হাওর বার্তাঃসুদের টাকা পরিশোধ না করায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সত্তরোর্ধ্ব এক নারীর খামার থেকে চারটি দুধেল গরু লুট করে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন স্থানীয় কৃষক লীগ ও যুবলীগ নেতারা। গত সোমবার গভীর রাতে ঢাকা উদ্যানের একতা হাউজিং এলাকার ওই খামার থেকে গরুগুলো নিয়ে যান আদাবর থানা শাখা কৃষক লীগ নেতা ফালান মিয়া ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা মো. সাগর। বাধা দিলে মারধর করা হয় ওই নারীর পুত্রবধূকে। পরদিন মঙ্গলবার সকালে খামারের পাশে তাঁদের বাসায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
অল্প কিছু সুদের টাকার জন্য এভাবে রাতের বেলায় খামার থেকে গরু লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর বাসায় তালা মেরে দেওয়ার ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় ভুক্তভোগী পরিবারটি মামলা করতে চাইলেও পুলিশ কোনো মামলা নেয়নি, তবে সাধারণ ডায়েরি করেন। পরবর্তী সময়ে পুলিশ সরেজমিনে গিয়ে তালাবদ্ধ ঘরটি খুলে দিলেও লুট হওয়া চারটি গরু উদ্ধারের বিষয়ে কোনো ভূমিকা নেয়নি। উল্টো যুবলীগ নেতা সাগর বৃদ্ধার খামার থেকে লুটে নেওয়া দুটি গরু ইতিমধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন। পুলিশ গরু উদ্ধার করা তো দূরের কথা সাগর ও ফালান মিয়ার পক্ষেই কথা বলছেন। এতে আতঙ্কে আছেন বলে ওই পরিবারের সদস্যরা জানান।
ভুক্তভোগী জরিনা বেগম (৭৮) জানান, তাঁর যে চারটি গরু লুট হয়েছে সেগুলোর দাম কমপক্ষে ১২ লাখ টাকা। তাঁর পুত্রবধূ শাহনাজ বেগম মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা না নিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ—সুদের কিছু টাকার জন্য গরু নিয়ে বিক্রি করে দিল। কিন্তু পুলিশ এসে যদি সেই অভিযুক্তদের না ধরে, তাদের পক্ষেই সাফাই গায় তাহলে কিভাবে গরু উদ্ধার হবে? বৃদ্ধার গরু নিয়ে দুটি বিক্রিও করে দিয়েছেন সাগর।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নিজেকে আদাবর থানা শাখা কৃষক লীগের সদস্য দাবি করে ফালান মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টাকা পাই বলেই গরু নিয়েছি, টাকা দিলে গরু ফেরত দেব।’ রাতের বেলায় খামার থেকে জোর করে গরু নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টাকা পাইতে হইলে তো এর চেয়ে ভালো কিছু আমি দেখি না। এখানে পুলিশ-টুলিশের ভয় দেখিয়ে লাভ নাই।’
জানা গেছে, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা জরিনা বেগম। তাঁর ছেলে দেলোয়ার হোসেন (৫৬) প্রায় ৩০ বছর ধরে প্রাইভেট কারচালকের কাজ করেন। দীর্ঘদিনের সঞ্চয়ের টাকায় চার বছর আগে চারটি দুধেল গরু কেনেন তিনি। তাঁর মা জরিনা ও স্ত্রী শাহনাজের পরিশ্রমে খামারে গরুর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে একতা হাউজিংয়ের ৩ নম্বর রোডের ৪৯ নম্বরের খালি প্লটটি ভাড়া নিয়ে সেখানে বড় আকারে খামার গড়ে তোলেন তাঁরা। গরুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭। কিন্তু বুড়িগঙ্গার জায়গায় হওয়ায় গত মার্চ মাসে প্লটটি উচ্ছেদ করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ)। এতে করে খামারের ছয় থেকে সাত লাখ টাকার ক্ষতি হয়। পরে পাশের ৩৯ নম্বর প্লটে খামার সরিয়ে নেন তাঁরা। এর মধ্যে তিনটি গরু হঠাৎ মারা যাওয়ায় তাঁরা আরো কষ্টের মধ্যে পড়ে যান।
খামার সম্প্রসারণ করতেই জরিনার পুত্রবধূ শাহনাজ বেগম কৃষক লীগ নেতা ফালান মিয়ার কাছ থেকে শতকরা ১২ টাকা সুদে এক লাখ টাকা, স্থানীয় যুবলীগ নেতা মো. সাগরের কাছ থেকে শতকরা ১০ টাকা সুদে দেড় লাখ টাকা নেন। একইভাবে জামাল মোল্লার কাছ থেকে এক লাখ টাকা ও পলাশ মিয়ার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা, পারুলী বেগমের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ও তমাল নামের আরেকজনের কাছ থেকে টাকা ধার নেন তিনি। কিন্তু বিগত দুই মাস পাওনাদারদের সুদের টাকা দিতে পারেননি তাঁরা। সে জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরেই পাওনাদাররা খামার থেকে গরু নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে আসছিলেন।
খামার মালিক পরিবারটি পাওনাদারদের কাছে ছয় মাস সময় চায়। এরপর সুদে-আসলে সব টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তাঁরা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, মোহাম্মদপুর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহীন ব্যাপারীর ক্যাডার হিসেবে পরিচিত যুবলীগের মো. সাগর। কাগজে-কলমে এখনো কোনো পদে না থাকলেও ওয়ার্ড যুবলীগের পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন সাগর।
জরিনার পরিবার অভিযোগ করেছে, খামার থেকে গরু নিয়ে ক্ষান্ত হননি সাগর। তিনি একের পর এক হুমকি দিয়ে আসছেন যে পুলিশকে জানালে তাঁদের মেরে লাশ বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে।
জরিনার ছেলে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘সুদের টাকা দুই মাস দিতে পারিনি বলে সোমবার রাত ১২টার দিকে আমাদের খামার থেকে ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকার গরু লুটে নিয়ে যায় সাগর, ফালান মিয়া ও তমাল।’
জরিনা বেগম বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে খামারে গরু পালছিলাম। এলাকার সাগর ও ফালান খামার থেকে চারটি গরু নিয়ে গেছে।’
এ বিষয়ে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সুদের টাকার জন্য গরু লুট করে নিতে পারে না।’ তিনি ভুক্তভোগী পরিবারটিকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বলেন। কাউন্সিলর বলেন, ‘আমি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’