অধ্যক্ষ আসাদুল হক হাওরবার্তা প্রধান সম্পাদক ।মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দীর্ঘজীবন লাভ করেছেন। দীর্ঘপথ পরিক্রমণ করেছেন রাজনীতি ও ধর্মের বলয় ধরে। তাকে কেন্দ্র করে সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট, সশস্ত্র চরমপন্থি, ফকির, দরবেশ, মোল্লাদের সমাহার ঘটেছিল। জীবনের দীর্ঘকাল ‘প্রগতিশীল’ রাজনীতির কথা বলেছেন, নির্যাতন ভোগ করেছেন, জীবন সায়াহ্নে তিনি নিজেকে একাধারে বামপন্থি, উগ্রপন্থিদের স্বঘোষিত অভিভাবক এবং চরম দক্ষিণপন্থিদের বিশ্বস্ত মুখপাত্রে পরিণত হন। মওলানা ভাসানীর জীবন ব্রিটিশ-ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্ব, এই ত্রিধারায় প্রবাহিত হয়েছে। নিবন্ধটি তার বাংলাদেশ পর্বের মূল্যায়ন।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাধারণ বেশভূষা আর সাধারণের মতো জীবনযাপন করে গেছেন। কোনো আদর্শেই তিনি অবস্থান নিয়েছেন তা নয়। জনতার জোয়ার কোনদিকে বইছে, তা তিনি বুঝতে পারতেন, টেরও পেতেন। কিন্তু সে অনুযায়ী নিজেকে তৈরি বা এগিয়ে নিতে পেরেছেন এমনটা নয়। বরং স্রোতের বিপরীতেও তিনি অবস্থান নিয়েছেন। নিজের বক্তব্যকে নিজেই খন্ডন করেছেন। কোনো বিশ্বাসেই স্থির ছিলেন এমনটা নয়। পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, মওলানা ভাসানী জীবনের দীর্ঘকাল ‘প্রগতিশীল’ রাজনীতির কথা বলেছেন, নির্যাতন ভোগ করেছেন, জীবন সায়াহ্নে তিনি একাধারে বামপন্থি, উগ্রপন্থিদের স্বঘোষিত অভিভাবক এবং চরম দক্ষিণপন্থিদের বিশ্বস্ত মুখপাত্রে পরিণত হন।
আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন সেই পঞ্চাশের দশকে। রাজনীতির ঘোর বা মারপ্যাঁচে সেই অবস্থান থেকে সরে এসে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গঠন করেন পাকিস্তানভিত্তিক নয়া দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। সমাজতন্ত্রীদের দল হিসেবে তা দ্রুত বিস্তার লাভ করে পাকিস্তানের দুই অংশে। কিন্তু এক পর্যায়ে দলটি ভেঙে যায়।
বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবির ভাগ হয়ে গেলে তার রেশ ধরে ন্যাপও দ্বিধাবিভক্ত হয় মস্কো ও পিকিংপন্থি হিসেবে। ভাসানী পিকিংপন্থি রাজনীতির ঝাণ্ডা উঁচু করে ধরেছিলেন। ষাটের দশকে এসে তিনি সামরিক জান্তা আইয়ুব খান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় চীনের পরামর্শে ভাসানী ঝুঁকে পড়েন আইয়ুর খানের প্রতি। আইয়ুবের স্বার্থে চীনও সফর করেন। দেখা যায়, এক পর্যায়ে তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ১৯৬৮ সালজুড়ে প্রায় নিষ্ক্রিয় ও নির্বিকার ছিলেন। বছরের শেষদিকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও অংশ নেন। অথচ আইয়ুব সরকারকে তিনি সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সরকার’ হিসেবে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় যখন গণহত্যা শুরু হয়, ভাসানী তখন টাঙ্গাইলের সন্তোষে। এপ্রিলে হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল আক্রমণ করলে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মেঘালয় চলে যান। যুদ্ধ চলাকালে তার দলের সেক্রেটারি মশিউর রহমান যাদুমিয়া পাকিস্তানি হানাদার ও চীনের বার্তা নিয়ে কলকাতায় যান। ভাসানীকে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু টের পেয়ে ভারত সরকার তাকে অন্তরীণ করে রাখে। যাদুমিয়া ফিরে এসে হানাদারদের সহযোগী হিসেবে বাঙালি নিধনে মত্ত হন। স্বাধীনতার পর বিচারে তার জেল হয়, এতে ভাসানী ক্ষুব্ধ হন। এছাড়া দালালির অভিযোগে তার দলের আরো বহু নেতা গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি হয়। তাই স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে ভাসানী হুঙ্কার তোলেন দালাল আইন বাতিলের। এজন্য তিনি অনশন ধর্মঘটও করেন। এমনকি দেশের নাম পাল্টে ‘মুসলিম বাংলা’ রাখার দাবিটিকে সামনে তুলে আনেন। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিম বাংলা তিনি চেয়ে এসেছেন। তার এই দাবি ছিল মূলত আওয়ামী লীগের দাবির বিপরীতে পাকিস্তানের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা। তাছাড়া ন্যাটোর পাকিস্তান শাখা তখনো নিষ্ক্রিয় হয়নি।
যুদ্ধকালে ১৯৭১ সালের শেষদিকে ন্যাপ নেতা ভাসানী দিল্লির হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই তিনি হাসপাতাল ছেড়ে এসে উঠলেন যমুনা তীরের এক বাংলোতে। দেশে ফেরা পর্যন্ত এই বাংলোতেই ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বরের পর তিনি সরাসরি ঢাকায় ফিরেননি। প্রথমে জন্মভূমি ও একদা কর্মভূমি আসামে যান। দেশে ফেরার আগে আসামের ফকিরগঞ্জে ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি এক জনসমাবেশে ভাষণে বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ভুট্টো শেখ মুজিবকে অনুরোধ জানিয়েছে। আমি তাকে (ভুট্টোকে) বলতে চাই, বর্তমানে এটা শুধু অসম্ভব নয়, আগামী শত শত বছরেও এর পরিবর্তন হবে না। পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত অত্যাচারের কথা বাংলাদেশের জনগণ কখনো ভুলবে না।’ মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের নেতৃবৃন্দকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ভাসানী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ এই দয়াবতী মহিলা (ইন্দিরা গান্ধী) এবং ভারতের জনসাধারণের কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না।’ তিনি আশা করেন, ভারতের বর্তমান প্রশাসনের মতো বাংলাদেশও ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে ওঠবে।
১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি মেঘালয়ের ডালু থেকে নেত্রকোনার হালুয়াঘাট হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক খায়রুজ্জামান চৌধুরী তাকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অভ্যর্থনা জানান। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী সরকারি সফরে ঢাকা আসেন। ঢাকায় পৌঁছেই তিনি টাঙ্গাইল থেকে পাঠানো ভাসানীর তার বার্তা পান। যাতে উভয় দেশের মধ্যে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের সম্পর্ক কামনা করেন।
১৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি করেন ২৫ বছর মেয়াদি। ২৪ মার্চ ভাসানী এই মৈত্রী চুক্তিকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালে ভারত বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু প্রমাণ করেছে। আমি এ কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না।’ ইতিমধ্যে বাংলাদেশের তথাকথিত বামপন্থিদের তথা চৈনিকদের কয়েকটি পত্রিকা ভারত বিরোধিতার আবরণে মুজিব সরকারের সমালোচনা করতে শুরু করে। কোনো কোনো পত্রিকায় পাকিস্তানের সমর্থনমূলক চিঠিপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ ও চট্টগাম থেকে প্রকাশিত ‘লাল পতাকা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ‘হককথা’, ‘মুখপত্র’ ও ‘স্পোকসম্যান’ও ছিল। যা পরে নিষিদ্ধ করা হয়। মওলানা ভাসানী স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিলেন ১৯৭০ সালে।
১৯৭১ সালের ৯ মার্চ তাই দেখা যায় পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভায় তিনি পাকিস্তানকে ভাগ করে দুটো স্বাধীন দেশ গঠন করার জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। আর শেখ মুজিবকে তিনি আখ্যা দেন নিজের পুত্র হিসেবে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো এদিনও তিনি ‘বাংলাদেশ’ কথাটা ব্যবহার করেননি (গোলাম মুরশিদ : মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর)। স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা নিয়ে ভাসানী তার বৃহত্তর বাংলা গঠনের দাবি উত্থাপন করতে থাকেন। অথচ মুজিবনগর সরকার আমলে ভারতে অবস্থানকালে তিনি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব করেন।
বাংলাদেশের জনগণের কাছে কনফেডারশনের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হবে না বলে অনুমান করে ভাসানী ভারতের কয়েকটি অঞ্চল বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে নিয়ে আসার বিকল্প প্রস্তাব করেন। কিন্তু ভাসানী কেন এ প্রস্তাব করলেন, তার কার্যকারণ অবশ্য রয়েছে। ধারণা করা হয় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অস্থিরতার সৃষ্টি করে মুজিব সরকারকে অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া এবং ভারত-বাংলাদেশ শান্তি, সহযোগিতা ও মৈত্রী চুক্তির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য তিনি এই পন্থা বেছে নেন। সাংবাদিক আবদুল লতিফ খতিব ‘হু কিল্ড মুজিব’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বৃহত্তর বাংলার পক্ষে ভাষ্যও মেলেছে চীনা কর্মকর্তাদের বাঙালি কূটনীতিকের সঙ্গে সংলাপে।
বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ (পি ও)-৮ এর মাধ্যমে ‘দালাল আইন’ নামে একটি গণহত্যা অ্যাক্ট প্রবর্তন করেন। এই আইনের অধীনে যখন কতিপয় চিহ্নিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিচার চলছিল, তখন দেশের উগ্র বামপন্থি এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী মহলের অনেকেই সরকারের এই পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা শুরু করেছিলেন। সে সময় যে সব রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী এই দালাল ও ঘাতকদের বিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ভাসানী, ড. আলীম আল রাজী, অধ্যাপক আবুল ফজলসহ সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকাগোষ্ঠী। উপরন্তু ভাসানী এক পর্যায়ে ১৯৭৩ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে দালাল আইন বাতিল করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। এছাড়া ছিল বিদেশি চাপ এবং এত লোকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণের জন্য যথাযথ সাক্ষী জোগাড়ের ক্ষেত্রে নানা দুরূহ অসুবিধা এবং সমস্যা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা।
বঙ্গবন্ধু সরকার ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে শর্ত সাপেক্ষে অভিযুক্ত ও আটক দালালদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এই আশায় যে, তারা অতীতের কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত ও অনুশোচনার বশবর্তী হয়ে স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুসংহত করার জন্য এবং দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। এই সময়কালে ৩৪ হাজার ৬শ দালাল ছাড়া পায়। এর মধ্যে রাজাকার, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও পিডিপিসহ সাম্প্রদায়িক দলগুলোর দালালরা ছাড়া পায়। ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ সরকার দালাল আইন সংশোধন করে একটি অধ্যাদেশ জারি করে। মওলানা ভাসানী এর বিরোধিতা করে পুরো আইন বাতিলের জন্য দাবি তোলেন।
স্বাধীনতার পর আউশ মৌসুমে অনাবৃষ্টির কারণে ব্যাপক ফসলহানি ঘটে। এছাড়া যুদ্ধে বিপর্যস্ত পরিবহনে খাদ্য সরবরাহ বিলম্বিত হওয়ার ফলে সারা দেশে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্রকট অভাব দেখা দেয়। দেশের এই পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানীর ডাকে তিন সেপ্টেম্বর ঢাকায় কিছু কিছু স্থানে ভুখা মিছিল বের করা হয়। পরে পল্টনে জনসভা হয়। সমাবেশে ভাসানী সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। এই সমাবেশের কয়েকদিন আগে ১৯৭২ সালের ২১ আগস্ট জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের সদস্য পদদানের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে চীন ভেটো দেয়। কয়েকটি চীনাপন্থি দল-উপদল চীনকে অভিনন্দন জানায়। বাকি চীনাপন্থিরা বিব্রত হয়। ভাসানী শুধুমাত্র একটি বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন। জাতিসংঘ সদস্যপদ অর্জনের জন্য তিনি আন্দোলনের ডাক দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। ভেটো প্রদানের ৪দিন পর ১৯৭২ সালের ২৫ আগস্ট ভাসানী ভারতকে বাংলাদেশের এক নম্বর শত্রু বলে ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, প্রতিদিন প্রায় ত্রিশ লাখ ভারতীয় নাগরিক স্বল্পকালীন সফর উপলক্ষে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির জন্য এরা মূলত দায়ী বলে তিনি অভিযোগ করেন। এই বিপুল সংখ্যা তার কল্পনাপ্রসূত যে, তা সে সময়ই সংবাদপত্রে সমালোচিত হয়। বাংলাদেশ সফরে ভারতীয় নাগরিকদের পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছ হতে বিশেষ অনুমতি সংগ্রহ করতে হবে বলে ভারত সরকার নির্দেশ দেওয়ারও আগে দৈনিক ৩০ লাখ লোকের পক্ষে বাংলাদেশে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। ২৫ আগস্ট ’৭২ থেকে ভারত-বাংলাদেশে ভিসা প্রবর্তিত হয়। ফলে বাংলাদেশ সফরকারী ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ছিটেফোঁটা বলে বিবেচিত হয় (সাংবাদিক এ এল খতিব)।
১৯৭২ সালের ২৪ আগস্ট দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে মওলানা ভাসানী বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লব আসন্ন।’ কোন রাজনৈতিক শক্তি এই প্রতিবিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে সে সম্পর্কে তিনি খোলাখুলিভাবে কিছু বলেননি। যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কারণে জনসাধারণের মধ্যে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তার সুযোগ গ্রহণ করে ভাসানী প্রতিবিপ্লবের প্রচ্ছন্ন হুমকি দেন মুজিব সরকারকে। জ্যোতি সেনগুপ্ত তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘মাওবাদী ধর্মান্ধ মোল্লা ও পাকিস্তানপন্থিদের উস্কে দিয়ে তিনি বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লব ঘটাবার আয়োজন করেছিলেন।’
স্বাধীনতা লাভের পর সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু সরকার ও আওয়ামী লীগকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করেন মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ৩ এপ্রিল পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায়। গ্রামাঞ্চলে অপর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। এর কয়েকদিন আগে ৪ এপ্রিল ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ ও লন্ডনের ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘সিআইএ এবং চীনের সহায়তায় মওলানা ভাসানী বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন।’
১৯৭২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পল্টনের এক জনসভায় ভাসানী বলেন, ‘জনগণের ইচ্ছায় সরকার পরিচালিত হবে। জনগণকে বাদ দিয়ে সরকার চলতে পারে না।’ তিনি দাবি করেন, ‘সর্বদলীয় সরকার চাই, অন্ন, বস্ত্র দাও, না হলে গদি ছাড়।’ ভাসানী আরো বলেন, ‘জনগণের দুঃখ-দৈন্য দূর করার ব্যাপারে মুজিব সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি গণপরিষদ ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে জাতীয় কনভেনশন ডেকে জাতীয় সরকার গঠন করার আহ্বান জানান। সভা শেষে একটি ১৮ দফা স্মারকলিপি পেশ করেন (গণকণ্ঠ ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)। কিন্তু এই মওলানা ভাসানীই ভিন্ন কথা বলেছিলেন ১৯৭১ সালে মুজিবনগরে। এক বৈঠকে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা স্বীকার করে সর্বদলীয় সরকার গঠনের দাবি উত্থাপনকারীদের বলেন, ‘১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তারা পরাজিত হন।’
ভাসানী তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী সব দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিদের এই বৈঠকে বলেন, ‘সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে অন্যান্য পার্টির প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছে বলে সঙ্গতকারণেই এ নেতাদের নিয়ে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করা সম্ভব নয়।’ এই বৈঠকে ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী মুজিবনগর সরকারের নীতি-নির্ধারণ সংক্রান্ত একটি সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। উপদেষ্টা কমিটির প্রথম বৈঠকে মুজিবনগর সরকারকে বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সরকার বলে মেনে নেওয়া হয় (২১ এপ্রিল ১৯৯২, আজকের কাগজ, এম আর আকতার মুকুল)। অথচ ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতার ভিত্তি অপরিবর্তিত থাকা সত্ত্বেও ভাসানী সর্বদলীয় সরকারের দাবি উত্থাপন করেন।
জনসভা, বক্তৃতা ও বিবৃতিতে ভাসানী তার ভারতবিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রেখে বলেন, ‘বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতীয় নেতার হাতের পুতুল ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতের নির্দেশ অনুযায়ী তারা কাজ করে (গণকণ্ঠ, ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)। মাওপন্থি, স্বাধীনতা বিরোধীপন্থি ও তথাকথিত বামপন্থিদের নেতা ভাসানী শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে দাবি তোলেন বাংলাদেশের সংবিধান অবশ্যই পবিত্র কোরআন, সুন্নাহ ও হাদিসকে ভিত্তি করে রচনা করতে হবে (৮ অক্টোবর, ১৯৭২ মর্নিং নিউজ)। জামায়াত-মুসলিম লীগের এ নীতিকেই সামনে তুলে ধরলেন ভাসানী। ধর্মনিরপেক্ষতাকে তুলোধুনো করলেন তিনি।
ভাসানী কখনো মুজিবকে নিজের পুত্র বলে অভিহিত করেছেন। কখনো পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলেছেন। কখনো ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ভারত-বাংলাদেশ কনফেডারেশন গড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। কখনো আসামে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য জমি চেয়েছেন ইন্দিরা গান্ধীর কাছে।
লেখক: হাওরবার্তা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ।