ঢাকা ০২:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রত্যক্ষদর্শী রাখা যাবে না, ৭ জনকেই গুম করো

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:১৩:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ মে ২০১৫
  • ৪৩২ বার

আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে র‌্যাব থেকে চাকরিচ্যুত মেজর আরিফ বলেছেন, সাত খুনের ঘটনায় অপহরণ থেকে শুরু করে হত্যা এবং লাশ গুম করা হয় লেফটেন্যন্ট কমান্ডার এম এম রানার নেতৃত্বে।

 

অপহরণের পরে এক পর্যায়ে র‌্যাব-১১ এর তৎকালীন সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মেজর আরিফকে বলেন, ‘কোনো প্রত্যক্ষদর্শী রাখা যাবে না, সাত জনকেই গুম করে ফেলো।’

 

র‌্যাবের এডিজি কর্নেল জিয়াউল আহসান নূর হোসেনকেও মেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে নির্দেশ অনুযায়ী নূর হোসেনকে মারতে নারায়ণগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিটাগাং রোড রেকি করে মেজর আরিফ ও লে. কমান্ডার রানা।

 

আদালতে নিজ অপরাধ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় মেজর আরিফ হোসেন যে জবানবন্দি প্রদান করেছেন, তা থেকে বের হয়ে এসেছে এসব তথ্য। গত ২০১৪ এর ৪ জুন নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে এম মহিউদ্দিনের আদালতে মেজর আরিফ এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।

 

চার্জশীট প্রদানের আগে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রকাশ না করার নিয়ম থাকায় তা এতদিন জানা যায়নি। গত ১১ মে মামলার চার্জশীট প্রদান করা হয়। এরপর এই মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াৎ হোসেনের কাছ থেকে সাংবাদিকরা মেজর আরিফের জবানবনন্দির কপিটি সংগ্রহ করেন।

 

জবানবন্দিতে মেজর আরিফ যা বলেছেন পাঠকদের জন্য এখানে হুবুহু তুলে দেওয়া হলো- ‘২০১৪ সালের মার্চ মাসে আদমজী নগরে অবস্থিত র‌্যাব-১১ এর হেডকোয়ার্টারে আমাদের অফিসারদের কনফারেন্স ছিল। ঐ কনফারেন্সে আমাদের সিও লেফট্যানেন্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহম্মদ কাউন্সিলর নজরুলকে আমাকে টার্গেট হিসেবে দেন। লেফট্যান্ট কমান্ডার রানাকে নির্দেশ দেওয়া হয় টার্গেট নজরুলকে ধরার ক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করার জন্য। এরপর আমি ও রানা স্যার মিলে একাধিকবার নজরুলকে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই।

 

ঐ সময় নজরুলকে ধরার জন্য সঠিক কোনো তথ্য পাচ্ছিলাম না। তখন আমরা নজরুলের প্রতিপক্ষ অপর কাউন্সিলর নূর হোসেনকে সোর্স হিসেবে ব্যাবহার করি। ২৭ এপ্রিল সকাল ১০টায় নূর হোসেন আমাকে ফোন করে বলে যে, নজরুল আজকে নারায়ণগঞ্জ কোর্টে হাজিরা দিতে এসেছে। তাৎক্ষণিকভাবে এই খবরটি সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহম্মদকে জানালে তখনই আমাকে এবং রানা স্যারকে নজরুলকে ধরার জন্য অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন।

 

সকাল সাড়ে ১০টায় অভিযানের বিষয়ে রানা স্যারের সঙ্গে কথা বলি এবং নীল রংয়ের মাইক্রোবাস নিয়ে টিমসহ কোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। আমি আমার টিমের সদস্য হাবিলদার এমদাদ, এসআই পূর্নেন্দু বালা, নায়েক দেলোয়ার (ড্রাইভার), নায়েক বেলাল, নায়েক হীরা, নায়েক নাজিম, সিপাহী তৈয়ব, সৈনিক আলীম, সৈনিক আলামিন, সৈনিক মহিউদ্দীন, কনস্টেবল শিহাব মাইক্রোবাসে করে রওনা হই। বেলা ১১টায় কোর্টে পৌঁছে হাবিলদার এমদাদ, নায়েক বেলাল এবং সিপাহী তৈয়বকে কোর্টে পাঠাই নজরুলের গতিবিধি নজরদারী করার জন্য।

 

আমরা কোর্টের বাইরে রাস্তার পশ্চিম পাশে অপেক্ষা করছিলাম। বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে রানা স্যারের টিমের ৭/৮ জন সদস্য আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সাড়ে ১১টায় রানা স্যার নিজ গাড়িতে এসে আমাদের মাইক্রোবাসে উঠে আমার পাশের সিটে বসেন। আমি তাকে জানাই নজরুলের সঙ্গে ১৫/১৬ জন সহযোগী আছে। রানা স্যার সিনিয়র হওয়ার কারণে তখন তিনি অপারেশন কমান্ডার হয়ে যান। ঐ সময় রানা স্যার প্ল্যান করেন যে, রুটিন পেট্রোল টিমের সদস্যদের দিয়ে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের অদূরে সিটি কর্পোরেশনের গেটের কাছে ফাঁকা এলাকায় নজরুলের গাড়ি থামাবেন।

 

বেলা ১টার দিকে নজরুল একটি সাদা প্রাইভেট কারে কোর্ট থেকে বের হয়ে সাইনবোর্ডের দিকে রওনা হন। তখন আমি ও রানা স্যার দুইটি মাইক্রোবাসে নজরুলের গাড়ির পিছু নেই। বেলা দেড়টার দিকে পেট্রলটিম চেকপোস্ট বসিয়ে সিটি কর্পোরেশনের গেটের কাছে নজরুলের গাড়িটিকে থামায়। তখন আমরা পেছন থেকে ঘিরে নজরুরের গাড়ি থেকে নজরুলসহ পাঁচ জনকে আমাদের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে কাচপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেই।

 

দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে রূপগঞ্জের তারাবো এলাকায় পৌঁছে সিও স্যারকে রিপোর্ট করি যে নজরুলসহ সাতজনকে আটক করা হয়েছে। তখন সিও স্যার (লে. কর্নেল তারেক সাঈদ) বলেন, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী রাখা যাবে না। সাত জনকেই গুম করে ফেল।

 

সিও স্যারের আদেশ পেয়ে আমি আমার ক্যাম্পের বেলালকে বলি সাত সেট ইটের বস্তা তৈরি করার জন্য। তারাবো আসার পথে রানা স্যার চিটাগাং রোডে মাইক্রোবাস থেকে নেমে সিও স্যারের অফিসে চলে যান। বেলা আড়াইটার দিকে আমি নরসিংদী র‌্যাব ক্যাম্পের কাছাকছি পৌঁছাই। ঐ সময় নরসিংদীর ক্যাম্প কমান্ডার সুরুজকে ফোন করি এবং তার সঙ্গে দেখা করি।

 

বিকেল ৪টার দিকে শিবপুর উপজেলার দিকে চলে যাই এবং নির্জন একটি জায়গায় অপেক্ষা করতে থাকি। রাত ৮টার দিকে সিও স্যারকে জানাই আমরা নারায়ণগঞ্জে আসতে চাচ্ছি। তখন সিও স্যার বলেন যে, রাস্তায় পুলিশের কড়া নজরদারী চলছে। আমি একটি তিন টনি ট্রাক পাঠাচ্ছি। তোমরা ঐ ট্রাকে করে আসামিদের নিয়ে এসো।

 

রাত ৯টায় নরসিংদীর বেলানগর পৌঁছে আমি সৈনিক মহিউদ্দিনকে বলি সাতটি সাকসা (চেতনানাশক ইনজেকশন) এবং একটি সিরিঞ্জ কিনে আনতে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে কাচপুর পৌঁছে একটি পরিত্যাক্ত পেট্রল পাম্পে অপেক্ষা করতে থাকি। সিও স্যারকে ফোন করে বলি রাস্তায় পুলিশের কড়া নজরদারী চলছে। এ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ শহরে ঢোকা আমার জন্য কঠিন। রানা স্যার যেন ট্রলারটি কাচপুর ব্রিজের নিচে পঠিয়ে দেন। তার কিছুক্ষণ পরে রানা স্যার সিও স্যারের অফিসের ফোন থেকে ফোন করে আমাকে জানান, কাচপুর ব্রিজের নিচেই ট্রলার থাকবে।

 

তারপর আমি নূর হোসেনকে ফোন করে বলি কাচপুর ব্রিজের নিচে যেনো কোনো মানুষের জটলা না থাকে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে বেলালকে ফোন করে বলি ইটের প্যাকেটগুলো কাচপুর ব্রিজের নিচে নিয়ে আসতে। রাত সাড়ে ১২ টায় রানা স্যারের ট্রলারটি কাচপুর ব্রিজের নিচে আসে। আমি এমদাদকে ইটের প্যাকেটগুলো ট্রলারে লোড করতে বলি। তারপর আমি সিও স্যারকে চুড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে বলি যে সাত জনকে গুম করার বিষয়ে আমি প্রস্তুত।

 

ঐ সময় সিও আমাকে বলেন, ওকে গো অ্যাহেড। সিও স্যারের আদেশ পেয়ে আমি নায়েক হীরা, সিপাহী তৈয়বকে বলি সাত জনকে সাকসা ইনজেকশন পুশ করতে। ইনজেকশন পুশ করার পর নায়েক বেলাল, নায়েক হীরা, সিপাহী তৈয়ব, এসআই পূর্নেন্দু বালা, সৈনিক আলামিন, সৈনিক তাজুল, কনস্টেবল শিহাব ও সৈনিক আলীম এই আটজন মিলে আটককৃত সাতজনের মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং আমাকে অবহিত করে। তারপর আমি ডেডবডিগুলো ট্রলারে লোড করার জন্য বলি।

 

আনুমানিক রাত আড়াইটায় ট্রলার নিয়ে মেঘনা নদীর মোহনায় পৌঁছে আমার টিমের সদস্যরা প্রতিটি ডেডবডির সঙ্গে একসেট ইটের বস্তা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। নদীতে লাশ ফেলে ফেরত আসার সময় র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি অপস) কর্নেল জিয়াউল আহসান স্যার আমার মোবাইলে ফোন করেন। ঐ সময় আমি স্যারের ফোন না ধরে আমার সিও স্যারকে ফোন করে বলি এডিজি স্যার আমাকে কেন ফোন করছেন? তখন সিও স্যার বলেন আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলে তোমাকে জানাচ্ছি।

 

কিছুক্ষণ পরে সিও স্যার ফোন করে আমাকে জানান, তোমাকে তোমার টিমের সদস্যসহ এডিজি স্যারের অফিসে যেতে বলেছেন। রাত ৩টায় ট্রলারে করে নারায়ণগঞ্জ ঘাটে পৌঁছে দেখি ঘাটে সিও স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর আমি সিও স্যারের সঙ্গে কথা বলে র‌্যাব হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই।

 

রাত ৪টায় অফিসে পৌঁছলে এডিজি কর্নেল জিয়াউল আহসান স্যার আমাকে বলেন, আরিফ কি হয়েছে? নজরুল কোথায়? স্যারের প্রশ্ন শুনে আমি একটু অবাক হই। তারপর আমি বলি নজরুল কোথায় আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? পুনরায় একই প্রশ্ন করলে আমি বলি যে আমি যা করি সিও স্যারের আদেশে করি। সো এ বিষয়ে যা জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন আপনি সিও স্যারকে জিজ্ঞাসা করেন।

 

তারপর এডিজি স্যার সিও স্যারকে ফোন দেন এবং ফোনেই সিও স্যারের সঙ্গে আমাকে কথা বলান। তখন আমি সিও স্যারকে বলি যে, স্যার নজরুল কোথায় এই কথা এডিজি স্যার আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন? তখন সিও স্যার বলেন, এডিজি স্যার কেন এমন করছে তা বুঝতে পারছি না। ঠিক আছে তুমি ঘটনা বর্ণনা করে আস। তারপর আমি সমস্ত ঘটনা এডিজি স্যারকে বলার পর তিনি আমাকে চলে যেতে বলেন।

 

ভোর সাড়ে ৫টায় নারায়ণগঞ্জে এসে সিও স্যারকে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে বাসায় চলে যাই। ২৯ এপ্রিল বেলা ১২টার দিকে সিও স্যার আমাকে ফোন করে বলেন যে, এডিজি স্যার আমাকে এবং সিও স্যারকে তার অফিসে যেতে বলেছেন। তারপর আমি এবং সিও স্যার র‌্যাব হেড কোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। দেড়টার দিকে হেড কোয়ার্টারে পৌঁছলে এডিজি স্যার প্রথমে সিও স্যারের সঙ্গে কিছু কথা বলেন। তারপর আমাকে ডেকে পাঠান। এডিজি স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, আমি নূর হোসেনের সাথে কি কি কথা বলেছি? নূর হোসেন কতদিন ধরে নজরুলের ব্যাপারে ইনফরমেশন দিয়েছে, ব্যাংক বিষয়ে নূর হোসেনের সঙ্গে কি কথা হয়েছে? লাশগুলো কি করেছি?

 

তখন আমি বলি নূর হোসেন প্রায় দেড়মাস যাবৎ নজরুলের বিষয়ে তথ্য দিয়ে আসছিল। আর ব্যাংকের বিষয়ে নূর হোসেনের একজন বিশ্বস্ত লোকের অ্যাকাউন্ট নাম্বার দিতে বলেছিলাম। আর লাশগুলো মেঘনাতে ফেলে দিয়েছি। আমার কথা বলা শেষে এডিজি স্যার বলেন যে, আজকের মধ্যেই নূর হোসেনকে মেরে ফেলতে হবে। তখন আমি বলি নজরুলের কারণে নারায়ণগঞ্জ গরম হয়ে হয়ে আছে। এ অবস্থায় নূর হোসেনকে মারলে পরিস্থিতি কন্ট্রোল করা কঠিন হবে। তারপর এডিজি সিওকে বলেন এ কাজটা তোমাকে করতে হবে।

 

তারপর আমি এবং সিও স্যার নারায়ণগঞ্জে চলে আসি। তারপর সিও স্যার আমাকে এবং রানা স্যারকে চিটাগাং রোড রেকি করতে পাঠায়। আনুমানিক বিকাল ৫টার দিকে সিও স্যার আমাকে ফোন করে অফিসে যেতে বলেন। অফিসে যাওয়ার পর আমরা জানতে পারলাম আমাদের র‌্যাব হেডকোয়ার্টারে ক্লোজ করা হয়েছে। রাত আটটায় হেডকোয়ার্টারে পৌঁছাই এবং মুভ অর্ডার নিয়ে রাতেই মাতৃবাহিনীতে যোগদান করি। পরদিন স্বপরিবারে নারায়ণগঞ্জ হতে ঢাকা সেনানিবাসে চলে যাই।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

প্রত্যক্ষদর্শী রাখা যাবে না, ৭ জনকেই গুম করো

আপডেট টাইম : ০৪:১৩:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ মে ২০১৫

আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে র‌্যাব থেকে চাকরিচ্যুত মেজর আরিফ বলেছেন, সাত খুনের ঘটনায় অপহরণ থেকে শুরু করে হত্যা এবং লাশ গুম করা হয় লেফটেন্যন্ট কমান্ডার এম এম রানার নেতৃত্বে।

 

অপহরণের পরে এক পর্যায়ে র‌্যাব-১১ এর তৎকালীন সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মেজর আরিফকে বলেন, ‘কোনো প্রত্যক্ষদর্শী রাখা যাবে না, সাত জনকেই গুম করে ফেলো।’

 

র‌্যাবের এডিজি কর্নেল জিয়াউল আহসান নূর হোসেনকেও মেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে নির্দেশ অনুযায়ী নূর হোসেনকে মারতে নারায়ণগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিটাগাং রোড রেকি করে মেজর আরিফ ও লে. কমান্ডার রানা।

 

আদালতে নিজ অপরাধ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় মেজর আরিফ হোসেন যে জবানবন্দি প্রদান করেছেন, তা থেকে বের হয়ে এসেছে এসব তথ্য। গত ২০১৪ এর ৪ জুন নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে এম মহিউদ্দিনের আদালতে মেজর আরিফ এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।

 

চার্জশীট প্রদানের আগে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রকাশ না করার নিয়ম থাকায় তা এতদিন জানা যায়নি। গত ১১ মে মামলার চার্জশীট প্রদান করা হয়। এরপর এই মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াৎ হোসেনের কাছ থেকে সাংবাদিকরা মেজর আরিফের জবানবনন্দির কপিটি সংগ্রহ করেন।

 

জবানবন্দিতে মেজর আরিফ যা বলেছেন পাঠকদের জন্য এখানে হুবুহু তুলে দেওয়া হলো- ‘২০১৪ সালের মার্চ মাসে আদমজী নগরে অবস্থিত র‌্যাব-১১ এর হেডকোয়ার্টারে আমাদের অফিসারদের কনফারেন্স ছিল। ঐ কনফারেন্সে আমাদের সিও লেফট্যানেন্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহম্মদ কাউন্সিলর নজরুলকে আমাকে টার্গেট হিসেবে দেন। লেফট্যান্ট কমান্ডার রানাকে নির্দেশ দেওয়া হয় টার্গেট নজরুলকে ধরার ক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করার জন্য। এরপর আমি ও রানা স্যার মিলে একাধিকবার নজরুলকে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই।

 

ঐ সময় নজরুলকে ধরার জন্য সঠিক কোনো তথ্য পাচ্ছিলাম না। তখন আমরা নজরুলের প্রতিপক্ষ অপর কাউন্সিলর নূর হোসেনকে সোর্স হিসেবে ব্যাবহার করি। ২৭ এপ্রিল সকাল ১০টায় নূর হোসেন আমাকে ফোন করে বলে যে, নজরুল আজকে নারায়ণগঞ্জ কোর্টে হাজিরা দিতে এসেছে। তাৎক্ষণিকভাবে এই খবরটি সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহম্মদকে জানালে তখনই আমাকে এবং রানা স্যারকে নজরুলকে ধরার জন্য অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন।

 

সকাল সাড়ে ১০টায় অভিযানের বিষয়ে রানা স্যারের সঙ্গে কথা বলি এবং নীল রংয়ের মাইক্রোবাস নিয়ে টিমসহ কোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। আমি আমার টিমের সদস্য হাবিলদার এমদাদ, এসআই পূর্নেন্দু বালা, নায়েক দেলোয়ার (ড্রাইভার), নায়েক বেলাল, নায়েক হীরা, নায়েক নাজিম, সিপাহী তৈয়ব, সৈনিক আলীম, সৈনিক আলামিন, সৈনিক মহিউদ্দীন, কনস্টেবল শিহাব মাইক্রোবাসে করে রওনা হই। বেলা ১১টায় কোর্টে পৌঁছে হাবিলদার এমদাদ, নায়েক বেলাল এবং সিপাহী তৈয়বকে কোর্টে পাঠাই নজরুলের গতিবিধি নজরদারী করার জন্য।

 

আমরা কোর্টের বাইরে রাস্তার পশ্চিম পাশে অপেক্ষা করছিলাম। বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে রানা স্যারের টিমের ৭/৮ জন সদস্য আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সাড়ে ১১টায় রানা স্যার নিজ গাড়িতে এসে আমাদের মাইক্রোবাসে উঠে আমার পাশের সিটে বসেন। আমি তাকে জানাই নজরুলের সঙ্গে ১৫/১৬ জন সহযোগী আছে। রানা স্যার সিনিয়র হওয়ার কারণে তখন তিনি অপারেশন কমান্ডার হয়ে যান। ঐ সময় রানা স্যার প্ল্যান করেন যে, রুটিন পেট্রোল টিমের সদস্যদের দিয়ে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের অদূরে সিটি কর্পোরেশনের গেটের কাছে ফাঁকা এলাকায় নজরুলের গাড়ি থামাবেন।

 

বেলা ১টার দিকে নজরুল একটি সাদা প্রাইভেট কারে কোর্ট থেকে বের হয়ে সাইনবোর্ডের দিকে রওনা হন। তখন আমি ও রানা স্যার দুইটি মাইক্রোবাসে নজরুলের গাড়ির পিছু নেই। বেলা দেড়টার দিকে পেট্রলটিম চেকপোস্ট বসিয়ে সিটি কর্পোরেশনের গেটের কাছে নজরুলের গাড়িটিকে থামায়। তখন আমরা পেছন থেকে ঘিরে নজরুরের গাড়ি থেকে নজরুলসহ পাঁচ জনকে আমাদের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে কাচপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেই।

 

দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে রূপগঞ্জের তারাবো এলাকায় পৌঁছে সিও স্যারকে রিপোর্ট করি যে নজরুলসহ সাতজনকে আটক করা হয়েছে। তখন সিও স্যার (লে. কর্নেল তারেক সাঈদ) বলেন, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী রাখা যাবে না। সাত জনকেই গুম করে ফেল।

 

সিও স্যারের আদেশ পেয়ে আমি আমার ক্যাম্পের বেলালকে বলি সাত সেট ইটের বস্তা তৈরি করার জন্য। তারাবো আসার পথে রানা স্যার চিটাগাং রোডে মাইক্রোবাস থেকে নেমে সিও স্যারের অফিসে চলে যান। বেলা আড়াইটার দিকে আমি নরসিংদী র‌্যাব ক্যাম্পের কাছাকছি পৌঁছাই। ঐ সময় নরসিংদীর ক্যাম্প কমান্ডার সুরুজকে ফোন করি এবং তার সঙ্গে দেখা করি।

 

বিকেল ৪টার দিকে শিবপুর উপজেলার দিকে চলে যাই এবং নির্জন একটি জায়গায় অপেক্ষা করতে থাকি। রাত ৮টার দিকে সিও স্যারকে জানাই আমরা নারায়ণগঞ্জে আসতে চাচ্ছি। তখন সিও স্যার বলেন যে, রাস্তায় পুলিশের কড়া নজরদারী চলছে। আমি একটি তিন টনি ট্রাক পাঠাচ্ছি। তোমরা ঐ ট্রাকে করে আসামিদের নিয়ে এসো।

 

রাত ৯টায় নরসিংদীর বেলানগর পৌঁছে আমি সৈনিক মহিউদ্দিনকে বলি সাতটি সাকসা (চেতনানাশক ইনজেকশন) এবং একটি সিরিঞ্জ কিনে আনতে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে কাচপুর পৌঁছে একটি পরিত্যাক্ত পেট্রল পাম্পে অপেক্ষা করতে থাকি। সিও স্যারকে ফোন করে বলি রাস্তায় পুলিশের কড়া নজরদারী চলছে। এ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ শহরে ঢোকা আমার জন্য কঠিন। রানা স্যার যেন ট্রলারটি কাচপুর ব্রিজের নিচে পঠিয়ে দেন। তার কিছুক্ষণ পরে রানা স্যার সিও স্যারের অফিসের ফোন থেকে ফোন করে আমাকে জানান, কাচপুর ব্রিজের নিচেই ট্রলার থাকবে।

 

তারপর আমি নূর হোসেনকে ফোন করে বলি কাচপুর ব্রিজের নিচে যেনো কোনো মানুষের জটলা না থাকে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে বেলালকে ফোন করে বলি ইটের প্যাকেটগুলো কাচপুর ব্রিজের নিচে নিয়ে আসতে। রাত সাড়ে ১২ টায় রানা স্যারের ট্রলারটি কাচপুর ব্রিজের নিচে আসে। আমি এমদাদকে ইটের প্যাকেটগুলো ট্রলারে লোড করতে বলি। তারপর আমি সিও স্যারকে চুড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে বলি যে সাত জনকে গুম করার বিষয়ে আমি প্রস্তুত।

 

ঐ সময় সিও আমাকে বলেন, ওকে গো অ্যাহেড। সিও স্যারের আদেশ পেয়ে আমি নায়েক হীরা, সিপাহী তৈয়বকে বলি সাত জনকে সাকসা ইনজেকশন পুশ করতে। ইনজেকশন পুশ করার পর নায়েক বেলাল, নায়েক হীরা, সিপাহী তৈয়ব, এসআই পূর্নেন্দু বালা, সৈনিক আলামিন, সৈনিক তাজুল, কনস্টেবল শিহাব ও সৈনিক আলীম এই আটজন মিলে আটককৃত সাতজনের মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং আমাকে অবহিত করে। তারপর আমি ডেডবডিগুলো ট্রলারে লোড করার জন্য বলি।

 

আনুমানিক রাত আড়াইটায় ট্রলার নিয়ে মেঘনা নদীর মোহনায় পৌঁছে আমার টিমের সদস্যরা প্রতিটি ডেডবডির সঙ্গে একসেট ইটের বস্তা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। নদীতে লাশ ফেলে ফেরত আসার সময় র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি অপস) কর্নেল জিয়াউল আহসান স্যার আমার মোবাইলে ফোন করেন। ঐ সময় আমি স্যারের ফোন না ধরে আমার সিও স্যারকে ফোন করে বলি এডিজি স্যার আমাকে কেন ফোন করছেন? তখন সিও স্যার বলেন আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলে তোমাকে জানাচ্ছি।

 

কিছুক্ষণ পরে সিও স্যার ফোন করে আমাকে জানান, তোমাকে তোমার টিমের সদস্যসহ এডিজি স্যারের অফিসে যেতে বলেছেন। রাত ৩টায় ট্রলারে করে নারায়ণগঞ্জ ঘাটে পৌঁছে দেখি ঘাটে সিও স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর আমি সিও স্যারের সঙ্গে কথা বলে র‌্যাব হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই।

 

রাত ৪টায় অফিসে পৌঁছলে এডিজি কর্নেল জিয়াউল আহসান স্যার আমাকে বলেন, আরিফ কি হয়েছে? নজরুল কোথায়? স্যারের প্রশ্ন শুনে আমি একটু অবাক হই। তারপর আমি বলি নজরুল কোথায় আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? পুনরায় একই প্রশ্ন করলে আমি বলি যে আমি যা করি সিও স্যারের আদেশে করি। সো এ বিষয়ে যা জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন আপনি সিও স্যারকে জিজ্ঞাসা করেন।

 

তারপর এডিজি স্যার সিও স্যারকে ফোন দেন এবং ফোনেই সিও স্যারের সঙ্গে আমাকে কথা বলান। তখন আমি সিও স্যারকে বলি যে, স্যার নজরুল কোথায় এই কথা এডিজি স্যার আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন? তখন সিও স্যার বলেন, এডিজি স্যার কেন এমন করছে তা বুঝতে পারছি না। ঠিক আছে তুমি ঘটনা বর্ণনা করে আস। তারপর আমি সমস্ত ঘটনা এডিজি স্যারকে বলার পর তিনি আমাকে চলে যেতে বলেন।

 

ভোর সাড়ে ৫টায় নারায়ণগঞ্জে এসে সিও স্যারকে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে বাসায় চলে যাই। ২৯ এপ্রিল বেলা ১২টার দিকে সিও স্যার আমাকে ফোন করে বলেন যে, এডিজি স্যার আমাকে এবং সিও স্যারকে তার অফিসে যেতে বলেছেন। তারপর আমি এবং সিও স্যার র‌্যাব হেড কোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। দেড়টার দিকে হেড কোয়ার্টারে পৌঁছলে এডিজি স্যার প্রথমে সিও স্যারের সঙ্গে কিছু কথা বলেন। তারপর আমাকে ডেকে পাঠান। এডিজি স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, আমি নূর হোসেনের সাথে কি কি কথা বলেছি? নূর হোসেন কতদিন ধরে নজরুলের ব্যাপারে ইনফরমেশন দিয়েছে, ব্যাংক বিষয়ে নূর হোসেনের সঙ্গে কি কথা হয়েছে? লাশগুলো কি করেছি?

 

তখন আমি বলি নূর হোসেন প্রায় দেড়মাস যাবৎ নজরুলের বিষয়ে তথ্য দিয়ে আসছিল। আর ব্যাংকের বিষয়ে নূর হোসেনের একজন বিশ্বস্ত লোকের অ্যাকাউন্ট নাম্বার দিতে বলেছিলাম। আর লাশগুলো মেঘনাতে ফেলে দিয়েছি। আমার কথা বলা শেষে এডিজি স্যার বলেন যে, আজকের মধ্যেই নূর হোসেনকে মেরে ফেলতে হবে। তখন আমি বলি নজরুলের কারণে নারায়ণগঞ্জ গরম হয়ে হয়ে আছে। এ অবস্থায় নূর হোসেনকে মারলে পরিস্থিতি কন্ট্রোল করা কঠিন হবে। তারপর এডিজি সিওকে বলেন এ কাজটা তোমাকে করতে হবে।

 

তারপর আমি এবং সিও স্যার নারায়ণগঞ্জে চলে আসি। তারপর সিও স্যার আমাকে এবং রানা স্যারকে চিটাগাং রোড রেকি করতে পাঠায়। আনুমানিক বিকাল ৫টার দিকে সিও স্যার আমাকে ফোন করে অফিসে যেতে বলেন। অফিসে যাওয়ার পর আমরা জানতে পারলাম আমাদের র‌্যাব হেডকোয়ার্টারে ক্লোজ করা হয়েছে। রাত আটটায় হেডকোয়ার্টারে পৌঁছাই এবং মুভ অর্ডার নিয়ে রাতেই মাতৃবাহিনীতে যোগদান করি। পরদিন স্বপরিবারে নারায়ণগঞ্জ হতে ঢাকা সেনানিবাসে চলে যাই।’