ঢাকা ০১:৪৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রিকশা চলে, চলে না জবেদার জীবন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:১০:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০১৯
  • ২৫৫ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রোদে পোড়েন তিনি প্রতিদিন। বৃষ্টি হলে ভেজেন বৃষ্টিতেও। ধুলোমাখা বাতাসে ধূসরিত হন। কনক্রিটের এই শহরের সিসা গেলেন প্রতি নিঃশ্বাসে। তবু অনড়, অনিবার্য নিয়তি নিয়েই জবেদা বেগম। ফুটপাত আগলে থাকে তার ৯০ পেরোনো শরীর। দেহে মানচিত্রময় বয়সী ছাপ, রক্তনালি বিশ্রীভাবে জানান দিচ্ছে সেগুলোর অস্তিত্ব। সোজা হয় না কোমর। একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে সবকিছু। তবু চালিয়ে যান মেরামত। নিজেকে নয়; কখনও রিকশা, কখনও সাইকেল। এ করেই যে তার নিত্য সময়, যাপিত হয় ক্ষয়ে যাওয়া জীবন।

জবেদা বেগম হাঁপিয়ে ওঠেন। সাইকেলের একটি চাকা হাওয়া করতেই ধড়ফড় করে ওঠে বুক। লম্বা শ্বাস নেন, শুরু হয় আবার-পাম্পার হাতে হাওয়া সঞ্চালন। রিকশার চাকা জ্যাম, হাতে ডপার নিয়ে তেল লাগান তাতে। হাতুড়ির টুকটাক বাড়ি, টাল ভাঙান চাকার। হাত লাগান রিকশাচালক নিজেও। কাজ শেষে যে যা দেয়, তিনি তাতেই খুশি।

কখনও পাঁচ টাকা, কখনও দশ টাকা পাওয়া যায় রিকশায় হাওয়া দেওয়ায়। তেল দিয়ে দিলেও ওই একই টাকা। দিন শেষে দেড়শ’ থেকে দুইশ’। যার অর্ধেক চলে যায় তেল কিনতেই। বাড়তি যা থাকে তা দিয়েই কোনো রকমে চলে দু’বেলা, দুর্মর এক সময়।

জবেদা বেগমের দিন শুরু হয় ভোরে, সূর্য ওঠার কিছুটা আগেই। সাইকেল-রিকশা মেরামতের যন্ত্রপাতি নিয়ে মিরপুর ১১ নম্বরের ফুটপাতে, বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের পশ্চিম পাশে, পেছনে সুপার শপ ক্যারি ফ্যামিলি। ছোট ছোট প্লাস্টিকের ডপারে সাজিয়ে রাখেন পসরা। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখেন ইটের ওপর। হাওয়া করার যন্ত্রটি রাখেন সব যন্ত্রের সামনে।

চলতে চলতে যন্ত্রপাতি বিগড়ে যায় রিকশার। কয়েক বেলা তেল দিতে হয় প্রতিদিন। চাকায় হাওয়া দিতে হয় একাধিকবার। টাল ভাঙতে হয় চাকার। কাজ করতে হয় গিয়ারের। এ সবই নরম হাতে করে থাকেন জবেদা বেগম।

‘খালা?’ হাসি দিয়ে কথা বলা শুরু করতেই হাসতে চেষ্টা করেন জবেদা বেগমও। তপ্ত দুপুর, ঘাম ঝরানো বাতাস, ভাঁজ পড়া মুখের সেই হাসিটা যেন অপার্থিব, ‘রিকশার সামনের চাকায় হাওয়া দিতে হয় বেশি আর পিছনের চাকাগুলোতে একটু কম। তাতে ড্রাইভার ও যাত্রীদের কষ্ট কম হয়।’ গলার স্বরে অভিজ্ঞতা।

‘হাওয়া দেওয়া তো কষ্টের কাজ।’ ‘অনেক কষ্টের। রিকশার টাল ভাঙাতে হয় হাতুড়ি দিয়ে, ধীরে ধীরে বাড়ি দিয়ে। হাতুড়ির বাড়ি একটু উনিশ-বিশ হলেই রিকশার টাল আর ছোটে না।’

বাবা আব্দুস ছামাদের হাত ধরে বিহার থেকে বাংলাদেশে আসেন তরুণী জবেদা বেগম। মিরপুর ১১ নম্বর বিহারি ক্যাম্পে ঠাঁই নেন তারা। স্বামী বাদশা মিয়া গত হয়েছেন বহু আগেই। এক ছেলে আর এক মেয়ে আলাদা সংসার পেতেছে। অভাবী তারাও। মায়ের খোঁজ নিতে পারে না তাই। ছেলের ঘরের পাঁচ নাতি। ছেলে-বউ মিলে কাজ করেও ভাত জোটে না দু’বেলা। কখনও কখনও বিহারি ক্যাম্পের ছোট্ট ঘরের মেঝেতে পিঠ ঠেকানোর সুযোগ পান। বৃষ্টির দিনগুলোতে মেঝেতে পানি জমে, তখন রাত কাটে বসে বসেই।

খাবারের জন্য ছেলের বউকে ৫০ টাকা দেন জবেদা বেগম। দু’বেলার জন্য ১০০ টাকা। রিকশার চাকায় হাওয়া করতে আসা সুরুজ মিয়া বলেন, ‘খালার এখানে নিজে হাওয়া করা যায়। খালা শুধু তেল ভরে দেন। এতে পাঁচ টাকা দিলেই হয়। অন্য মিস্ত্রির কাছে গেলে বাচ্চাদের দিয়ে হাওয়া করায় এবং সামান্য সমস্যার জন্য রিকশায় হাত লাগালেই পঞ্চাশ টাকা।’

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রিকশা চলে ঢাকায়। প্রায় ১০ লাখ। ঢাকার রিকশা এখন এই শহরের কোটি মানুষের চলাচলের মাধ্যম। পরিবেশবান্ধব এই ত্রিচক্র যানকে দায়ী করা হয় ঢাকার যানজটের অন্যতম কারণ। পরিবেশবিদরা বলেন, ‘রিকশা না থাকলে ঢাকার বায়ুদূষণ হবে বিশ্বের মধ্যে এক নম্বর।’ জবেদা বেগমের নরম হাতে দেওয়া তেলে রিকশার চাকা ঘোরে আরামে। কিন্তু জীবনের চাকা যে ঘোরে না তার। ভালো করে জোটে না দু’বেলা দু’মুঠো ভাত। রিকশায় চড়ে বাতাস খেতে খেতে যানজটের এই শহরে নগরবাসীরা যখন সুখানুভূতিতে ভেসে যান, রিকশার পেছনে তখন থেকে যায় জবেদা বেগমের মতো অসংখ্য মানুষের কলজেফাটা জীবন-শ্বাস!

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

রিকশা চলে, চলে না জবেদার জীবন

আপডেট টাইম : ০১:১০:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রোদে পোড়েন তিনি প্রতিদিন। বৃষ্টি হলে ভেজেন বৃষ্টিতেও। ধুলোমাখা বাতাসে ধূসরিত হন। কনক্রিটের এই শহরের সিসা গেলেন প্রতি নিঃশ্বাসে। তবু অনড়, অনিবার্য নিয়তি নিয়েই জবেদা বেগম। ফুটপাত আগলে থাকে তার ৯০ পেরোনো শরীর। দেহে মানচিত্রময় বয়সী ছাপ, রক্তনালি বিশ্রীভাবে জানান দিচ্ছে সেগুলোর অস্তিত্ব। সোজা হয় না কোমর। একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে সবকিছু। তবু চালিয়ে যান মেরামত। নিজেকে নয়; কখনও রিকশা, কখনও সাইকেল। এ করেই যে তার নিত্য সময়, যাপিত হয় ক্ষয়ে যাওয়া জীবন।

জবেদা বেগম হাঁপিয়ে ওঠেন। সাইকেলের একটি চাকা হাওয়া করতেই ধড়ফড় করে ওঠে বুক। লম্বা শ্বাস নেন, শুরু হয় আবার-পাম্পার হাতে হাওয়া সঞ্চালন। রিকশার চাকা জ্যাম, হাতে ডপার নিয়ে তেল লাগান তাতে। হাতুড়ির টুকটাক বাড়ি, টাল ভাঙান চাকার। হাত লাগান রিকশাচালক নিজেও। কাজ শেষে যে যা দেয়, তিনি তাতেই খুশি।

কখনও পাঁচ টাকা, কখনও দশ টাকা পাওয়া যায় রিকশায় হাওয়া দেওয়ায়। তেল দিয়ে দিলেও ওই একই টাকা। দিন শেষে দেড়শ’ থেকে দুইশ’। যার অর্ধেক চলে যায় তেল কিনতেই। বাড়তি যা থাকে তা দিয়েই কোনো রকমে চলে দু’বেলা, দুর্মর এক সময়।

জবেদা বেগমের দিন শুরু হয় ভোরে, সূর্য ওঠার কিছুটা আগেই। সাইকেল-রিকশা মেরামতের যন্ত্রপাতি নিয়ে মিরপুর ১১ নম্বরের ফুটপাতে, বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের পশ্চিম পাশে, পেছনে সুপার শপ ক্যারি ফ্যামিলি। ছোট ছোট প্লাস্টিকের ডপারে সাজিয়ে রাখেন পসরা। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখেন ইটের ওপর। হাওয়া করার যন্ত্রটি রাখেন সব যন্ত্রের সামনে।

চলতে চলতে যন্ত্রপাতি বিগড়ে যায় রিকশার। কয়েক বেলা তেল দিতে হয় প্রতিদিন। চাকায় হাওয়া দিতে হয় একাধিকবার। টাল ভাঙতে হয় চাকার। কাজ করতে হয় গিয়ারের। এ সবই নরম হাতে করে থাকেন জবেদা বেগম।

‘খালা?’ হাসি দিয়ে কথা বলা শুরু করতেই হাসতে চেষ্টা করেন জবেদা বেগমও। তপ্ত দুপুর, ঘাম ঝরানো বাতাস, ভাঁজ পড়া মুখের সেই হাসিটা যেন অপার্থিব, ‘রিকশার সামনের চাকায় হাওয়া দিতে হয় বেশি আর পিছনের চাকাগুলোতে একটু কম। তাতে ড্রাইভার ও যাত্রীদের কষ্ট কম হয়।’ গলার স্বরে অভিজ্ঞতা।

‘হাওয়া দেওয়া তো কষ্টের কাজ।’ ‘অনেক কষ্টের। রিকশার টাল ভাঙাতে হয় হাতুড়ি দিয়ে, ধীরে ধীরে বাড়ি দিয়ে। হাতুড়ির বাড়ি একটু উনিশ-বিশ হলেই রিকশার টাল আর ছোটে না।’

বাবা আব্দুস ছামাদের হাত ধরে বিহার থেকে বাংলাদেশে আসেন তরুণী জবেদা বেগম। মিরপুর ১১ নম্বর বিহারি ক্যাম্পে ঠাঁই নেন তারা। স্বামী বাদশা মিয়া গত হয়েছেন বহু আগেই। এক ছেলে আর এক মেয়ে আলাদা সংসার পেতেছে। অভাবী তারাও। মায়ের খোঁজ নিতে পারে না তাই। ছেলের ঘরের পাঁচ নাতি। ছেলে-বউ মিলে কাজ করেও ভাত জোটে না দু’বেলা। কখনও কখনও বিহারি ক্যাম্পের ছোট্ট ঘরের মেঝেতে পিঠ ঠেকানোর সুযোগ পান। বৃষ্টির দিনগুলোতে মেঝেতে পানি জমে, তখন রাত কাটে বসে বসেই।

খাবারের জন্য ছেলের বউকে ৫০ টাকা দেন জবেদা বেগম। দু’বেলার জন্য ১০০ টাকা। রিকশার চাকায় হাওয়া করতে আসা সুরুজ মিয়া বলেন, ‘খালার এখানে নিজে হাওয়া করা যায়। খালা শুধু তেল ভরে দেন। এতে পাঁচ টাকা দিলেই হয়। অন্য মিস্ত্রির কাছে গেলে বাচ্চাদের দিয়ে হাওয়া করায় এবং সামান্য সমস্যার জন্য রিকশায় হাত লাগালেই পঞ্চাশ টাকা।’

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রিকশা চলে ঢাকায়। প্রায় ১০ লাখ। ঢাকার রিকশা এখন এই শহরের কোটি মানুষের চলাচলের মাধ্যম। পরিবেশবান্ধব এই ত্রিচক্র যানকে দায়ী করা হয় ঢাকার যানজটের অন্যতম কারণ। পরিবেশবিদরা বলেন, ‘রিকশা না থাকলে ঢাকার বায়ুদূষণ হবে বিশ্বের মধ্যে এক নম্বর।’ জবেদা বেগমের নরম হাতে দেওয়া তেলে রিকশার চাকা ঘোরে আরামে। কিন্তু জীবনের চাকা যে ঘোরে না তার। ভালো করে জোটে না দু’বেলা দু’মুঠো ভাত। রিকশায় চড়ে বাতাস খেতে খেতে যানজটের এই শহরে নগরবাসীরা যখন সুখানুভূতিতে ভেসে যান, রিকশার পেছনে তখন থেকে যায় জবেদা বেগমের মতো অসংখ্য মানুষের কলজেফাটা জীবন-শ্বাস!