নবীজির ঐতিহাসিক হজ পালন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ হজ ইসলামের মৌল পঞ্চস্তম্ভের একটি। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার ওপর আরোপিত গুরুত্বপূর্ণ বিধান। যার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অপরিসীম মাহাত্ম্য। আছে থরে থরে আবেগ-ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ইসলামের অন্যান্য ইবাদতের কোনোটি হয়তো শুধু আর্থিক, আবার কোনোটি শুধু শারীরিক, আবার কোনোটির সম্পর্ক শুধু আত্মার সঙ্গে। কিন্তু হজ এমন এক পবিত্র ও মহিমান্বিত ইবাদত, যার সম্পর্ক আত্মা, শরীর ও অর্থ তথা সবগুলোর সঙ্গেই। এখানে যেমন আছে অর্থের খরচ, তেমনি আছে শারীরিক কষ্ট, আছে আত্মার সম্পর্ক। একজন মোমিন মাত্রই অধীর আগ্রহে হজ আদায়ের সামর্থ্য ও কবুলিয়াতের কাকুতি করেন রবের দরবারে। পরম করুণাময় প্রভুর ডাকে প্রতি বছর লাখ লাখ বান্দা শুভ্র বসনে পবিত্র হজ পালনে ছুটে যান মক্কা-মদিনার আঙিনায়।

আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন, ‘এবং স্মরণ করুন, যখন আমি ইবরাহিমের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম সে গৃহের স্থান, তখন বলেছিলাম আমার সঙ্গে কোনো শরিক স্থির করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রেখ তাদের জন্য যারা তাওয়াফ করে এবং যারা দাঁড়ায়, রুকু করে ও সিজদা করে এবং মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটগুলোর পিঠে, এরা আসবে দূর-দূরান্ত থেকে, যাতে তারা এ কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে।’ (সূরা হজ : ২৬-২৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশ্ববাসীকে লক্ষ্য করে ঘোষণা করেন, ‘হে মানবম-লী, তোমাদের ওপর হজ ফরজ করা হয়েছে, সুতরাং তোমরা সবাই হজ আদায় করো।’ (মিশকাত : ২০০৭)।

স্বভাবতই আমাদের হৃদয়ে এ জিজ্ঞাসার উদয় হয় যে, প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কতবার হজ পালন করেছেন। ওমরাই বা পালন করেছেন কতবার। বছর ঘুরে যখনই হজের মৌসুম ফিরে আসে, যখনই জিলকদের চাঁদ উদিত হয়, মুসলমানদের সর্বত্র হজের এক পবিত্র সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি মোমিন হৃদয় সেই পরম কাক্সিক্ষত কাবার পরশ পেতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ ফরজ হওয়ার পর একবার হজ করেছেন। আর ওমরা করেছেন চারবার। হজরত কাতাদা বলেন, আমি আনাস বিন মালিক (রা.) কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুলুল্লাহ (সা.) কতবার হজ করেছেন? তিনি বললেন, ‘একবার। আর ওমরা করেছেন চারবার। জিলকদ মাসে একবার। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় একবার। হজের সঙ্গে একবার। আর জিরানার সময় একবার, যখন তিনি হুনাইন যুদ্ধের গনিমতের মাল বণ্টন করেছেন।’ (তিরমিজি : ৮১৫; সুনানে দারামি : ১৮২৮)।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে একবারই হজ পালন করেছেন। যাকে বিদায় হজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই হজে নবীজি মুসলিম জাতির উদ্দেশে যে বক্তব্য রাখেন ইসলামের সামগ্রিক ইতিহাসের বিচারে তা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইসলাম ধর্ম যে ধাপে ধাপে ও পর্যায়ক্রমে পূর্ণতা পেয়েছিল, তারই চূড়ান্ত ঘোষণা ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) এর এই ভাষণ। এই ভাষণ প্রদানের সময় কোরআনে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়, ‘দআজ আমি তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহকারীকে সুসম্পন্ন করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সূরা মায়িদা : ৩)।

নবম জিলহজ আরাফাতের ময়দানে জাবালে রহমতে দাঁড়িয়ে প্রদত্ত বিদায় হজের সেই ভাষণে ইসলামের মর্মবাণী চমৎকাররূপে ফুটে ওঠে। কেয়ামত পর্যন্ত মুসলিম জাতির সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে মুসলমানদের করণীয় দিকনির্দেশনা ছিল তাতে। আজ মানবজাতিকে তার চরম সংকট ও দৈন্যদশা থেকে মুক্তি পেতে বিদায় হজের ভাষণের শিক্ষা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে হবে। এর বিকল্প নেই। এটি শুধু একটি ভাষণ ছিল না, এটি ছিল কেয়ামত পর্যন্ত মুসলিম জাতির শৌর্য ও বিজয়ের নববি মন্ত্র। পাঠকের সুবিধার্থে পুরো ভাষণটি হুবহু দেওয়া হলো।

‘উপস্থিত জনম-লী! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। হয়তো আমি আর কখনও এখানে তোমাদের সঙ্গে একত্রিত হতে পারব না। হে জনম-লী! আজকের এই দিন (জুমার দিন), এই মাস (জিলহজ মাস) ও এই শহর (মক্কা) যেমন পবিত্র; তোমাদের জানমাল, ইজ্জত-আব্রু, মান-সম্মান কেয়ামত পর্যন্ত এমনই পবিত্র। কারও কাছে যদি কোনো আমানত রক্ষিত থাকে, তাহলে সে যেন তা আমানতকারীর কাছে পৌঁছে দেয়। আজ থেকে সব ধরনের সুদ রহিত করা হলো। তোমাদের শুধু মূলধনের ওপর অধিকার রইল। তোমরা অন্যের ওপর অত্যাচার করবে না, নিজেরাও অত্যাচারিত হবে না। সর্বপ্রথম আমি হজরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদ রহিত করছি। অন্ধকার যুগের সব কৌলীন্য বিলুপ্ত করা হলো। শুধু কাবাঘরের তত্ত্বাবধান ও হাজীদের পানি পান করানো ছাড়া। আজকের পর তোমাদের ভূখ- শয়তানের উপাসনার ব্যাপারে সে নিরাশ হয়ে গেছে। কিন্তু কিছু ব্যাপার, যেগুলোকে তোমরা বড় পাপ মনেই করো না।

তার অনুসরণ করলে শয়তান খুশি হবে। জনম-লী! তোমাদের নিজ স্ত্রীদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তদ্রপ তাদেরও তোমাদের ওপর অধিকার রয়েছে। স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে, তারা যেন নিজ স্বামী ছাড়া পরপুরুষের সঙ্গে ভোগে লিপ্ত না হয়। যদি তারা তা করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের তাদের প্রতি কঠোরতা করার অনুমতি দিয়েছেন। এমতাবস্থায় তোমরা তাদের শয্যা পৃথক করে দেবে। এবং মৃদু প্রহার করবে। তাতে তারা বিরত হলে নিয়মমাফিক তাদের ভরণপোষণের প্রতি লক্ষ রাখবে। স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। তারা তোমাদের সাহায্যকারিণী। তোমরা তাদের আল্লাহর নির্ধারিত কালেমা বাক্যের (ইজাব-কবুল) মাধ্যমে নিজেদের জন্য হালাল করেছ। সুতরাং তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো। হে জনম-লী! সব মোমিন পরস্পর ভাই ভাই। কারও জন্য অন্যের সম্পদ বৈধ নয়। তবে যদি কেউ স্বেচ্ছায় কাউকে কিছু দেয়, তাহলে সেটা স্বতন্ত্র ব্যাপার। আমার পর তোমরা কুফরিতে ফিরে যেও না।

পরস্পর খুনাখুনি করো না। আমি তোমাদের মাঝে এমন দুটি জিনিস রেখে গেলাম, তোমরা তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলে কখনও বিভ্রান্ত হবে না। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব (পবিত্র কোরআন) ও তাঁর রাসুলের হাদিস। জনম-লী! তোমাদের প্রভু একজন। তোমাদের পিতাও একজন। তোমরা সবাই আদম থেকে আর আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। তোমাদের মাঝে যারা সর্বাধিক মুত্তাকি, খোদাভীরু তারাই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান। তাকওয়া ছাড়া কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। জনম-লী, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। উত্তরাধিকারীর জন্য কোনো অসিয়ত প্রযোজ্য নয়। অন্যদের জন্য এক-তৃতীয়াংশের অধিক অসিয়ত করা বৈধ নয়।

আমাদের কেয়ামত দিবসে জিজ্ঞাসা করা হবে। তোমাদেরও জিজ্ঞাসা করা হবে। তখন তোমরা আমার ব্যাপারে কী বলবে? আমি কি তোমাদের কাছে আল্লাহর দ্বীন পৌঁছে দিয়েছি? উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম উত্তর দিলেন, আমরা সাক্ষ্য দেব যে আপনি আপনার দায়িত্ব পৌঁছে দিয়েছেন। হিত কামনা করেছেন। অতঃপর রাসুল (সা.) আকাশের দিকে হাত তুলে তিনবার বললেন, আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন। তারপর বললেন, তোমরা এখানে যারা উপস্থিত আছ তারা অনুপস্থিতদের কাছে (কথাগুলো) পৌঁছে দেবে।’ (মুসলিম : ১৫৯)।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর