ঢাকা ০২:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মশার নতুন ওষুধ নিয়ে অন্ধকারে ডিসিসি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:২৪:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ জুলাই ২০১৯
  • ২৩৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মশা মারতে উচ্চ আদালতে নতুন ওষুধ কেনার অঙ্গীকার করলেও কী ওষুধ কেনা হবে এবং কবে আসবে এই ওষুধ, সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। হাইকোর্টে অঙ্গীকার করার দুই দিন পর উত্তর সিটি করপোরেশনে বৈঠক হলেও সেখানে নতুন ওষুধ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। দক্ষিণেও একই অবস্থা। জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘নতুন ওষুধ কেনার বিষয়ে আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আইইডিসিআরের মতামত চেয়েছি।

তারা বিষয়টা নিশ্চিত করলেই আমরা নতুন ওষুধ কেনা এবং ব্যবহার করতে পারব। আর তখনই বিষয়টি আপনারা জানতে পারবেন। তবে কবে নাগাদ এটা শুরু করতে পারব এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’

জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইইডিসিআরের পরিচালক সেবরিনা ফ্লোরা সাংবাদিককে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন মশার ওষুধের বিষয়ে আমাদের কাছ থেকে ফরমালি জানতে চেয়েছেন। ওনারা এ বিষয়ে একটা টেকনিক্যাল কমিটিতে আমাদের আইডিসিআরের একজনের নাম দিতে বলেছে। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারব না, সিটি করপোরেশনকেই জিজ্ঞেস করুন।’

এবার ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তারের সময় দুই সিটি করপোরেশনের মশা মারার ওষুধ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখা গেছে, এই ওষুধে মশা মরে না। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এমনকি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। যদিও উচ্চ আদালতে শুনানিতে বৃহস্পতিবার দুই নগরের আইনজীবীরা নতুন ওষুধ ব্যবহারের অঙ্গীকারের কথা বলেন।

যদিও নতুন কী ওষুধ আসবে, কোত্থেকে আসবে-সে বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি দুই আইনজীবী। আর তিন দিনেও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও কোনো বক্তব্য আসেনি।

একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেছেন, এ বিষয়ে চট করে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। কারণ, মশার শতভাগ কার্যকর ওষুধ আদৌ আছে কি না এ নিয়ে সংশয় আছে। থাকলে বাংলাদেশের চেয়ে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নত দেশে এই কীটের প্রকোপ থাকত না।

গতকাল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মশা নিধন নিয়ে দীর্ঘ এক বৈঠক হয়। সেখানে কর্মী সংখ্যা বাড়ানো, মশা মারতে ব্যবহার করা ফগিং মেশিন দ্বিগুণ করাসহ নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু নতুন ওষুধ নিয়ে কোনো কথাই হয়নি।

আবার মশার ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছাড়পত্রও লাগবে। পাশাপাশি পরামর্শ লাগবে আইইডিসিআরের। আর সেগুলো কবে আসবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন দুই সিটি করপোরেশনের কোনো কর্মকর্তাই।

সম্প্রতি এক সম্মেলনে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু ওষুধে মশা মরছে না এ বিষয়টি আমাদের জানা আছে। ওষুধ পরিবর্তন করা হবে, নতুন ওষুধ কেনা হবে।’

বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা ১৪ মাস আগে বলেছিলেন, মশার ওষুধ কার্যকারিতা হারিয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ছিটানো ওষুধে মশা মরছে না। শুরু থেকেই দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গবেষণার বিষয়ে অবহিত করা হয়েছিল এবং গবেষণা ফলাফল সম্পর্কেও দুই সিটি করপোরেশন জানে। সব জেনেও কর্তৃপক্ষ মশা মারার ওষুধ পরিবর্তনে পদক্ষেপ নেয়নি।

এ বছরও এপ্রিলে দুটি গবেষণা ফলাফল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সভাকক্ষে উপস্থাপন করা হয়। আইসিডিডিআরবি, সিডিসির বিজ্ঞানী ও গবেষক ছাড়াও সভায় অন্যদের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

অবশ্য ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস ইজিপ্ট মশার জীবনচক্র ধরলে ঘরের বাইরে ওষুধ ছিটিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ, এটি সাধারণত পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। বাড়ির ভেতরেও বিভিন্ন উৎসে এর জন্ম হয়। এ ছাড়া নির্মাণাধীন ভবনের জলাধার, লিফটের নিচে এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থেকে বের হওয়ার পর জমে থাকা পানি, ফুলের টব, টায়ার-টিউবসহ যেসব জায়গায় পানি জমে, সেগুলোই এডিস মশার বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। কিন্তু এসব ব্যক্তিগত জায়গায় ওষুধ ছিটানো হয় না।

আর এডিস মশার খাবারও ফলের রস বা এ জাতীয় বস্তু যা সাধারণত মধ্য বা উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর বাড়িতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার শরীফুল ইসলাম। সাংবাদিককে তিনি বলেন, ‘অভ্যাস পরিবর্তন জরুরি। আমাদের জীবনযাপনের ধরনে নিয়মিত পরিষ্কার থাকার মানসিকতা লালন করতে হবে।’

ডেঙ্গু কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড আর ফিলিপাইনের মতো উন্নত অর্থনীতির দেশও রীতিমতো কাঁপছে এই জ্বরে। বাংলাদেশের চেয়ে জনসংখ্যা কম হলেও সেখানে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও বেশি। এর মধ্যে চীন ও ভিয়েতনাম তার নাগরিকদের সতর্ক করেছে।

যদিও নাগরিকদের সচেতন করা এবং কীভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা যাবে-এমন বার্তা নিয়ে ঢাকায় প্রচার হয়নি বললেই চলে। আর নগরবাসী নিজেদের ঘর এবং আঙিনা ঝুঁকিমুক্ত রাখতে উদ্যোগ নিয়েছে, এমন প্রমাণও নেই।

উত্তর সিটি করপোরেশন পক্ষ থেকে জুলাই মাসের প্রথম দিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কিছু বাড়িতে গিয়ে সচেতনমূলক কাজ করতে দেখা গেলেও দক্ষিণ সিটিতে সেরকম কোনো তৎপরতা এতদিন দেখা যায়নি। যদিও এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ আগে ভাগেই হয়েছিল এবং সেটা মে মাসে।

কেন প্রথম থেকে সিটি করপোরেশন গাফিলতি করেছিল জানতে চাইলে দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের একই ভাষ্য, তারা শুরু থেকেই ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ করার পাশাপাশি জনসচেতনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। আর সেটা এখন অব্যাহত রয়েছে।

অবশ্য এই ধরনের কার্যক্রমের সুফল যে পাওয়া যায় এমনও নয়। ২০১৮ সালে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক ওয়ার্ডে ডেঙ্গুবিষয়ক জনসচেতনতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। এ কাজের সঙ্গে এলাকাবাসী ও মসজিদের ইমামদেরও সম্পৃক্ত করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও চালানো হয় প্রচার-প্রচারণা। গত সেপ্টেম্বরে গানে গানে ও লিফলেট বিতরণের মধ্য দিয়ে নগরীতে পাঁচ দিনব্যাপী ‘রোড শো’ কর্মসূচিও পালন করা হয়। তবে সচেতনতার এসব কর্মকা-জনমনে খুব একটা প্রভাব ফেলেছে-এমন প্রমাণ মেলেনি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের লোকজন গিয়ে কারও বাড়িঘর পরিষ্কার করে দিয়ে আসার কথা না। তবে যা কোনো দিন হয়নি, গত বছর তাও করেছে ডিএসসিসি। ৫০ হাজারের মতো বাড়িতে গিয়ে মশক নিধনকর্মীরা এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করে দিয়ে এসেছে। সমস্যাটা হচ্ছে, এ কাজের পরে বাড়ির লোকজন পরবর্তী সময়ে আর দেখভাল করেনি না ঠিকমতো। পরিষ্কার করার ১০ দিন পরে যে আবার এডিসের লার্ভা জন্মাতে পারে, সেটা অনেকেই বুঝছেন না। এর ফলে ফলাফল ভালো আসছে না। এ অবস্থায় রাজধানীতে ডেঙ্গু প্রতিরোধ বেশ খানিকটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক শরীফুল ইসলাম মনে করেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের চাবি মানুষের পরিচ্ছন্নতা। সাংবাদিককে তিনি বলেন, ‘মানুষের বসতি আছে যেমন ছাত্রাবাস, আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, শ্রেণিকক্ষ ইত্যাদি নিয়মিত পানির পাত্র পরিষ্কার রাখতে হবে।’

‘নিয়মিত পরিষ্কার থাকার গুণ হলো এডিস মশার প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে। পানির পাত্র পরিষ্কারই নয়, যেখানে সেখানে ডাবের খোসা থেকে শুরু করে পলিথিন, পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট ফেলে রাখা ঠিক না। থেমে থেমে বৃষ্টি হলে সেগুলোতে স্বচ্ছ পানি জমে সেখানেও এডিস মশার জন্ম নিতে পারে। এদেশে মানুষের উপস্থিতি মানেই ময়লার উপস্থিতি। তাই প্রথমেই সচেতনতা দরকার ব্যক্তিগত পর্যায়ে।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

মশার নতুন ওষুধ নিয়ে অন্ধকারে ডিসিসি

আপডেট টাইম : ১২:২৪:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ জুলাই ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মশা মারতে উচ্চ আদালতে নতুন ওষুধ কেনার অঙ্গীকার করলেও কী ওষুধ কেনা হবে এবং কবে আসবে এই ওষুধ, সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। হাইকোর্টে অঙ্গীকার করার দুই দিন পর উত্তর সিটি করপোরেশনে বৈঠক হলেও সেখানে নতুন ওষুধ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। দক্ষিণেও একই অবস্থা। জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘নতুন ওষুধ কেনার বিষয়ে আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আইইডিসিআরের মতামত চেয়েছি।

তারা বিষয়টা নিশ্চিত করলেই আমরা নতুন ওষুধ কেনা এবং ব্যবহার করতে পারব। আর তখনই বিষয়টি আপনারা জানতে পারবেন। তবে কবে নাগাদ এটা শুরু করতে পারব এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’

জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইইডিসিআরের পরিচালক সেবরিনা ফ্লোরা সাংবাদিককে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন মশার ওষুধের বিষয়ে আমাদের কাছ থেকে ফরমালি জানতে চেয়েছেন। ওনারা এ বিষয়ে একটা টেকনিক্যাল কমিটিতে আমাদের আইডিসিআরের একজনের নাম দিতে বলেছে। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারব না, সিটি করপোরেশনকেই জিজ্ঞেস করুন।’

এবার ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তারের সময় দুই সিটি করপোরেশনের মশা মারার ওষুধ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখা গেছে, এই ওষুধে মশা মরে না। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এমনকি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। যদিও উচ্চ আদালতে শুনানিতে বৃহস্পতিবার দুই নগরের আইনজীবীরা নতুন ওষুধ ব্যবহারের অঙ্গীকারের কথা বলেন।

যদিও নতুন কী ওষুধ আসবে, কোত্থেকে আসবে-সে বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি দুই আইনজীবী। আর তিন দিনেও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও কোনো বক্তব্য আসেনি।

একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেছেন, এ বিষয়ে চট করে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। কারণ, মশার শতভাগ কার্যকর ওষুধ আদৌ আছে কি না এ নিয়ে সংশয় আছে। থাকলে বাংলাদেশের চেয়ে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নত দেশে এই কীটের প্রকোপ থাকত না।

গতকাল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মশা নিধন নিয়ে দীর্ঘ এক বৈঠক হয়। সেখানে কর্মী সংখ্যা বাড়ানো, মশা মারতে ব্যবহার করা ফগিং মেশিন দ্বিগুণ করাসহ নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু নতুন ওষুধ নিয়ে কোনো কথাই হয়নি।

আবার মশার ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছাড়পত্রও লাগবে। পাশাপাশি পরামর্শ লাগবে আইইডিসিআরের। আর সেগুলো কবে আসবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন দুই সিটি করপোরেশনের কোনো কর্মকর্তাই।

সম্প্রতি এক সম্মেলনে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু ওষুধে মশা মরছে না এ বিষয়টি আমাদের জানা আছে। ওষুধ পরিবর্তন করা হবে, নতুন ওষুধ কেনা হবে।’

বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা ১৪ মাস আগে বলেছিলেন, মশার ওষুধ কার্যকারিতা হারিয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ছিটানো ওষুধে মশা মরছে না। শুরু থেকেই দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গবেষণার বিষয়ে অবহিত করা হয়েছিল এবং গবেষণা ফলাফল সম্পর্কেও দুই সিটি করপোরেশন জানে। সব জেনেও কর্তৃপক্ষ মশা মারার ওষুধ পরিবর্তনে পদক্ষেপ নেয়নি।

এ বছরও এপ্রিলে দুটি গবেষণা ফলাফল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সভাকক্ষে উপস্থাপন করা হয়। আইসিডিডিআরবি, সিডিসির বিজ্ঞানী ও গবেষক ছাড়াও সভায় অন্যদের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

অবশ্য ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস ইজিপ্ট মশার জীবনচক্র ধরলে ঘরের বাইরে ওষুধ ছিটিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ, এটি সাধারণত পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। বাড়ির ভেতরেও বিভিন্ন উৎসে এর জন্ম হয়। এ ছাড়া নির্মাণাধীন ভবনের জলাধার, লিফটের নিচে এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থেকে বের হওয়ার পর জমে থাকা পানি, ফুলের টব, টায়ার-টিউবসহ যেসব জায়গায় পানি জমে, সেগুলোই এডিস মশার বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। কিন্তু এসব ব্যক্তিগত জায়গায় ওষুধ ছিটানো হয় না।

আর এডিস মশার খাবারও ফলের রস বা এ জাতীয় বস্তু যা সাধারণত মধ্য বা উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর বাড়িতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার শরীফুল ইসলাম। সাংবাদিককে তিনি বলেন, ‘অভ্যাস পরিবর্তন জরুরি। আমাদের জীবনযাপনের ধরনে নিয়মিত পরিষ্কার থাকার মানসিকতা লালন করতে হবে।’

ডেঙ্গু কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড আর ফিলিপাইনের মতো উন্নত অর্থনীতির দেশও রীতিমতো কাঁপছে এই জ্বরে। বাংলাদেশের চেয়ে জনসংখ্যা কম হলেও সেখানে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও বেশি। এর মধ্যে চীন ও ভিয়েতনাম তার নাগরিকদের সতর্ক করেছে।

যদিও নাগরিকদের সচেতন করা এবং কীভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা যাবে-এমন বার্তা নিয়ে ঢাকায় প্রচার হয়নি বললেই চলে। আর নগরবাসী নিজেদের ঘর এবং আঙিনা ঝুঁকিমুক্ত রাখতে উদ্যোগ নিয়েছে, এমন প্রমাণও নেই।

উত্তর সিটি করপোরেশন পক্ষ থেকে জুলাই মাসের প্রথম দিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কিছু বাড়িতে গিয়ে সচেতনমূলক কাজ করতে দেখা গেলেও দক্ষিণ সিটিতে সেরকম কোনো তৎপরতা এতদিন দেখা যায়নি। যদিও এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ আগে ভাগেই হয়েছিল এবং সেটা মে মাসে।

কেন প্রথম থেকে সিটি করপোরেশন গাফিলতি করেছিল জানতে চাইলে দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের একই ভাষ্য, তারা শুরু থেকেই ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ করার পাশাপাশি জনসচেতনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। আর সেটা এখন অব্যাহত রয়েছে।

অবশ্য এই ধরনের কার্যক্রমের সুফল যে পাওয়া যায় এমনও নয়। ২০১৮ সালে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক ওয়ার্ডে ডেঙ্গুবিষয়ক জনসচেতনতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। এ কাজের সঙ্গে এলাকাবাসী ও মসজিদের ইমামদেরও সম্পৃক্ত করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও চালানো হয় প্রচার-প্রচারণা। গত সেপ্টেম্বরে গানে গানে ও লিফলেট বিতরণের মধ্য দিয়ে নগরীতে পাঁচ দিনব্যাপী ‘রোড শো’ কর্মসূচিও পালন করা হয়। তবে সচেতনতার এসব কর্মকা-জনমনে খুব একটা প্রভাব ফেলেছে-এমন প্রমাণ মেলেনি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের লোকজন গিয়ে কারও বাড়িঘর পরিষ্কার করে দিয়ে আসার কথা না। তবে যা কোনো দিন হয়নি, গত বছর তাও করেছে ডিএসসিসি। ৫০ হাজারের মতো বাড়িতে গিয়ে মশক নিধনকর্মীরা এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করে দিয়ে এসেছে। সমস্যাটা হচ্ছে, এ কাজের পরে বাড়ির লোকজন পরবর্তী সময়ে আর দেখভাল করেনি না ঠিকমতো। পরিষ্কার করার ১০ দিন পরে যে আবার এডিসের লার্ভা জন্মাতে পারে, সেটা অনেকেই বুঝছেন না। এর ফলে ফলাফল ভালো আসছে না। এ অবস্থায় রাজধানীতে ডেঙ্গু প্রতিরোধ বেশ খানিকটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক শরীফুল ইসলাম মনে করেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের চাবি মানুষের পরিচ্ছন্নতা। সাংবাদিককে তিনি বলেন, ‘মানুষের বসতি আছে যেমন ছাত্রাবাস, আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, শ্রেণিকক্ষ ইত্যাদি নিয়মিত পানির পাত্র পরিষ্কার রাখতে হবে।’

‘নিয়মিত পরিষ্কার থাকার গুণ হলো এডিস মশার প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে। পানির পাত্র পরিষ্কারই নয়, যেখানে সেখানে ডাবের খোসা থেকে শুরু করে পলিথিন, পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট ফেলে রাখা ঠিক না। থেমে থেমে বৃষ্টি হলে সেগুলোতে স্বচ্ছ পানি জমে সেখানেও এডিস মশার জন্ম নিতে পারে। এদেশে মানুষের উপস্থিতি মানেই ময়লার উপস্থিতি। তাই প্রথমেই সচেতনতা দরকার ব্যক্তিগত পর্যায়ে।’