হাওর বার্তা ডেস্কঃ ব্যাংক ঋণ লুটপাট বিত্তবান হওয়ার লোভনীয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। লুট হওয়া অর্থের সিংহভাগই পাচার হচ্ছে বিদেশে।
বিভিন্ন চ্যানেলে টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। সব মিলে বছরে দেশ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। ব্যাংক লুটের বড় একটি অংশ মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়ায় দেশের অর্থনীতিতে ফিরে আসছে। এসব কারণে দেশের আয় ও ধন বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
শনিবার ‘বাংলাদেশের আয় ও ধন বৈষম্য’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারের মূল প্রবন্ধে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত) মইনুল ইসলাম এ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। মূল প্রবন্ধে বৈষম্য কমাতে ১৩ দফা সুপারিশ করা হয়। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে ওই সেমিনারের আয়োজন করে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতের শনির দশা কাটাতে সরকারকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত শক্তিশালী ও কঠোর মনিটরিং পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি একটি কার্যকর ও দুর্নীতিমুক্ত বিচার ব্যবস্থা দাঁড় করাতে হবে। একই সঙ্গে শক্তিশালী করতে হবে শেয়ারবাজারকেও। তবে পুঁজিবাজারকে ব্যাংকিংয়ের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করানো যাবে না। এটি করা হলে খেলাপি ঋণের সমস্যা ও পুঁজি লুণ্ঠন থেকে ব্যাংকিং খাতকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
এতে আরও বলা হয়, কয়েক হাজার ধনাঢ্য রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আরোপের কারণে ব্যাংকিং খাত পুঁজি লুটপাটের আকর্ষণীয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা হচ্ছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়া। রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশ রয়েছে। ফলে অধিকাংশই ঋণ ফেরত দিচ্ছে না। ঋণ ফেরত না দেয়ার বিষয়টি এখন ক্রমশ দুরারোগ্য ক্যান্সারে পরিণত হতে যাচ্ছে।
প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে ধনাঢ্য ব্যক্তির প্রবৃদ্ধি হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। ২০১২-১৭ সাল পর্যন্ত এদেশে ধনাঢ্য ব্যক্তির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশের সম্পদের বড় একটি অংশ তাদের হাতে চলে যাওয়ায় ধন বৈষম্য অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। প্রবন্ধে বলা হয়, ধনাঢ্য ব্যক্তি সাজতে গিয়ে অনেকেই দুর্নীতিতে ডুবে যাচ্ছেন। অনেক সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা অর্থ দুর্নীতিবাজদের পরিবারের সদস্যদের অতি দ্রুত
মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া দেশ থেকে পুঁজি পাচারকারী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের অধিকাংশই গার্মেন্ট মালিক। কিন্তু এ খাতের ৩৫ লাখ শ্রমিক আগের মতোই দরিদ্র রয়ে গেছেন। এছাড়া মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের মালিক ও টরেন্টোর বেগমপাড়ার বাড়ির মালিকদের মধ্যেও দুর্নীতিবাজ ইঞ্জিনিয়ার, সিভিল আমলা ও রাজনীতিবিদ আছেন।
অধ্যাপক আবুল বারকাতের সভাপতিত্বে ওই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন বলেন, ’৯০-এর দশকে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি শুরু হয়। ওই সময় থেকে মনে করা হতো এটি সামাজিক সন্ত্রাস। এ ঋণখেলাপির সংস্কৃতি রোধ করতে হবে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পার হলেও আর্থিক খাতে আস্থার অভাব রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাত ঠিক করতে হলে দীর্ঘ মেয়াদে সংস্কার প্রয়োজন।
ড. ফরাস উদ্দিন বলেন- দুর্নীতি, দলবাজি, স্বজনপ্রীতি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ঠেকানো না গেলে আয় বৈষম্য কমবে না। সুযোগ থাকার কারণেই দেশে আয় ও ধন বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং খাতে আমানত নেয়া হয় ৩ মাসের জন্য। কিন্তু ঋণ দেয়া হয় দীর্ঘদিনের জন্য। বিদেশি একটি দাতা সংস্থার পরামর্শে ব্যাংকিং খাতে এ পদ্ধতি চালু হয়। যে কারণে আজ এ খাত ধ্বংসের মধ্যে পড়েছে।
সাবেক এ গভর্নর আরও বলেন, দেশে কর জিডিপির অনুপাত কম। সোয়া চার কোটি মানুষ কর দেয়ার কথা। সেখানে দিচ্ছে মাত্র ২০ লাখ। পদ্ধতিগত সমস্যার কারণেই এমন হয়েছে। তবে মাতৃমৃত্যুর হার ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবকিছুতেই বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থানে আছে। বৈষম্যের পরও এ অগ্রগতি হয়েছে। জানা গেছে, ১৯৯০ সালে ৫৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। ২০১৬ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২৪.৩ শতাংশে। বর্তমানে এ হার ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। যা সংখ্যায় দাঁড়িয়েছে সোয়া কোটি। আয় বৈষম্য বেড়েছে অসম গতিতে। পাহাড় সমান এ আয় বৈষম্য বিপজ্জনক বলে সেমিনারে উল্লেখ করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিক উজ জামান বলেন, গ্রামকে অবহেলা করে চললে আয় বৈষম্য দূর হবে না। তা দূর করতে কর্মসংস্থানমুখী শিল্পায়ন দরকার। সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, রফতানি আয় কয়েকটি পণ্যের ওপর নির্ভর করে। দেশে পাট থেকে পলিমা হচ্ছে। এটি কাজে লাগিয়ে এ খাতে আয় বৈষম্য দূর করতে হবে। কারণ বিশ্বে প্রতিদিন চার কোটি পিস পলিথিন ফেলা হচ্ছে। পলিমা আমাদের রফতানি খাতে বিরাট সুযোগ এনে দিতে পারে।
অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. এম জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতেও বৈষম্য আছে। সরকার বড় ঋণখেলাপিদের জেল দিতে পারছে না, আটকাতেও পারছে না। সঠিকভাবে ঋণ বিতরণ হয়নি। বড় সাহেবদের ঋণ দেয়ার ফলে হাওর অঞ্চল সুনামগঞ্জ বা দরিদ্র অঞ্চল কুড়িগ্রামে ছোট ছোট ঋণ দেয়া হয়নি। ব্যাংকারদের মনোভাবের কারণে এটি হয়েছে। তারা মনে করছেন ছোট ঋণের পরিচালনা ব্যয় ও সময় অনেক বেশি। যে কারণে বড় ঋণের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। এখানে সংস্কার আনা দরকার। তিনি আরও বলেন, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু কর্মসংস্থান যুক্ত জিডিপি না হলে এর গুণগত মান ঠিক থাকবে না। এজন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কেএম মুরশিদ বলেন, সমাজে বৈষম্য বাড়লেও সাধারণ মানুষ এ নিয়ে কোনো কথা বলছেন না। তারা কথা বলছে চাকরি নেই, বেতন কম, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেশি, আবাসন সমস্যা ইত্যাদি। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বৈষম্য ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কারণ সরকারের প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে কাজ করছে না। এগুলো ঠিক করতে হলে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দরকার। না হলে এর সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারাকাত বলেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ডাবল হলেও লাভ হবে না, যদি এর সুফল নিচের দিকে না যায়। বৈষম্য নিরসন করতে হবে। এ জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্র দরকার। রাষ্ট্রের শক্তিশালী ভূমিকার দরকার। তিনি আরও বলেন, বৈষম্য নিরসনে সামাজিক সেবা খাতগুলোকে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে না।
সেমিনারে আয় ও ধন বৈষম্য কমাতে ১৩টি সুপারিশ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মানবৃদ্ধি, আধুনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন। এছাড়া সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, প্রবীণদের পেনশন, বেকার ভাতা, ভর্তুকি মূল্যে রেশন, প্রবীণদের জন্য অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা (আবাসন, খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য) চালুর কথা বলা হয়। গণপরিবহন সুবিধা, দুর্নীতি দমনে জিরো টলারেন্স, গ্রাম-শহর বৈষম্য নিরসন, ন্যূনতম মজুরির হার নির্ধারণ, নিম্নবিত্তদের আবাসন ব্যবস্থা, কৃষকের ন্যায্যমূল্যে পেতে কার্যকরী নীতি, ব্যবসায়ীদের মুনাফাবাজি বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশও করা হয়।