হাওর বার্তা ডেস্কঃ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। গোটা দেশ এখন ডেঙ্গু ঝুঁকিতে। ঘরে ঘরে ডেঙ্গু। ইতিমধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ রেকর্ড স্পর্শ করেছে। ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ নেত্রকোণা জেলাতেও ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত আটজন রোগী নেত্রকোণায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মাধ্যমে দেশের ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লো। আর সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে পুরো ডেঙ্গুর মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই এ পর্যন্ত ১৯ হাজার ৫১৩ জন এবং গত ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ৭১২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আর সারাদেশে মৃত্যু হয়েছে ১৪ জন ডেঙ্গু রোগীর।
বৃহস্পতিবার (০১ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
যদিও সকালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক সচিবালয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে আয়োজিত বৈঠকে বলেছিলেন, নেত্রকোণা বাদে সারাদেশের প্রত্যেকটি জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে মানুষ। কিন্তু সন্ধ্যা নাগাদ অধিদপ্তরের আপডেট তথ্যমতে জানা গেলো, নেত্রকোণাও বাদ গেলো না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার সূত্রে জানা যায়, এ বছরের জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত মোট ১৯ হাজার ৫১৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমানে পাঁচ হাজার ৮৩৮ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন এবং হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ১৩ হাজার ৬৬১ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে সর্বোচ্চ এক হাজার ৭১২ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে এই ২৪ ঘণ্টায় কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। বর্তমানে ঘণ্টায় ৭১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। গত ২১ জুন এক দিনে ৬৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। ৪১ দিনের ব্যবধানে বৃহস্পতিবার বেড়েছে প্রায় ২৬ গুণ।
এদিকে, ঢাকা শহরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এক দিনের হিসাবে সর্বোচ্চ এক হাজার ১৫০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আর ঢাকার বাইরে এ পর্যন্ত তিন হাজার ৪৬৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিভাগের সব সরকারি হাসপাতাল ও প্রায় ৩৫টি বেসরকারি হাসপাতাল এবং জেলা সদর হাসপাতালগুলোর রোগীর হিসাব জমা হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। এছাড়া ঢাকা শহরে আরও অনেক বেসরকারি হাসপাতাল ও সারাদেশের আরও সরকারি হাসপাতাল রয়েছে, যেখানকার হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রতিদিন জমা হয় না। সে অনুসারে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়।
এদিকে, ডেঙ্গুতে এ মৌসুমে ‘সঠিক’ মৃত সংখ্যার হিসাব নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। অধিদপ্তরের মতে এই মৌসুমে ১৪ জনের মৃত্যু হলেও সারাদেশের হাসপাতালগুলোর ঘোষণা অনুযায়ী এ সংখ্যা ৫০ জনের অধিক।
এ বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিরজাদী সেবরিনা ফ্লোরা সাংবাদিককে বলেন, হাসপাতালে মৃত ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করি রোগী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন কি-না। অনেকবার অনেকভাবে সাক্ষীদের ইন্টারভিউ নিয়ে নিশ্চিত হতে হয় যে মৃত্যুটা আসলে হাসপাতালে কীভাবে হয়েছে। সে কার্যক্রম আমাদের চলমান রয়েছে। আমাদের হিসাবে এ মৌসুমে মোট ১৪ জনের ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো আসলে কতোজন এবার ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করেছেন। আর ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুও অন্য কারণে হতে পারে। এসব নির্ণয় করতেই আমাদের ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হয়।
অপরদিকে, রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ব্যাপক ডেঙ্গু রোগীর চাপ সামলাতে হাঁপিয়ে উঠছেন চিকিৎসক, নার্সসহ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতাল ভবনের করিডোর, বারান্দা এমনকি চলার পথের দু’পাশ দিয়েও বিছানা পেতে রোগীদের রাখা হয়েছে। যার অধিকাংশই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যা খালি না থাকায় রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া আতঙ্কের কারণে এখন সুস্থ মানুষও ডেঙ্গু নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হাসপাতালগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন বলেও জানা গেছে।
ডেঙ্গু স্পেশাল কেয়ার:
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল: বৃহস্পতিবার ডেঙ্গু রোগীদের সামাল দিতে এ হাসপাতালে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড উদ্বোধন করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ৮৫টি বেড রয়েছে এ ওয়ার্ডে। থাকার কথা ছিল ১০০ টি। বর্তমানে ৫৪ জন পুরুষ ও ৩১ জন নারী রোগী রয়েছেন এখানে। ওয়ার্ডটি পাঁচটি রুমে বিভক্ত। এছাড়া এখানে ওষুধসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সবকিছু রোগীদের বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। আর নতুন রোগীদের জন্য নিচতলায় হেল্প ডেস্ক আছে। এই ওয়ার্ড মেডিসিন বিভাগের অন্তর্গত। তবে প্রায় প্রত্যেকটি বিভাগে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে বলে জানা গেছে হাসপাতাল সূত্রে। ওয়ার্ডের প্রত্যেকটি বেডে মশারি টানানো এবং উন্নতমানের বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে বিভিন্ন বিভাগের ফ্লোরে থেকে তারা বিনামূল্যে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ): হাসপাতালটিতে বুধবার (৩১ জুলাই) সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত অর্থাৎ গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১২৭ জন। এর মধ্যে নতুন ভর্তি রোগী ৩০, আগের ভর্তি রোগী ৯৭ জন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত আরও ১২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। সবমিলে দুপুর ২টা পর্যন্ত ১৩৯ জন রোগী ভর্তি আছেন। মেডিসিন ওয়ার্ড, শিশু ওয়ার্ড, ডেঙ্গু চিকিৎসা সেল, কেবিন, আইসিইউ ও এসডিইউতেও রোগী ভর্তি আছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু সেলে ২৪২ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বহির্বিভাগে গত তিনদিনে পাঁচ শতাধিক ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।
এখানে পর্যাপ্ত ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে শয্যা সংখ্যা ১৫০ থেকে ২০০ তে উন্নীত করা হয়েছে। ডেঙ্গু সেলের মাধ্যমে ভর্তি করা রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ, চিকিৎসাসেবা, বেড ভাড়া এমনকি আইসিইউ এবং এইচডিইউ সেবাও বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও ডেঙ্গু সেলে আসা রোগীদের প্রাথমিকভাবে সিবিসি, এনএস১, আইজিএম, আইজিএম ও আইজিজি বিনামূল্যে করা হচ্ছে। বর্তমানে আইসিইউতে তিনজন এবং এইচডিইউতে সাতজন ডেঙ্গু রোগী আছেন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকুনগুনিয়াসহ তিন ধরনের রোগের জন্য দায়ী এডিস মশা৷ এই মশার প্রজনন ঘরবাড়িতে৷ তারা কামড়ায় দিনের আলোতে৷
মশাবাহিত প্রধান প্রাণঘাতী ১০টি রোগের মধ্যে অন্যতম হলো: ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, এনসেফেলাইটিস এবং লিমফেটিক ফাইলেরিয়াসিস৷ এরমধ্যে এডিস মশা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা – এই যে তিনটি রোগ ছড়ায় তার সবগুলোই বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে৷