হাওর বার্তা ডেস্কঃ রওশন আরা খাতুনের বেড়ে ওঠা সরকারি শিশু পরিবারে। সেখানে থেকেই পড়াশোনা। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়। সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়ছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর এখন তার লক্ষ্য বিসিএস দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার। মেধাবী এই অধম্য তরুণীর সাফল্যগাঁথা উঠে এসেছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারের বাজেট বইয়ে। তাকে নিয়ে লেখাটার শিরোনাম করা হয়েছে ‘রওশন এর আলো’ নামে। এই খবরটি প্রথমে জানতেন না রওশন। ঢাকা টাইমসের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় তার সঙ্গে। আবেগাপ্লুত রওশন জানান তার সংগ্রামের কথা। তার পাশে শিশু পরিবারের সবাইর সহায়তার কথা।
২০০১ সাল থেকে খুলনার সরকারি শিশু পরিবারে বেড়ে ওঠা রওশনের। তার সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী বাজেট বইয়ে তুলে ধরা হয়। এই অর্থবছরে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মোট বাজেটে শিশু-সংশ্লিষ্ট অংশের পরিমাণ ২৮.৭৯ শতাংশ। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এর পরিমাণ ছিল ২৫.১৭ % এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ছিল ২০.৮৮ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে অর্থ বিভাগের বাজেট বইয়ের ৭৮ ও ৭৯ পৃষ্ঠায় ৫.০ নং কেস স্টাডিতে এই কৃতী শিক্ষার্থীর অনুভূতি স্থান পেয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বইয়ে তার নিজের লেখা অনুভূতি স্থান পাওয়ায় খুশিতে আত্মহারা রওশন। তিন বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর ২০০১ সালে খুলনার সরকারি শিশু পরিবারে স্থান হয় তার। শিশু বয়সে নতুন জীবন পেয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। প্রথম স্থান পেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষায় তার প্রাপ্তিটা ছিল মধুময়। সেই থেকে নিজেকে আরও বেশি লেখাপড়ায় মনোযোগী করে এই শিশু রওশন।
এরপর রওশন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসে প্রথম-তৃতীয় স্থানের মধ্যে থেকেছেন। পাশাপাশি শিশু বয়স থেকেই গান, আবৃত্তি, অভিনয় ও ছবি আঁকার প্রতি তার ছিল বেশ আগ্রহ। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ১০ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে একটানা প্রথম স্থান ধরে রেখেছিলেন জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলা রওশন। ২০১১ সালে এসএসসি ও ২০১৩ সালে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত হন তিনি। পাশাপাশি খুলনার সরকারি শিশু পরিবারে থেকেই দর্জি বিজ্ঞান, কম্পিউটার পশিক্ষণ ও বিউটিফিকেশনের কাজ শিখে নেন। এ ছাড়া খুলনা বিভাগীয় পর্যায়ে স্পোটর্সে চ্যাম্পিয়ন হন রওশন আরা খাতুন।
উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে খুলনা, রাজশাহী ও গোপালগঞ্জে ভর্তির সুযোগ হয়। কিন্তু শিশু পরিবারের শিক্ষিকা ও স্বজনদের পছন্দ অনুযায়ী ২০১৫ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন রওশন। এখন সে ওই বিভাগের শেষ বর্ষে রয়েছেন। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করার আগ্রহ এ নারী যোদ্ধার।
বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নের মাশকাটা গ্রামের মৃত মো. আলী শেখের কন্যা রওশন আরা খাতুন। তার মা পবিত্র কোরআনের হাফেজ মালেকা বেগম। বড়বোন তাহমিনা আক্তার বাগেরহাটের সরকারি শিশু পরিবারে থেকে বড় হয়েছেন। লেখাপড়া শিখে এখন তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তরের ইউনিয়ন সমাজকর্মী হিসেবে কর্মরত।
রওশন সাংবাদিককে বলেন, ‘শিশু বয়সে যখন খুলনার সরকারি শিশু পরিবারে আসি, তখন কিছুই বুঝতাম না। মাসে এক-দুবার মা এসে দেখা করে যেতেন। বাবার চেহারাটা তিন বছর বয়সে দেখেছি কিন্তু মনে নেই। স্কুলে অন্য সহপাঠীদের বাবা-মাকে দেখে মন কাঁদত।’
‘শিশু পরিবারে যারা আমাকে লালনপালন করে বড় করেছেন তাদের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ। তারা কখনো বাবা-মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। ভবিষ্যতে এ দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চাই। বাংলাদেশ পুলিশের একজন দক্ষ কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে আমার।’
সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা) খুলনার উপ-তত্ত্বাবধায়ক আবিদা আফরিন সাংবাদিককে বলেন, ‘২০০৩ সালে শিশু রওশন আরা খাতুনকে এখানে নেয়া হয়। তাকে আমরা আদর করে ময়না নামে ডাকি। সেই শিশু ময়না আজ অনেক বড় হয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়া করছে। এখন তার ইচ্ছা মোতাবেক পুলিশ ক্যাডারে যোগদানের জন্য বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সমাজসেবা অধিদপ্তর তার পাশে থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে ও করবে।’
সমাজসেবা অধিদপ্তর খুলনার উপ-পরিচালক খান মোতাহার হোসেন বলেন, ‘সমাজের অবহেলিত শিশুদের সুন্দর জীবন উপহার দিতে সরকারের এ উদ্যোগ কাজে লেগেছে। আজ রওশন আরা খাতুন তার জলন্ত উদাহরণ। আমরা তার পাশে আছি এবং থাকব।’