ঢাকা ০৩:৩৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খুলনার কয়রা উপজেলায় পানির জন্য প্রায় ৫ কি.মি.পথ পাড়ি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:৪৬:৩২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৯
  • ২২৪ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ জন্মের পরতে দেখি আসতিচি আমাগে খাবার পানির কষ্ট, এ কষ্ট কমে না। রাত পোহালি কলসি নিয়ে ছুটতি হয়। সারাদিন কাইটে যায় পানি আনতি। সংসারের অন্য কাজ করতি হিমশিম খাই।’ খাবার পানির কষ্টের কথা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন খুলনার কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা গ্রামের গৃহবধূ তসলিমা খাতুন। প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গুড়িয়াবাড়ি গ্রামের বাবুর পুকুর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছিলেন এই নারী। তার সঙ্গী আরও কয়েকজন রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের কোমরে পানির কলস।

তারা জানান, শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে অর্থাৎ ফাল্কগ্দুন মাস থেকে তাদের গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী চার গ্রামের মানুষ ওই পুকুরের পানির ওপর নির্ভরশীল। এর আগে পর্যন্ত সংরক্ষণ করা বৃষ্টির পানিতে দিয়ে চলে। কষ্টের শুরু হয় ফাল্কগ্দুন মাস থেকে, শেষ হয় বর্ষা মৌসুমে। শুষ্ক মৌসুমে প্রতিদিন নিয়ম করে গ্রামের নারীরা এভাবে দলবেঁধে পানি সংগ্রহ করেন। এক কাঁধে কলস অন্য কাঁধে বাচ্চা নিয়ে ইসলামপুর গ্রামের সরকারি পুকুর থেকে পানি নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন নারায়ণপুর গ্রামের সাথী রাণী। তিনি জানান, বাচ্চা নিয়ে প্রতিদিন তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পানি আনেন।

ইসলামপুর গ্রামের বাসিন্দা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলের মানুষের বিশুদ্ধ খাবার পানির সমস্যা চলে আসছে। লবণাক্ততার কারণে নলকূপের পানি পানযোগ্য না হওয়ায় এলাকার মানুষের খাবার পানির প্রধান উৎস পুকুর। অথচ শুষ্ক মৌসুমে বেশিরভাগ পুকুরেই পানি থাকে না। তখন খাবার পানির সন্ধানে ছুটতে হয় মাইলের পর মাইল।’

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই উপজেলায় দুই লাখ ৯৪ হাজার মানুষের বসবাস। এদের ৬০ শতাংশই সুপেয় পানির সংকটে। তাদের চাহিদা মেটাতে ২২৮টি পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) থাকলেও ২০৪টি অচল। দুই হাজার ৭১৪টি নলকূপের মধ্যে অকার্যকর ৪৩৮টি। তবে অধিকাংশ নলকূপের পানিতে অতিরিক্ত আয়রন ও লবণাক্ততায় তা পানযোগ্য নয়। লবণাক্ত পানি শোধনের নয়টি ডি-স্যালাইনেশন প্লান্টের সাতটি সচল আছে। এসব প্লান্ট থেকে ৫০ পয়সা দরে প্রতি লিটার পানি বিক্রি হলেও চাহিদার তুলনায় পানির সরবরাহ অপ্রতুল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাবছরই লোনা পানির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যেতে হয় উপজেলাবাসীর। অগভীর বা গভীর নলকূপ অকার্যকর। বৃষ্টি ও পুকুরের পানিই তাদের ভরসা। আর যাদের সামর্থ্য আছে, তারা টাকা দিয়ে পানি সংগ্রহ করেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত বৃষ্টির পানি পান করেন তারা। মাঘের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তা দিয়ে চলে। সারাবছরই পানির সংকট থাকলেও মাঘের মাঝ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত চলে তীব্র সংকট।

উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে অফুরন্ত জলরাশির মধ্যেও খাওয়ার পানির জন্য ছুটতে হয় ৪-৫ কিলোমিটার দূরে। তার পরও মিলছে না বিশুদ্ধ পানি। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে পানির জন্য নিরন্তর সংগ্রাম। মাইলের পর মাইল হেঁটে বা নছিমন, ট্রলার ও নৌকায় করে দূরে গিয়ে পুকুর থেকে পানি আনতে হয়। তবে গোসল, থালা-বাসন ও কাপড় ধোয়ার কাজ চলে নোনাপানি দিয়েই।

কয়রার উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশীর পানি কিছুটা ভালো। তবে মহেশ্বরীপুর, বাগালি ও আমাদি ইউনিয়নে পানির সংকট তীব্র। সেখানকার কোনো নলকূপই কার্যকর নেই। একই অবস্থা মহারাজপুর ও কয়রা সদর ইউনিয়নের কিছু অংশেও।

পানি-সংকট নিরসনে কয়েকটি ইউনিয়নে পুকুর পুনঃখনন ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান কয়রা উপজেলা পরিষদের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান আ খ ম তমিজ উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘তিন লাখ মানুষের এ উপজেলায় পানির সংকট ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই সংকট দিন দিন আরও বাড়ছে।’

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, খাবার পানির সংকট নিরসনের জন্য তারা জেলা ও উপজেলার প্রতিটি সমন্বয় সভায় বিভিন্ন প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন হয় না।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী প্রশান্ত পাল বলেন, এখানকার মানুষের খাবার পানির প্রধান উৎস পুকুরের পানি। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে এলাকার মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় খাবার পানির উৎস নষ্ট হতে চলেছে। এ জন্য পুকুর খনন করে সেখানে পর্যাপ্ত বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখার বিকল্প নেই।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

খুলনার কয়রা উপজেলায় পানির জন্য প্রায় ৫ কি.মি.পথ পাড়ি

আপডেট টাইম : ০৩:৪৬:৩২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ জন্মের পরতে দেখি আসতিচি আমাগে খাবার পানির কষ্ট, এ কষ্ট কমে না। রাত পোহালি কলসি নিয়ে ছুটতি হয়। সারাদিন কাইটে যায় পানি আনতি। সংসারের অন্য কাজ করতি হিমশিম খাই।’ খাবার পানির কষ্টের কথা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন খুলনার কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা গ্রামের গৃহবধূ তসলিমা খাতুন। প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গুড়িয়াবাড়ি গ্রামের বাবুর পুকুর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছিলেন এই নারী। তার সঙ্গী আরও কয়েকজন রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের কোমরে পানির কলস।

তারা জানান, শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে অর্থাৎ ফাল্কগ্দুন মাস থেকে তাদের গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী চার গ্রামের মানুষ ওই পুকুরের পানির ওপর নির্ভরশীল। এর আগে পর্যন্ত সংরক্ষণ করা বৃষ্টির পানিতে দিয়ে চলে। কষ্টের শুরু হয় ফাল্কগ্দুন মাস থেকে, শেষ হয় বর্ষা মৌসুমে। শুষ্ক মৌসুমে প্রতিদিন নিয়ম করে গ্রামের নারীরা এভাবে দলবেঁধে পানি সংগ্রহ করেন। এক কাঁধে কলস অন্য কাঁধে বাচ্চা নিয়ে ইসলামপুর গ্রামের সরকারি পুকুর থেকে পানি নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন নারায়ণপুর গ্রামের সাথী রাণী। তিনি জানান, বাচ্চা নিয়ে প্রতিদিন তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পানি আনেন।

ইসলামপুর গ্রামের বাসিন্দা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলের মানুষের বিশুদ্ধ খাবার পানির সমস্যা চলে আসছে। লবণাক্ততার কারণে নলকূপের পানি পানযোগ্য না হওয়ায় এলাকার মানুষের খাবার পানির প্রধান উৎস পুকুর। অথচ শুষ্ক মৌসুমে বেশিরভাগ পুকুরেই পানি থাকে না। তখন খাবার পানির সন্ধানে ছুটতে হয় মাইলের পর মাইল।’

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই উপজেলায় দুই লাখ ৯৪ হাজার মানুষের বসবাস। এদের ৬০ শতাংশই সুপেয় পানির সংকটে। তাদের চাহিদা মেটাতে ২২৮টি পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) থাকলেও ২০৪টি অচল। দুই হাজার ৭১৪টি নলকূপের মধ্যে অকার্যকর ৪৩৮টি। তবে অধিকাংশ নলকূপের পানিতে অতিরিক্ত আয়রন ও লবণাক্ততায় তা পানযোগ্য নয়। লবণাক্ত পানি শোধনের নয়টি ডি-স্যালাইনেশন প্লান্টের সাতটি সচল আছে। এসব প্লান্ট থেকে ৫০ পয়সা দরে প্রতি লিটার পানি বিক্রি হলেও চাহিদার তুলনায় পানির সরবরাহ অপ্রতুল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাবছরই লোনা পানির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যেতে হয় উপজেলাবাসীর। অগভীর বা গভীর নলকূপ অকার্যকর। বৃষ্টি ও পুকুরের পানিই তাদের ভরসা। আর যাদের সামর্থ্য আছে, তারা টাকা দিয়ে পানি সংগ্রহ করেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত বৃষ্টির পানি পান করেন তারা। মাঘের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তা দিয়ে চলে। সারাবছরই পানির সংকট থাকলেও মাঘের মাঝ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত চলে তীব্র সংকট।

উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে অফুরন্ত জলরাশির মধ্যেও খাওয়ার পানির জন্য ছুটতে হয় ৪-৫ কিলোমিটার দূরে। তার পরও মিলছে না বিশুদ্ধ পানি। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে পানির জন্য নিরন্তর সংগ্রাম। মাইলের পর মাইল হেঁটে বা নছিমন, ট্রলার ও নৌকায় করে দূরে গিয়ে পুকুর থেকে পানি আনতে হয়। তবে গোসল, থালা-বাসন ও কাপড় ধোয়ার কাজ চলে নোনাপানি দিয়েই।

কয়রার উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশীর পানি কিছুটা ভালো। তবে মহেশ্বরীপুর, বাগালি ও আমাদি ইউনিয়নে পানির সংকট তীব্র। সেখানকার কোনো নলকূপই কার্যকর নেই। একই অবস্থা মহারাজপুর ও কয়রা সদর ইউনিয়নের কিছু অংশেও।

পানি-সংকট নিরসনে কয়েকটি ইউনিয়নে পুকুর পুনঃখনন ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান কয়রা উপজেলা পরিষদের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান আ খ ম তমিজ উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘তিন লাখ মানুষের এ উপজেলায় পানির সংকট ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই সংকট দিন দিন আরও বাড়ছে।’

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, খাবার পানির সংকট নিরসনের জন্য তারা জেলা ও উপজেলার প্রতিটি সমন্বয় সভায় বিভিন্ন প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন হয় না।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী প্রশান্ত পাল বলেন, এখানকার মানুষের খাবার পানির প্রধান উৎস পুকুরের পানি। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে এলাকার মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় খাবার পানির উৎস নষ্ট হতে চলেছে। এ জন্য পুকুর খনন করে সেখানে পর্যাপ্ত বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখার বিকল্প নেই।