ঢাকা ১১:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জীবন ও মরণের রহস্য সন্ধান

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:২৫:০২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৭ অগাস্ট ২০১৯
  • ২২৯ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমাদের ঘুম ছোট মৃত্যু আর জেগে ওঠা ছোট হাশর। এ ছোটকে দিয়ে বড় মৃত্যু ও বড় হাশরকে উপলব্ধি কর। এখানে তোমার কর্মলিপি গোপন থাকে; কিন্তু সেখানে প্রকাশিত হবে। কম্পিউটারের মেমোরিতে তথ্যগুলো অদৃশ্য থাকে; কিন্তু প্রিন্ট নিলে প্রকাশিত হয়। আমাদের আমলনামাও এখানে কল্পনার মতো অদৃশ্য। সেখানে তা প্রকাশ পাবে আকৃতিতে। বিষয়টি বোঝার জন্য একটি উপমা নাও

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

এক লোক বলছিল, জগৎটা কত সুন্দর হতো; যদি এখানে মৃত্যুর প্রশ্ন না থাকত। তার কথা শুনে আরেকজন বলল, মৃত্যু যদি না থাকত, এই জগৎ ও জীবন ঘাসপাতার চেয়েও অধম হতো। তখন জগতে তোমার অবস্থা হতো পরিত্যক্ত খড়স্তূপের মতো। খড় যতক্ষণ মাড়াই করা না হয়, ধান-গম খড়ের সঙ্গে একাকার থাকে। মৃত্যুই মানুষের রুহকে দেহ থেকে আলাদা করে। মৃত্যুর মাড়াই হলেই কে ভালো বা মন্দ পরীক্ষিত হয়। কাজেই মৃত্যুকে তারাই অপছন্দ করে, যাদের দূরদৃষ্টি নেই। সৃষ্টিলোকের ব্যবস্থাপনার দিকে গভীরভাবে তাকালে বোঝা যায়, এখানে যত পরিবর্তন-বিবর্তন আসে তা মৃত্যু ও বিনাশের পর ফের জীবন লাভের চলমান প্রক্রিয়ামাত্র। ভাঙার পর গড়ার প্রক্রিয়া না থাকলে জীবনে পূর্ণতা আসত না। তাই জগৎ ও জীবনের পূর্ণতা এবং উন্নতির জন্য মৃত্যু ও ধ্বংস অপরিহার্য।

মওলানা বলেন, পৃথিবীতে দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত যে জীবন, তা আসলে মৃত্যু। এই মৃত্যুকে তুমি জীবন মনে করে ধোঁকায় পড়ে আছ। আর প্রকৃত জীবনকে মনে কর মরণ। এটি তোমার মিথ্যা বুদ্ধির প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। মওলানা এখন আল্লাহর কাছে পানাহ চান এমন বুদ্ধির খপ্পর থেকে। প্রভু হে! দুনিয়ার প্রতারণাকে তার স্বরূপে আমাকে দেখাও। হাদিসের ভাষায় দোয়াটির ভাষ্য, ‘প্রভু হে! সত্যকে আমায় সত্য হিসেবে দেখাও আর তাকে অনুসরণ করার তৌফিক দাও এবং মিথ্যাকে দেখাও মিথ্যারূপে আর তা থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক আমাকে দাও।’

তাই যারা মৃত্যুবরণ করেছে তারা প্রকৃত জীবনের আঙিনায় চলে গেছে। এ কারণে তাদের কেউই মৃত্যুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে না; বরং তাদের আফসোস হলো, হায়! যদি আবার দুনিয়ায় ফিরে যেতে পারতাম আর এ স্থায়ী জগতের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করে আনতে পারতাম। তাদের অনুভূতি হলো, দুনিয়ায় যতদিন ছিলাম বদ্ধ কুয়ায় আবদ্ধ ছিলাম, সেখান থেকে উদ্ধার পেয়ে এখন উপভোগ করছি বিশাল উন্মুক্ত ময়দানের আলো-বাতাস। মায়ের গর্ভে মানব শিশু ভাবে, মায়ের উদরই আমার সুখের জগৎ। তবে জন্মের পর বুঝতে পারে সংকীর্ণ মাতৃগর্ভের বন্দিদশা ছেড়ে এক বিশাল বিচিত্র জগতে বিচরণরত। মৃত্যুর পর মানুষও বুঝতে পারবে, আল্লাহর সন্নিধানে আসন লাভের যে ওয়াদা দেওয়া হয়েছে কোরআনে তা কিছুমাত্র অবাস্তব বা মিথ্যা নয়। সেখানকার চিরন্তন সুখ ও সৌভাগ্য চাইলে এখন থেকেই জীবনকে সাজাতে হবে। যদি এ ধরনের প্রস্তুতি তোমার এখনও না থাকে, আজকেই সিদ্ধান্ত নাও, অন্তত দু-একটি পদক্ষেপ গ্রহণ কর। হাদিসে এসেছে, কেয়ামতের দিন প্রত্যেকের প্রতি আদেশ হবে

নাফখে সূর আমর আস্ত আয য়াযদা’নে পাক
কে বর আ’রীদ আই যরা’য়ের সার যে খা’ক
শিঙ্গায় ফুঁক সে তো আল্লাহর তরফে আদেশ
মাটি ফুঁড়ে উঠো আদম সন্তানরা ছাড় এ দেশ।
বা’য আয়াদ জা’নে হারয়্যক দর বদন
হামচো ওয়াক্তে সুবহ হুশ আয়দ বে তন
সেই আহ্বানে প্রত্যেক প্রাণ ফিরে আসবে যার যার দেহে
নিদ্রা শেষে ভোরে হুঁশজ্ঞান ফিরে দেহের খাঁচায় যেভাবে।

মানুষ মারা যায়। তার মানে প্রাণ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কবর জীবনে ও হাশর ময়দানে প্রাণ ফের দেহে ফিরে আসে। তখন দুনিয়ায় কে ভালো বা মন্দ কাজ করেছিল তার চুলচেরা হিসাব হবে। এর নাম হাশর। মওলানা হাশরের দিন বা পরকালের বাস্তবতার পক্ষে কয়েকটি দলিল দিচ্ছেন আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে। আমরা রাতে ঘুমাই। তখন আমাদের প্রাণ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বপ্নের ভুবনে উড়তে থাকে। ভোরবেলা যখন ঘুম ভাঙে প্রাণ আবার ফিরে আসে দেহের গৃহে। তখন আমরা জেগে উঠি, কর্মচঞ্চল হই।

মওলানা বলেন, তোমার ঘুমের কথা চিন্তা কর। ভোরবেলা যখন জাগ্রত হও, তোমার প্রাণ ফিরে আসে দেহের কুঠিরে। প্রতিটি প্রাণ তার নির্দিষ্ট দেহ ঠিকই চেনে। স্বর্ণকারের প্রাণ কখনও ভুলে দরজির দেহে যায় না। আলেমের প্রাণ কখনও ভুল করে জালেমের দেহে প্রবেশ করে না। প্রাণকে এ জ্ঞান দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। এই উপমা থেকে হাশরের বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা কর।
সুবহ হাশরে কুচাক আস্ত আই মুস্তাজীর
হাশরে আকবর রা’ কিয়াস আয ওয়েই বেগীর
ভোরের জাগরণ ছোট্ট হাশর, হে আশ্রয় সন্ধানী
বড় হাশরের পুনঃজীবন লাভ অনুমান কর তেমনি।

রাতের সাময়িক বিচ্ছিন্নতার পর প্রাণ ভোরবেলা ফের দেহের খাঁচায় ফিরে আসে। একে ছোট হাশর বল। মৃত্যুর সময় প্রাণ বিচ্ছিন্ন হয়ে হাশরে ফের উড়ে এসে তোমার দেহের সঙ্গে যুক্ত হবে। একে বল বড় হাশর। প্রাণের এ ফেরার মতো প্রত্যেকের আমলনামাও উড়ে উড়ে আসবে প্রত্যেকের ডান-বাম হাতে। দুনিয়ায় প্রত্যেকের কথা, কাজ বা স্বভাবের ভালো নিখুঁত বিবরণী এ আমলনামা। টেপ রেকর্ডার বা সিসি ক্যামেরার মতো সবকিছু রেকর্ড হচ্ছে আমাদের কাঁধে স্থাপিত ক্যামেরায়। দুজন ফেরেশতা গোপনে এ কাজে নিয়োজিত। হাশরের ময়দানে এ গোপন ফাইল উন্মোচিত হবে। আর তা উড়ে উড়ে প্রত্যেকের ডান বা বাম হাতে এসে পড়বে।

‘তখন যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেওয়া হবে, সে (পরম খুশিতে) বলবে, আমার আমলনামা পড়ে দেখ।’ (সূরা হাক্কা : ১৯)।

‘কিন্তু যার আমলনামা তার বাম হাতে দেওয়া হবে, সে (চরম হতাশায়) বলবে, হায়! আমাকে যদি আমার আমলনামা দেওয়াই না হতো।’ (সূরা হাক্কা : ২৫)।

কৃপণতা বা দানশীলতা, তাকওয়া বা পাপাচার জীবনভরের সব কাজের হিসাবের খাতা উড়ে আসবে প্রত্যেকের কাছে। যদি তুমি তোমার স্বভাবকে শুদ্ধ করে থাক জাগ্রত হওয়ার পর সেই অবস্থাই তোমার সম্মুখে আসবে। আর যদি গোমরাহি, মন্দ কাজ ও স্বভাবের মধ্যে জীবন কাটিয়ে থাক তার লিপি তুমি বাম হাতে পাবে। মওলানা আরও বলেন, আমাদের ঘুম ছোট মৃত্যু আর জেগে ওঠা ছোট হাশর। এ ছোটকে দিয়ে বড় মৃত্যু ও বড় হাশরকে উপলব্ধি কর। এখানে তোমার কর্মলিপি গোপন থাকে; কিন্তু সেখানে প্রকাশিত হবে। কম্পিউটারের মেমোরিতে তথ্যগুলো অদৃশ্য থাকে; কিন্তু প্রিন্ট নিলে প্রকাশিত হয়। আমাদের আমলনামাও এখানে কল্পনার মতো অদৃশ্য। সেখানে তা প্রকাশ পাবে আকৃতিতে। বিষয়টি বোঝার জন্য একটি উপমা নাও।

নির্মাণশিল্পী বাড়ি নির্মাণের আগে মনের আয়নায় ছক আঁকে। সে ছক দেখা যায় না। পরে যখন গৃহ নির্মাণ করে মনের কল্পিত ছকটিই বাস্তবে আকার ধারণ করে। দুনিয়ায় কৃতকর্মের ফিরিস্তি মনের কল্পনার মতো অদৃশ্য। এটি মাটির ভেতরে বুনে রাখা দানার মতো। শীতকালে এসব দানা প্রাণহীন ‘নাই’ এর মতো হয়ে থাকে। যখন বসন্ত আসে, সূর্যের তেজে বরফ গলে যায়, অদৃশ্য দানাগুলো বিকশিত হয় পত্রপল্লবে। কেয়ামতের দিনের সূর্যও যখন উত্তাপ ছড়াবে মাটির মাঝে লুকায়িত দানার মতো আমাদের আমলনামা উদ্গত হবে। তখন বোঝা যাবে কোনটি সুন্দর সঠিক, কোনটি মন্দ কুৎসিত।

পরকালের বসন্তে গজে ওঠা কিছু উদ্ভিদ প্রাণবন্ত সজীব মুত্তাকি আর কিছু হবে শির অবনত, অপদস্থ, তারা অপরাধী। কোরআন মজিদের ভাষায়, ‘হায় তুমি যদি দেখতে! যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে অধোবদন হয়ে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ও শ্রবণ করলাম, এখন তুমি আমাদের ফের প্রেরণ কর। আমরা সৎকর্ম করব, আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী।’ (সূরা সাজদা : ১২)।

ভয়ে আতঙ্কে তাদের চোখগুলো বিস্ফারিত। আমলনামা বাম হাতে আসে নাকি সে আশঙ্কায় কম্পিত। অবশেষে এক গোনাহগার বান্দার আমলনামা বাম হাতে এলো। যত অপকর্মে আকীর্ণ সেই আমলনামা। বুঝতে পারে দোজখই তার শেষ ঠিকানা। ভয়ে আতঙ্কে তার মুখে রা নেই। সৎকাজের কোনো চিহ্ন নেই তার আমলের খাতায়। ধোঁকাবাজি, পাপ, অনাচার, অবহেলা আমিত্বের অহমিকায় কলুষিত। নিজের অপকর্মের পক্ষে এতকাল যত সাফাই গেয়েছে সব সাফাই আজ পেরেক হয়ে দুই ওষ্ঠ চেপে ধরেছে। চোর যেন হাতেনাতে পাকড়াও। ফেরেশতারা গোয়েন্দা পুলিশের মতো দুনিয়ায় গোপনে তাকে নজরদারিতে রেখেছিল। আজ তারা সশরীরে তার আগে-পিছে পাহারায় নিয়োজিত। ডা-াবেড়ি পরিয়ে চোর ডাকাত জেলহাজতে নেওয়ার মতো হতভাগাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দোজখের দিকে। কিন্তু দোজখের পথে সে ঠেক ধরে। এক পা আগায় তো দুইপা পেছায়। ফেরেশতারা গলাধাক্কা দেয়, হাঁকায় সে বারবার পেছনে তাকায়। তার দুই চোখে অশ্রুর বন্যা। অনুতাপের বেদনায় কলিজা ধড়ফড় করে। কারও বৃথা আশায় বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মুখে কিছু বলে না, চোখের চাহনিতে হাজারো অব্যক্ত বেদনা।

মহান আরশের মালিকের কাছ থেকে তখন আদেশ আসে, দেখ তো এ ছন্নছাড়ার এই দশা কেন? কেন সে বারবার পেছনে তাকায়? তার আমলনামায় তো কোনো সৎকর্ম নেই। রাতজাগা ইবাদত বা দানশীলতার কোনো চিহ্ন নেই। তাকে দোজখেই যেতে হবে, এ কথা সে জানে। এরপরও কেন সে যেতে চায় না, গোঁ ধরেছে? অবিলম্বে মহামহিমকে জানানো হলো।
বন্দা গুয়াদ আনচে ফরমূদী বয়া’ন
সদ চুনানম সদ চুনানাম চদ চুনা’ন
বন্দা বলছে, তুমি যা বলেছ সত্য প্রভু হে আমি
একশগুণ বেশি শতগুণ পাপী তার চেয়েও আমি।

কিন্তু তুমিই তো আমার নিকৃষ্টতম পাপগুলো গোপন রেখেছ। তুমি ‘সাত্তার’ দোষ গোপনকারী হয়ে আমার অপরাধ ঢেকে রেখেছ। আমার আমলনামায় কী লেখা, আমি জানি না, বুঝি না। কুফরি ও ঈমান নিয়ে কখনও ভাবিনি, কল্যাণ-অকল্যাণ চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। এতকিছুর পরও আজ তোমার দয়ার পরশ পাওয়ার আশায় আমার বুকটা আকুল হয়েছে। তোমার দয়া তো কোনো কিছুর বিনিময় স্বরূপ নয়। আমি চাইনি, আমার কোনো যোগ্যতা ছিল না, তারপরও তোমার অজস্র দয়াদানে ভরে দিয়েছ আমাকে। দুনিয়ায় তো আমি চেয়ে আসিনি। তোমার অপার অনুগ্রহে জীবন দিয়েছ, লালন করেছ। আজ আখেরাতে এসে এমন দুর্গতি। বারবার তাকাচ্ছি তোমার দয়ার সাগরে ঢেউ আসে কি না।

বান্দা যখন তার গোনাহখাতা গণনা করে, লজ্জিত-অনুতাপ্ত হয়, তখন আল্লাহর দয়ার সাগরে বান আসে। আল্লাহপাক তখনই বললেন কাই মালায়েক বা’য আরীদাশ বে মা
কে বুদাস্তাশ চশমে দেল সূয়ে রাজা’
হে ফেরেশতারা তাকে নিয়ে এসো আমার কাছে
সে আশায় বুক বেঁধেছে আমার মাগফেরাত পাবে।
আমি কারও পরোয়া করি না, আমার বান্দাকে আমি মাফ করে দিলাম। তার সব পাপের ওপর লালরেখা টেনে দিলাম। আমার রহমতের বরিষণে তার দিলের জমিনে বসন্তের সমারোহ জাগবে। তাকে নিয়ে যাও জান্নাতে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

জীবন ও মরণের রহস্য সন্ধান

আপডেট টাইম : ১১:২৫:০২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৭ অগাস্ট ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমাদের ঘুম ছোট মৃত্যু আর জেগে ওঠা ছোট হাশর। এ ছোটকে দিয়ে বড় মৃত্যু ও বড় হাশরকে উপলব্ধি কর। এখানে তোমার কর্মলিপি গোপন থাকে; কিন্তু সেখানে প্রকাশিত হবে। কম্পিউটারের মেমোরিতে তথ্যগুলো অদৃশ্য থাকে; কিন্তু প্রিন্ট নিলে প্রকাশিত হয়। আমাদের আমলনামাও এখানে কল্পনার মতো অদৃশ্য। সেখানে তা প্রকাশ পাবে আকৃতিতে। বিষয়টি বোঝার জন্য একটি উপমা নাও

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

এক লোক বলছিল, জগৎটা কত সুন্দর হতো; যদি এখানে মৃত্যুর প্রশ্ন না থাকত। তার কথা শুনে আরেকজন বলল, মৃত্যু যদি না থাকত, এই জগৎ ও জীবন ঘাসপাতার চেয়েও অধম হতো। তখন জগতে তোমার অবস্থা হতো পরিত্যক্ত খড়স্তূপের মতো। খড় যতক্ষণ মাড়াই করা না হয়, ধান-গম খড়ের সঙ্গে একাকার থাকে। মৃত্যুই মানুষের রুহকে দেহ থেকে আলাদা করে। মৃত্যুর মাড়াই হলেই কে ভালো বা মন্দ পরীক্ষিত হয়। কাজেই মৃত্যুকে তারাই অপছন্দ করে, যাদের দূরদৃষ্টি নেই। সৃষ্টিলোকের ব্যবস্থাপনার দিকে গভীরভাবে তাকালে বোঝা যায়, এখানে যত পরিবর্তন-বিবর্তন আসে তা মৃত্যু ও বিনাশের পর ফের জীবন লাভের চলমান প্রক্রিয়ামাত্র। ভাঙার পর গড়ার প্রক্রিয়া না থাকলে জীবনে পূর্ণতা আসত না। তাই জগৎ ও জীবনের পূর্ণতা এবং উন্নতির জন্য মৃত্যু ও ধ্বংস অপরিহার্য।

মওলানা বলেন, পৃথিবীতে দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত যে জীবন, তা আসলে মৃত্যু। এই মৃত্যুকে তুমি জীবন মনে করে ধোঁকায় পড়ে আছ। আর প্রকৃত জীবনকে মনে কর মরণ। এটি তোমার মিথ্যা বুদ্ধির প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। মওলানা এখন আল্লাহর কাছে পানাহ চান এমন বুদ্ধির খপ্পর থেকে। প্রভু হে! দুনিয়ার প্রতারণাকে তার স্বরূপে আমাকে দেখাও। হাদিসের ভাষায় দোয়াটির ভাষ্য, ‘প্রভু হে! সত্যকে আমায় সত্য হিসেবে দেখাও আর তাকে অনুসরণ করার তৌফিক দাও এবং মিথ্যাকে দেখাও মিথ্যারূপে আর তা থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক আমাকে দাও।’

তাই যারা মৃত্যুবরণ করেছে তারা প্রকৃত জীবনের আঙিনায় চলে গেছে। এ কারণে তাদের কেউই মৃত্যুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে না; বরং তাদের আফসোস হলো, হায়! যদি আবার দুনিয়ায় ফিরে যেতে পারতাম আর এ স্থায়ী জগতের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করে আনতে পারতাম। তাদের অনুভূতি হলো, দুনিয়ায় যতদিন ছিলাম বদ্ধ কুয়ায় আবদ্ধ ছিলাম, সেখান থেকে উদ্ধার পেয়ে এখন উপভোগ করছি বিশাল উন্মুক্ত ময়দানের আলো-বাতাস। মায়ের গর্ভে মানব শিশু ভাবে, মায়ের উদরই আমার সুখের জগৎ। তবে জন্মের পর বুঝতে পারে সংকীর্ণ মাতৃগর্ভের বন্দিদশা ছেড়ে এক বিশাল বিচিত্র জগতে বিচরণরত। মৃত্যুর পর মানুষও বুঝতে পারবে, আল্লাহর সন্নিধানে আসন লাভের যে ওয়াদা দেওয়া হয়েছে কোরআনে তা কিছুমাত্র অবাস্তব বা মিথ্যা নয়। সেখানকার চিরন্তন সুখ ও সৌভাগ্য চাইলে এখন থেকেই জীবনকে সাজাতে হবে। যদি এ ধরনের প্রস্তুতি তোমার এখনও না থাকে, আজকেই সিদ্ধান্ত নাও, অন্তত দু-একটি পদক্ষেপ গ্রহণ কর। হাদিসে এসেছে, কেয়ামতের দিন প্রত্যেকের প্রতি আদেশ হবে

নাফখে সূর আমর আস্ত আয য়াযদা’নে পাক
কে বর আ’রীদ আই যরা’য়ের সার যে খা’ক
শিঙ্গায় ফুঁক সে তো আল্লাহর তরফে আদেশ
মাটি ফুঁড়ে উঠো আদম সন্তানরা ছাড় এ দেশ।
বা’য আয়াদ জা’নে হারয়্যক দর বদন
হামচো ওয়াক্তে সুবহ হুশ আয়দ বে তন
সেই আহ্বানে প্রত্যেক প্রাণ ফিরে আসবে যার যার দেহে
নিদ্রা শেষে ভোরে হুঁশজ্ঞান ফিরে দেহের খাঁচায় যেভাবে।

মানুষ মারা যায়। তার মানে প্রাণ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কবর জীবনে ও হাশর ময়দানে প্রাণ ফের দেহে ফিরে আসে। তখন দুনিয়ায় কে ভালো বা মন্দ কাজ করেছিল তার চুলচেরা হিসাব হবে। এর নাম হাশর। মওলানা হাশরের দিন বা পরকালের বাস্তবতার পক্ষে কয়েকটি দলিল দিচ্ছেন আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে। আমরা রাতে ঘুমাই। তখন আমাদের প্রাণ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বপ্নের ভুবনে উড়তে থাকে। ভোরবেলা যখন ঘুম ভাঙে প্রাণ আবার ফিরে আসে দেহের গৃহে। তখন আমরা জেগে উঠি, কর্মচঞ্চল হই।

মওলানা বলেন, তোমার ঘুমের কথা চিন্তা কর। ভোরবেলা যখন জাগ্রত হও, তোমার প্রাণ ফিরে আসে দেহের কুঠিরে। প্রতিটি প্রাণ তার নির্দিষ্ট দেহ ঠিকই চেনে। স্বর্ণকারের প্রাণ কখনও ভুলে দরজির দেহে যায় না। আলেমের প্রাণ কখনও ভুল করে জালেমের দেহে প্রবেশ করে না। প্রাণকে এ জ্ঞান দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। এই উপমা থেকে হাশরের বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা কর।
সুবহ হাশরে কুচাক আস্ত আই মুস্তাজীর
হাশরে আকবর রা’ কিয়াস আয ওয়েই বেগীর
ভোরের জাগরণ ছোট্ট হাশর, হে আশ্রয় সন্ধানী
বড় হাশরের পুনঃজীবন লাভ অনুমান কর তেমনি।

রাতের সাময়িক বিচ্ছিন্নতার পর প্রাণ ভোরবেলা ফের দেহের খাঁচায় ফিরে আসে। একে ছোট হাশর বল। মৃত্যুর সময় প্রাণ বিচ্ছিন্ন হয়ে হাশরে ফের উড়ে এসে তোমার দেহের সঙ্গে যুক্ত হবে। একে বল বড় হাশর। প্রাণের এ ফেরার মতো প্রত্যেকের আমলনামাও উড়ে উড়ে আসবে প্রত্যেকের ডান-বাম হাতে। দুনিয়ায় প্রত্যেকের কথা, কাজ বা স্বভাবের ভালো নিখুঁত বিবরণী এ আমলনামা। টেপ রেকর্ডার বা সিসি ক্যামেরার মতো সবকিছু রেকর্ড হচ্ছে আমাদের কাঁধে স্থাপিত ক্যামেরায়। দুজন ফেরেশতা গোপনে এ কাজে নিয়োজিত। হাশরের ময়দানে এ গোপন ফাইল উন্মোচিত হবে। আর তা উড়ে উড়ে প্রত্যেকের ডান বা বাম হাতে এসে পড়বে।

‘তখন যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেওয়া হবে, সে (পরম খুশিতে) বলবে, আমার আমলনামা পড়ে দেখ।’ (সূরা হাক্কা : ১৯)।

‘কিন্তু যার আমলনামা তার বাম হাতে দেওয়া হবে, সে (চরম হতাশায়) বলবে, হায়! আমাকে যদি আমার আমলনামা দেওয়াই না হতো।’ (সূরা হাক্কা : ২৫)।

কৃপণতা বা দানশীলতা, তাকওয়া বা পাপাচার জীবনভরের সব কাজের হিসাবের খাতা উড়ে আসবে প্রত্যেকের কাছে। যদি তুমি তোমার স্বভাবকে শুদ্ধ করে থাক জাগ্রত হওয়ার পর সেই অবস্থাই তোমার সম্মুখে আসবে। আর যদি গোমরাহি, মন্দ কাজ ও স্বভাবের মধ্যে জীবন কাটিয়ে থাক তার লিপি তুমি বাম হাতে পাবে। মওলানা আরও বলেন, আমাদের ঘুম ছোট মৃত্যু আর জেগে ওঠা ছোট হাশর। এ ছোটকে দিয়ে বড় মৃত্যু ও বড় হাশরকে উপলব্ধি কর। এখানে তোমার কর্মলিপি গোপন থাকে; কিন্তু সেখানে প্রকাশিত হবে। কম্পিউটারের মেমোরিতে তথ্যগুলো অদৃশ্য থাকে; কিন্তু প্রিন্ট নিলে প্রকাশিত হয়। আমাদের আমলনামাও এখানে কল্পনার মতো অদৃশ্য। সেখানে তা প্রকাশ পাবে আকৃতিতে। বিষয়টি বোঝার জন্য একটি উপমা নাও।

নির্মাণশিল্পী বাড়ি নির্মাণের আগে মনের আয়নায় ছক আঁকে। সে ছক দেখা যায় না। পরে যখন গৃহ নির্মাণ করে মনের কল্পিত ছকটিই বাস্তবে আকার ধারণ করে। দুনিয়ায় কৃতকর্মের ফিরিস্তি মনের কল্পনার মতো অদৃশ্য। এটি মাটির ভেতরে বুনে রাখা দানার মতো। শীতকালে এসব দানা প্রাণহীন ‘নাই’ এর মতো হয়ে থাকে। যখন বসন্ত আসে, সূর্যের তেজে বরফ গলে যায়, অদৃশ্য দানাগুলো বিকশিত হয় পত্রপল্লবে। কেয়ামতের দিনের সূর্যও যখন উত্তাপ ছড়াবে মাটির মাঝে লুকায়িত দানার মতো আমাদের আমলনামা উদ্গত হবে। তখন বোঝা যাবে কোনটি সুন্দর সঠিক, কোনটি মন্দ কুৎসিত।

পরকালের বসন্তে গজে ওঠা কিছু উদ্ভিদ প্রাণবন্ত সজীব মুত্তাকি আর কিছু হবে শির অবনত, অপদস্থ, তারা অপরাধী। কোরআন মজিদের ভাষায়, ‘হায় তুমি যদি দেখতে! যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে অধোবদন হয়ে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ও শ্রবণ করলাম, এখন তুমি আমাদের ফের প্রেরণ কর। আমরা সৎকর্ম করব, আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী।’ (সূরা সাজদা : ১২)।

ভয়ে আতঙ্কে তাদের চোখগুলো বিস্ফারিত। আমলনামা বাম হাতে আসে নাকি সে আশঙ্কায় কম্পিত। অবশেষে এক গোনাহগার বান্দার আমলনামা বাম হাতে এলো। যত অপকর্মে আকীর্ণ সেই আমলনামা। বুঝতে পারে দোজখই তার শেষ ঠিকানা। ভয়ে আতঙ্কে তার মুখে রা নেই। সৎকাজের কোনো চিহ্ন নেই তার আমলের খাতায়। ধোঁকাবাজি, পাপ, অনাচার, অবহেলা আমিত্বের অহমিকায় কলুষিত। নিজের অপকর্মের পক্ষে এতকাল যত সাফাই গেয়েছে সব সাফাই আজ পেরেক হয়ে দুই ওষ্ঠ চেপে ধরেছে। চোর যেন হাতেনাতে পাকড়াও। ফেরেশতারা গোয়েন্দা পুলিশের মতো দুনিয়ায় গোপনে তাকে নজরদারিতে রেখেছিল। আজ তারা সশরীরে তার আগে-পিছে পাহারায় নিয়োজিত। ডা-াবেড়ি পরিয়ে চোর ডাকাত জেলহাজতে নেওয়ার মতো হতভাগাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দোজখের দিকে। কিন্তু দোজখের পথে সে ঠেক ধরে। এক পা আগায় তো দুইপা পেছায়। ফেরেশতারা গলাধাক্কা দেয়, হাঁকায় সে বারবার পেছনে তাকায়। তার দুই চোখে অশ্রুর বন্যা। অনুতাপের বেদনায় কলিজা ধড়ফড় করে। কারও বৃথা আশায় বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মুখে কিছু বলে না, চোখের চাহনিতে হাজারো অব্যক্ত বেদনা।

মহান আরশের মালিকের কাছ থেকে তখন আদেশ আসে, দেখ তো এ ছন্নছাড়ার এই দশা কেন? কেন সে বারবার পেছনে তাকায়? তার আমলনামায় তো কোনো সৎকর্ম নেই। রাতজাগা ইবাদত বা দানশীলতার কোনো চিহ্ন নেই। তাকে দোজখেই যেতে হবে, এ কথা সে জানে। এরপরও কেন সে যেতে চায় না, গোঁ ধরেছে? অবিলম্বে মহামহিমকে জানানো হলো।
বন্দা গুয়াদ আনচে ফরমূদী বয়া’ন
সদ চুনানম সদ চুনানাম চদ চুনা’ন
বন্দা বলছে, তুমি যা বলেছ সত্য প্রভু হে আমি
একশগুণ বেশি শতগুণ পাপী তার চেয়েও আমি।

কিন্তু তুমিই তো আমার নিকৃষ্টতম পাপগুলো গোপন রেখেছ। তুমি ‘সাত্তার’ দোষ গোপনকারী হয়ে আমার অপরাধ ঢেকে রেখেছ। আমার আমলনামায় কী লেখা, আমি জানি না, বুঝি না। কুফরি ও ঈমান নিয়ে কখনও ভাবিনি, কল্যাণ-অকল্যাণ চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। এতকিছুর পরও আজ তোমার দয়ার পরশ পাওয়ার আশায় আমার বুকটা আকুল হয়েছে। তোমার দয়া তো কোনো কিছুর বিনিময় স্বরূপ নয়। আমি চাইনি, আমার কোনো যোগ্যতা ছিল না, তারপরও তোমার অজস্র দয়াদানে ভরে দিয়েছ আমাকে। দুনিয়ায় তো আমি চেয়ে আসিনি। তোমার অপার অনুগ্রহে জীবন দিয়েছ, লালন করেছ। আজ আখেরাতে এসে এমন দুর্গতি। বারবার তাকাচ্ছি তোমার দয়ার সাগরে ঢেউ আসে কি না।

বান্দা যখন তার গোনাহখাতা গণনা করে, লজ্জিত-অনুতাপ্ত হয়, তখন আল্লাহর দয়ার সাগরে বান আসে। আল্লাহপাক তখনই বললেন কাই মালায়েক বা’য আরীদাশ বে মা
কে বুদাস্তাশ চশমে দেল সূয়ে রাজা’
হে ফেরেশতারা তাকে নিয়ে এসো আমার কাছে
সে আশায় বুক বেঁধেছে আমার মাগফেরাত পাবে।
আমি কারও পরোয়া করি না, আমার বান্দাকে আমি মাফ করে দিলাম। তার সব পাপের ওপর লালরেখা টেনে দিলাম। আমার রহমতের বরিষণে তার দিলের জমিনে বসন্তের সমারোহ জাগবে। তাকে নিয়ে যাও জান্নাতে।