আমাদের দেশে ৫০ থেকে ৬০ বছরের বয়সীদের হৃদরোগ বেশি হচ্ছে। তবে ২০ থেকে ২২ বছরের তরুণ রোগীও আমরা পাচ্ছি। বহু শিশু জন্মগত হার্টের সমস্যা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের হৃদরোগ বেশি হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। সবাই মনে করেন এটি ধনীদের রোগ। বিষয়টি সঠিক নয়। এটা গরীব মানুষেরও হয়ে থাকে।

খাদ্যাভাস বাজে হওয়ার কারণে গরীবদের মধ্যে এই রোগ দেখা যাচ্ছে।  চিকিৎসকদের গবেষণার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ভৌগোলিক কারণে আমাদের দেশেও র্হাট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি। নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য মেনে এ দেশের মানুষের উচ্চতা কম। এ কারণে আমাদের করোনারি ধমনীর ভেতরকার পরিসর বেশ ছোট। করোনারি ধমনীর পরিসর ছোট হতে হতে একবারে বন্ধ হয়ে গেলেই সমস্যাটা হয়।এ দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের সংখ্যাটা বেশি। ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের সংখ্যাটাও ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। শিশুদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। এর কারণ, কায়িক পরিশ্রমের অভাব এবং জাঙ্ক ফ্রুড খাওয়ার অভ্যাস। শিশুদের এ অভ্যাস পাল্টাতে না পারলে দেশে হৃদরোগীর সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। ধূমপান করার কারণে ঝুঁকি বাড়ছে এবং যেসব পরিবারে উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, সেই পরিবারে হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় হলো- ধূমপান ত্যাগ করা, হাঁটাহাঁটি করা, সাইকেলিং, সাঁতার কাটা, খাদ্যাভাসের পরিবর্তন করা, বেশি বেশি সাক-সবজি খাওয়া, চর্বিযুক্ত খাবার কম খাওয়া, আঁশযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শিশু এবং নারীরাই বেশি হৃদরোগের ঝুঁকিতে থাকে। সে কারণেই বারবার শিশু ও নারীর ওপর বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার কথা বলে থাকেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ। তাদের মতে, এই রোগ থেকে বাঁচতে হলে গোটা জীবন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। হার্ট সুস্থ রাখার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উগ্যোগে ২০১৭ সালে প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিনের পরিসংখ্যান মতে, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটন ও হাসপাতালে হৃদরোগীর সংখ্যা বছর বছর বাড়ছেই। ২০০৯ থেকে ২০১৬ এই আট বছরে হাসপাতালটির বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেয়া ও ভর্তির ক্ষেত্রে রোগীর সংখ্যা  বাড়ার চিত্র তুলে ধরা হয়। ২০০৯ সালে বহির্বিভাগ থেকে সেবা নিয়েছিল এক লাখ ৬০ হাজার ৮ জন এবং ভর্তি হয়েছিল ৪১ হাজার ৫৫৪ জন, ২০১০ সালে বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেয়ার সংখ্যা ছিল  এক লাখ ৬১ হাজার ৯৫৮ জন এবং ভর্তি হন ৪২ হাজার ৭৭৯ জন। ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল  এক লাখ ৬৩ হাজার ৮১৩ জন ও ৪৩ হাজার ২৭৫ জন। ২০১২ সালে বহির্বিভাগ  থেকে চিকিৎসা নিয়েছিল এক লাখ ৭৪ হাজার ৩৬৬ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি হন ৪৪ হাজার ৫৫৯ জন। ২০১৩ সালে বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেয়ার সংখ্যা ছিল এক লাখ ৭২ হাজার ২৬৯ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৪৩ হাজার ৩৪১ জন, ২০১৪ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ ৫৩৩ এবং ৪৯ হাজার ২৮৩ জনে। ২০১৫ সালে বহির্বিভাগ দিয়ে চিকিৎসা নিয়েছিল দুই লাখ ২২ হাজার ১৮৬ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৩ হাজার ৩৯০ জন হৃদরোগী। ২০১৬ সালে বহির্বিভাগ দিয়ে চিকিৎসা নিয়েছিল দুই লাখ ২৬ হাজার ১৩৮ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৪ হাজার ৯০৬ জন হৃদরোগী। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগে ২৯শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস পালন করা হচ্ছে। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে-‘আমার হার্ট, তোমার হার্ট সুস্থ  রাখতে অঙ্গীকার করি এক সাথে’।