ঢাকা ০৭:৫১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বন্যাদুর্গত কৃষকদের দুর্বিষহ জীবন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০২:১২:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ অগাস্ট ২০১৯
  • ২২৪ বার

গরের মইদ্দে গলা পানি আছিল, বউ পোলাপাইন নিয়া যামু কুনু, তাই সড়কের পাড়ে পলিথিন দিয়া গর বানাইয়া আছি ১ মাস ধইরা। দিনে বেলায় মেলা গরম আর রাইতে বৃষ্টি অইলে মনয় পলিথিন উড়াইয়া নিয়া গেল। আমাগো কেউ দেখবার আহে না। একবার ৩ দরা (১৫ কেজি) চাইল পাইছিলাম।’ এভাবেই নিজের দুঃখের বর্ণনা দেন বন্যা কবলিত আফাজ উদ্দিন শেখ (৫৫)। তিনি বন্যার কারণে পরিবারবর্গ নিয়ে টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে কালিহাতীর সরাতৈল নামক স্থানে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

একইস্থানে ভাসমান অবস্থায় থাকা বর্গাচাষী আবদুুর রশিদের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘এবার তিলের হাতে আমন বুনছিলাম। বন্যার পানিতে সব খাইয়া গেছে। এহন আমাগো ৪ ম্যায়া পোলা নিয়া চলাই কষ্ট।

লাভতো অইলনা আবার মেলা লোকসান।’ এভাবেই বন্যায় অনেক পরিবার তাদের সহায় সম্বল হারিয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।

রাক্ষুসী যমুনা নদীর তীরবর্তী টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর, কালিহাতী, টাঙ্গাইল সদর, নাগরপুর, দেলদুয়ার উপজেলায় এবার বন্যায় অসংখ্য মানুষের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠ।

বন্যার পানি বর্তমানে কমতে শুরু করেছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ সহযোগিতা চলমান থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।


যমুনা তীরবর্তী গড়িলাবাড়ী এলাকার লাইলী বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী মারা গেছে। আমরা গরিব মানুষ। বন্যায় কোনমতে বেঁচে আছি। বাচ্চাদের নানারকম রোগব্যাধি হইতাছে।’ ৭০ বছর বয়সী জনাব আলী বলেন, ‘এহন পর্যন্ত ৮ বার বাড়ি পালটাইছি।’

নদীর তীরে দেখা হয়, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার নদী তীরবর্তী চরপৌলী গ্রামের মোশারফ হোসেনের (৬০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের শত বিঘা জমি ছিল। আমরা ছিলাম এলাকার বড় গিরস্থ। কিন্তু যমুনা নদীই আমাদের সর্বনাশ করে দিছে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এবারের বন্যায় টাঙ্গাইলের সখিপুর ছাড়া ১১টি উপজেলার ১৫ হাজার ১৩৬ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। ফসলের মধ্যে রোপা আমন, বোনা আমন, আউশ, রোপা আমন বীজতলা, সবজি ও কলা উল্লেখযোগ্য।

জেলার ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ লক্ষ ৫৭ হাজার ৮১১টি। ক্ষতির পরিমাণ ১৪১ কেটি ২৫ লক্ষ টাকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে ভূঞাপুর উপজেলায়। ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জানান, ৬৮৬টি পুকুরের চাষীর প্রায় ৫ কোটি টাকার মাছের ক্ষতি হয়েছে এবারের বন্যায়।


একদিকে বন্যার পানিতে ফসলের ক্ষতি, অন্যদিকে তীরবর্তী এলাকায় নিয়মিত ভাঙন। গ্রামীণ রাস্তাঘাট, অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হয়েছে ভীষণ ক্ষতি। বন্যার পরবর্তী সময় দেখা দিচ্ছে, পানিবাহিত রোগ।  এবারের বন্যায় টাঙ্গাইলে কৃষকের স্বপ্ন ভেসে গেছে বন্যা জলে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা শুষ্ক মওসুমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি করেছেন। সেইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থদের সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়ার  দাবিও করেন কৃষকরা।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গাইলে স্থায়ীভাবে ২২ কিলোমিটার এলাকায় নদীভাঙন রোধে গাইড বাঁধ নির্মাণের জন্য ২১৯৩ কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্পের প্রপোজাল তৈরি করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন হলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

বন্যাদুর্গত কৃষকদের দুর্বিষহ জীবন

আপডেট টাইম : ০২:১২:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ অগাস্ট ২০১৯

গরের মইদ্দে গলা পানি আছিল, বউ পোলাপাইন নিয়া যামু কুনু, তাই সড়কের পাড়ে পলিথিন দিয়া গর বানাইয়া আছি ১ মাস ধইরা। দিনে বেলায় মেলা গরম আর রাইতে বৃষ্টি অইলে মনয় পলিথিন উড়াইয়া নিয়া গেল। আমাগো কেউ দেখবার আহে না। একবার ৩ দরা (১৫ কেজি) চাইল পাইছিলাম।’ এভাবেই নিজের দুঃখের বর্ণনা দেন বন্যা কবলিত আফাজ উদ্দিন শেখ (৫৫)। তিনি বন্যার কারণে পরিবারবর্গ নিয়ে টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে কালিহাতীর সরাতৈল নামক স্থানে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

একইস্থানে ভাসমান অবস্থায় থাকা বর্গাচাষী আবদুুর রশিদের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘এবার তিলের হাতে আমন বুনছিলাম। বন্যার পানিতে সব খাইয়া গেছে। এহন আমাগো ৪ ম্যায়া পোলা নিয়া চলাই কষ্ট।

লাভতো অইলনা আবার মেলা লোকসান।’ এভাবেই বন্যায় অনেক পরিবার তাদের সহায় সম্বল হারিয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।

রাক্ষুসী যমুনা নদীর তীরবর্তী টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর, কালিহাতী, টাঙ্গাইল সদর, নাগরপুর, দেলদুয়ার উপজেলায় এবার বন্যায় অসংখ্য মানুষের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠ।

বন্যার পানি বর্তমানে কমতে শুরু করেছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ সহযোগিতা চলমান থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।


যমুনা তীরবর্তী গড়িলাবাড়ী এলাকার লাইলী বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী মারা গেছে। আমরা গরিব মানুষ। বন্যায় কোনমতে বেঁচে আছি। বাচ্চাদের নানারকম রোগব্যাধি হইতাছে।’ ৭০ বছর বয়সী জনাব আলী বলেন, ‘এহন পর্যন্ত ৮ বার বাড়ি পালটাইছি।’

নদীর তীরে দেখা হয়, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার নদী তীরবর্তী চরপৌলী গ্রামের মোশারফ হোসেনের (৬০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের শত বিঘা জমি ছিল। আমরা ছিলাম এলাকার বড় গিরস্থ। কিন্তু যমুনা নদীই আমাদের সর্বনাশ করে দিছে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এবারের বন্যায় টাঙ্গাইলের সখিপুর ছাড়া ১১টি উপজেলার ১৫ হাজার ১৩৬ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। ফসলের মধ্যে রোপা আমন, বোনা আমন, আউশ, রোপা আমন বীজতলা, সবজি ও কলা উল্লেখযোগ্য।

জেলার ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ লক্ষ ৫৭ হাজার ৮১১টি। ক্ষতির পরিমাণ ১৪১ কেটি ২৫ লক্ষ টাকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে ভূঞাপুর উপজেলায়। ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জানান, ৬৮৬টি পুকুরের চাষীর প্রায় ৫ কোটি টাকার মাছের ক্ষতি হয়েছে এবারের বন্যায়।


একদিকে বন্যার পানিতে ফসলের ক্ষতি, অন্যদিকে তীরবর্তী এলাকায় নিয়মিত ভাঙন। গ্রামীণ রাস্তাঘাট, অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হয়েছে ভীষণ ক্ষতি। বন্যার পরবর্তী সময় দেখা দিচ্ছে, পানিবাহিত রোগ।  এবারের বন্যায় টাঙ্গাইলে কৃষকের স্বপ্ন ভেসে গেছে বন্যা জলে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা শুষ্ক মওসুমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি করেছেন। সেইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থদের সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়ার  দাবিও করেন কৃষকরা।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গাইলে স্থায়ীভাবে ২২ কিলোমিটার এলাকায় নদীভাঙন রোধে গাইড বাঁধ নির্মাণের জন্য ২১৯৩ কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্পের প্রপোজাল তৈরি করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন হলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে।