ঢাকা ০৮:০৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাজ্জাক, সুরঞ্জিতরা কি আর ফিরে আসবেন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৫১:১৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৭
  • ৩০০ বার

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও চলে গেলেন। আমি ‘র‍্যাটস’ নামে পরিচিত চার আওয়ামী লীগ নেতার কথা বলছি। রাজ্জাক (আব্দুর রাজ্জাক), আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত- চারজনের ইংরেজি বানানের আদ্যক্ষর নিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের বর্ষীয়ান এ নেতৃবৃন্দ পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘র‍্যাটস’ নামে। আমরা যারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতা-সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন (অবঃ) এম মনসুর আলীদের নিজ চোখে দেখিনি, সরাসির শুনিনি, তাদের কাছে শ্রদ্ধাভাজন জাতীয় রাজনীতিবিদের অবয়ব এবং ব্যক্তিত্ব নিয়ে যারা হাজির হয়েছেন, তাঁদের অন্যতম এই চারজন।

আব্দুর রাজ্জাক পরপারে পাড়ি দিয়েছিলেন ২০১১ সালে। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে পরলোক গমন করলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আব্দুর রাজ্জাক মৃত্যু-পরবর্তীতে প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সম্মান পাননি বলে অভিযোগ আছে। সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের বেলায় এমনটা ঘটবেনা বলেই প্রতীয়মান।

তবে সুরঞ্জিতের মৃতদেহ ঢাকেশ্বরী মন্দির আর সংসদ ভবনে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য রাখা হলেও আপামর জনসাধারণের জন্য শহীদ মিনার জাতীয় কেন্দ্রীয় স্থানে রাখা উচিত ছিল কিনা, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকে বলেছেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুধুমাত্র একজন ‘হিন্দু’ কিংবা শুধুই একজন সংসদ সদস্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, উচ্চ শিক্ষিত, সুদক্ষ, জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান বাঙ্গালী রাজনীতিবিদ। দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক মহাশক্তি। তাহলে কেন উনার মত একজন উজ্জ্বল বাঙালি ব্যক্তিত্বকে মন্দির আর সংসদের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখা হল? কেন তাঁর মৃতদেহ জাতীয় শহীদ মিনারে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য রাখা হলনা। শহীদ মিনারই যে আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নির্দেশক।

শহীদ মিনারে রাখা হলে বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের সন্তানেরা আরও নিবিড়ভাবে অনুধাবন করত কীভাবে একজন মানুষ সকল, ধর্ম ও শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বদেশকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানরা একসাথে যতগুলো বড় ঘটনা ঘটিয়েছে তার অন্যতম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। আবার এখন চলছেও ভাষার মাস। তাহলে সমস্যা ছিল কোথায়? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জীবনের শেষ দিনেও একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলে গেছেন। আওয়ামীলীগের মাহবুবুল আলম হানিফ, আফজাল হোসেন তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গেলে তিনি বলেছেন-শরীর গেছে যাক, মনের শক্তিতে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার চেষ্টা করবেন তিনি। শহীদ মিনার যদি আমাদের এখনো সব কিছুর কেন্দ্র হতে না পারে তাহলে মুখে অসাম্প্রদায়িকতার বুলি আওরিয়ে শেষ রক্ষা জাতির হবেনা। যাইহোক, রাষ্ট্র নেতারাই যদি না বুঝেন তাহলে আমাদের মত আওয়ামের এসব কথা বলা অরণ্যে রোদন ছাড়া কিছু নয়।

সর্বশেষ সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমু, তোফায়েল, রাজ্জাক আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ভূমিকা নিয়ে বেশ প্রশ্ন উঠলেও তাঁরা যে আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপরিহার্য সেটি আবার প্রমাণ হয়েছে মাঝখানের ‘দূরে সরিয়ে রাখা’ খান্ত দিয়ে ওনাদেরকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পণ করার মধ্য দিয়ে। শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন যথাক্রমে আমির হোসেন আমু এবং তোফায়েল আহমেদ। বিশেষ করে তোফায়েল আহমেদ যেভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন তা এক কথায় অসাধারণ। বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও ইদানিং সামলাতে হচ্ছে তাঁকে। জিএসপিসহ কয়েকটি ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ইচ্ছাকৃতভাবে অসহযোগিতা করছে সে বিষয়ে তোফায়েল আহমেদকে প্রায়শ সরব হতে দেখা যায়। নতুন যারা আওয়ামীলীগের লিডার হয়েছেন বা হতে যাচ্ছেন তাদের পক্ষে বিশ্বরাজনীতি ও স্থানীয় স্বার্থকে একটি সমন্বিত কাঠামোয় এনে শক্ত ভূমিকা পালন করা বেশ কঠিন একটি কাজ।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত চলে যাওয়াতে ক্ষতি শুধু তার পরিবারের হয়নি। আওয়ামী লীগের তো বটেই, পুরো জাতির ক্ষতি হয়েছে। একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তৈরি করা যাবেনা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মত মানুষ বিস্তর পড়ালেখা করে, অভিজ্ঞতা আর বিশাল যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিজেরাই নিজেদের নির্মাণ করেন। কেউ চাইলেই উনার মত হতে পারবেনা। বিশেষ করে আইনের মত কাটখোট্টা বিষয়ে এমন অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া, আবার কঠিন জ্ঞানকে সহজ করে বলা, তর্জমা করার দক্ষতা অর্জন করা মোটেও সহজ কোনো কাজ নয়। আইন ও রাজনীতির মিশেলে মহীরুহের মত বিশাল ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। তাঁর জায়গা নেয়ার মত রাজনীতিবিদ এখন আর খুব একটা দেখা যায়না।

সুরঞ্জিত সেনের কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি মিস করবে দেশের মানুষ? কঠিন বিষয়কে সহজ ও মজা করে বলার দক্ষতা, নাকি তাঁর বিশেষ ধরনের বাগ্মিতা? ফেসবুকে যারা শোক জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন তাদের বক্তব্য পড়লেই পরিষ্কার হবে বিষয়গুলো। যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন লিখেছেন-‘ একজন সুরঞ্জিতের সামাজিক ইমেজে কালিমা লেপন করা সহজ , কঠিন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিতের অবদানকে ধ্বংস করা । এর চেয়েও অনেক কঠিন একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সৃষ্টি করা । সুরঞ্জিতরা যুগে যুগেও জন্মায় না। ওপারে ভালো থাকবেন দাদা’।

ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকি নাজমুল আলম লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জনসভায় নেতা কর্মীরা যখন ক্লান্ত হয়ে যেতো শেষ পর্যায়ে আপনার ১০ মিনিটের ভাষনে সবাই চাঙ্গা হয়ে যেতো । কে শোনাবে এই ভাষন দাদা ? ভালো থাকুন পরপারে’।

রাজনীতি বিশ্লেষক ড. হাসান মাহমুদ লিখেছেন, ‘স্পষ্টবাদী, তুখোড় বক্তা, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, নিরহংকারী শ্রদ্ধেয় নেতা সুরঞ্জিত বাবু আর নেই। সংসদে বক্তৃতাকালীন গোটা সংসদ তন্ময় হয়ে মুগ্ধতার সাথে আর শুনতে পারবে না বাবু সুরঞ্জিত এর বক্তৃতা’।

হাসান মাহমুদের একটি লেখা থেকে জানা যায়,রাজনীতির জীবন শুরু করেছিলেন সাম্যবাদের ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে। সাতবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন তিনি। ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে চারবার আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ১৯৭০ সালে ন্যাপ থেকে প্রথমবারের মতো সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে একতা পার্টি ও ১৯৭৯ সালে গণতন্ত্রী পার্টি থেকে সাংসদ হন। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও পরে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে আসেন তিনি।

১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা সব আসনে জয়ী হলেও একমাত্র সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ন্যাপ থেকে জয়ী হন। একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ৫ নম্বর সেক্টরের সাব কমান্ডার হিসেবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। তা ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনী আনার জন্য গঠিত কমিটির কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন।

তার ছাত্রজীবনের প্রথম অংশ কেটেছে সিলেট ও সুনামগঞ্জে। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। এরপর আইনে ডিগ্রি নেন। পেশাগত জীবনের শুরুতে তিনি কয়েক বছর আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে সংসদ-বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দলে ‘সংস্কারপন্থী’ নেতা বলে পরিচিতি পান তিনি। এ কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর তাকে মন্ত্রী করা হয়নি। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও বাদ পড়েন। ২০১২ সালে মন্ত্রীপরিষদে রদবদল হলে রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। কিন্তু এক সহকারীর গাড়িতে বিপুল পরিমাণ টাকা জব্দ হওয়ায় ব্যপক সমালোচনার মুখে পড়েন সুরঞ্জিত। সুরঞ্জিত যদিও দাবি করেছিলেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। কেউ তাঁর কথা শুনেনি। রাগে, ক্ষোভে তিনি পদত্যাগ করলেও তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করে রাখা হয়।

রেলের কালো বিড়ালকে তাড়াতে চেয়েছিলেন তিনি। পারেননি, বরং নিজেই পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। আর এবেলায় এসে বিদায় নিলেন চিরতরে। একজন সুরঞ্জিত আর আসবেননা। নতুন করে যারা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়েছেন কিংবা যারা ছাত্রলীগ, যুবলীগ করছেন কিংবা যারা রাজনীতিতে আসতে চাচ্ছেন তারা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জীবনী পড়ে দেখতে পারেন। চেষ্টা করে দেখতে পারেন একজন সুরঞ্জিত হওয়া যায় কিনা?

লেখকঃ সহকারি অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

রাজ্জাক, সুরঞ্জিতরা কি আর ফিরে আসবেন

আপডেট টাইম : ১১:৫১:১৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৭

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও চলে গেলেন। আমি ‘র‍্যাটস’ নামে পরিচিত চার আওয়ামী লীগ নেতার কথা বলছি। রাজ্জাক (আব্দুর রাজ্জাক), আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত- চারজনের ইংরেজি বানানের আদ্যক্ষর নিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের বর্ষীয়ান এ নেতৃবৃন্দ পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘র‍্যাটস’ নামে। আমরা যারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতা-সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন (অবঃ) এম মনসুর আলীদের নিজ চোখে দেখিনি, সরাসির শুনিনি, তাদের কাছে শ্রদ্ধাভাজন জাতীয় রাজনীতিবিদের অবয়ব এবং ব্যক্তিত্ব নিয়ে যারা হাজির হয়েছেন, তাঁদের অন্যতম এই চারজন।

আব্দুর রাজ্জাক পরপারে পাড়ি দিয়েছিলেন ২০১১ সালে। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে পরলোক গমন করলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আব্দুর রাজ্জাক মৃত্যু-পরবর্তীতে প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সম্মান পাননি বলে অভিযোগ আছে। সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের বেলায় এমনটা ঘটবেনা বলেই প্রতীয়মান।

তবে সুরঞ্জিতের মৃতদেহ ঢাকেশ্বরী মন্দির আর সংসদ ভবনে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য রাখা হলেও আপামর জনসাধারণের জন্য শহীদ মিনার জাতীয় কেন্দ্রীয় স্থানে রাখা উচিত ছিল কিনা, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকে বলেছেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুধুমাত্র একজন ‘হিন্দু’ কিংবা শুধুই একজন সংসদ সদস্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, উচ্চ শিক্ষিত, সুদক্ষ, জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান বাঙ্গালী রাজনীতিবিদ। দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক মহাশক্তি। তাহলে কেন উনার মত একজন উজ্জ্বল বাঙালি ব্যক্তিত্বকে মন্দির আর সংসদের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখা হল? কেন তাঁর মৃতদেহ জাতীয় শহীদ মিনারে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য রাখা হলনা। শহীদ মিনারই যে আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নির্দেশক।

শহীদ মিনারে রাখা হলে বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের সন্তানেরা আরও নিবিড়ভাবে অনুধাবন করত কীভাবে একজন মানুষ সকল, ধর্ম ও শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বদেশকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানরা একসাথে যতগুলো বড় ঘটনা ঘটিয়েছে তার অন্যতম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। আবার এখন চলছেও ভাষার মাস। তাহলে সমস্যা ছিল কোথায়? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জীবনের শেষ দিনেও একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলে গেছেন। আওয়ামীলীগের মাহবুবুল আলম হানিফ, আফজাল হোসেন তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গেলে তিনি বলেছেন-শরীর গেছে যাক, মনের শক্তিতে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার চেষ্টা করবেন তিনি। শহীদ মিনার যদি আমাদের এখনো সব কিছুর কেন্দ্র হতে না পারে তাহলে মুখে অসাম্প্রদায়িকতার বুলি আওরিয়ে শেষ রক্ষা জাতির হবেনা। যাইহোক, রাষ্ট্র নেতারাই যদি না বুঝেন তাহলে আমাদের মত আওয়ামের এসব কথা বলা অরণ্যে রোদন ছাড়া কিছু নয়।

সর্বশেষ সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমু, তোফায়েল, রাজ্জাক আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ভূমিকা নিয়ে বেশ প্রশ্ন উঠলেও তাঁরা যে আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপরিহার্য সেটি আবার প্রমাণ হয়েছে মাঝখানের ‘দূরে সরিয়ে রাখা’ খান্ত দিয়ে ওনাদেরকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পণ করার মধ্য দিয়ে। শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন যথাক্রমে আমির হোসেন আমু এবং তোফায়েল আহমেদ। বিশেষ করে তোফায়েল আহমেদ যেভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন তা এক কথায় অসাধারণ। বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও ইদানিং সামলাতে হচ্ছে তাঁকে। জিএসপিসহ কয়েকটি ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ইচ্ছাকৃতভাবে অসহযোগিতা করছে সে বিষয়ে তোফায়েল আহমেদকে প্রায়শ সরব হতে দেখা যায়। নতুন যারা আওয়ামীলীগের লিডার হয়েছেন বা হতে যাচ্ছেন তাদের পক্ষে বিশ্বরাজনীতি ও স্থানীয় স্বার্থকে একটি সমন্বিত কাঠামোয় এনে শক্ত ভূমিকা পালন করা বেশ কঠিন একটি কাজ।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত চলে যাওয়াতে ক্ষতি শুধু তার পরিবারের হয়নি। আওয়ামী লীগের তো বটেই, পুরো জাতির ক্ষতি হয়েছে। একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তৈরি করা যাবেনা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মত মানুষ বিস্তর পড়ালেখা করে, অভিজ্ঞতা আর বিশাল যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিজেরাই নিজেদের নির্মাণ করেন। কেউ চাইলেই উনার মত হতে পারবেনা। বিশেষ করে আইনের মত কাটখোট্টা বিষয়ে এমন অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া, আবার কঠিন জ্ঞানকে সহজ করে বলা, তর্জমা করার দক্ষতা অর্জন করা মোটেও সহজ কোনো কাজ নয়। আইন ও রাজনীতির মিশেলে মহীরুহের মত বিশাল ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। তাঁর জায়গা নেয়ার মত রাজনীতিবিদ এখন আর খুব একটা দেখা যায়না।

সুরঞ্জিত সেনের কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি মিস করবে দেশের মানুষ? কঠিন বিষয়কে সহজ ও মজা করে বলার দক্ষতা, নাকি তাঁর বিশেষ ধরনের বাগ্মিতা? ফেসবুকে যারা শোক জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন তাদের বক্তব্য পড়লেই পরিষ্কার হবে বিষয়গুলো। যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন লিখেছেন-‘ একজন সুরঞ্জিতের সামাজিক ইমেজে কালিমা লেপন করা সহজ , কঠিন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিতের অবদানকে ধ্বংস করা । এর চেয়েও অনেক কঠিন একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সৃষ্টি করা । সুরঞ্জিতরা যুগে যুগেও জন্মায় না। ওপারে ভালো থাকবেন দাদা’।

ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকি নাজমুল আলম লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জনসভায় নেতা কর্মীরা যখন ক্লান্ত হয়ে যেতো শেষ পর্যায়ে আপনার ১০ মিনিটের ভাষনে সবাই চাঙ্গা হয়ে যেতো । কে শোনাবে এই ভাষন দাদা ? ভালো থাকুন পরপারে’।

রাজনীতি বিশ্লেষক ড. হাসান মাহমুদ লিখেছেন, ‘স্পষ্টবাদী, তুখোড় বক্তা, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, নিরহংকারী শ্রদ্ধেয় নেতা সুরঞ্জিত বাবু আর নেই। সংসদে বক্তৃতাকালীন গোটা সংসদ তন্ময় হয়ে মুগ্ধতার সাথে আর শুনতে পারবে না বাবু সুরঞ্জিত এর বক্তৃতা’।

হাসান মাহমুদের একটি লেখা থেকে জানা যায়,রাজনীতির জীবন শুরু করেছিলেন সাম্যবাদের ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে। সাতবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন তিনি। ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে চারবার আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ১৯৭০ সালে ন্যাপ থেকে প্রথমবারের মতো সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে একতা পার্টি ও ১৯৭৯ সালে গণতন্ত্রী পার্টি থেকে সাংসদ হন। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও পরে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে আসেন তিনি।

১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা সব আসনে জয়ী হলেও একমাত্র সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ন্যাপ থেকে জয়ী হন। একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ৫ নম্বর সেক্টরের সাব কমান্ডার হিসেবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। তা ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনী আনার জন্য গঠিত কমিটির কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন।

তার ছাত্রজীবনের প্রথম অংশ কেটেছে সিলেট ও সুনামগঞ্জে। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। এরপর আইনে ডিগ্রি নেন। পেশাগত জীবনের শুরুতে তিনি কয়েক বছর আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে সংসদ-বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দলে ‘সংস্কারপন্থী’ নেতা বলে পরিচিতি পান তিনি। এ কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর তাকে মন্ত্রী করা হয়নি। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও বাদ পড়েন। ২০১২ সালে মন্ত্রীপরিষদে রদবদল হলে রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। কিন্তু এক সহকারীর গাড়িতে বিপুল পরিমাণ টাকা জব্দ হওয়ায় ব্যপক সমালোচনার মুখে পড়েন সুরঞ্জিত। সুরঞ্জিত যদিও দাবি করেছিলেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। কেউ তাঁর কথা শুনেনি। রাগে, ক্ষোভে তিনি পদত্যাগ করলেও তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করে রাখা হয়।

রেলের কালো বিড়ালকে তাড়াতে চেয়েছিলেন তিনি। পারেননি, বরং নিজেই পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। আর এবেলায় এসে বিদায় নিলেন চিরতরে। একজন সুরঞ্জিত আর আসবেননা। নতুন করে যারা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়েছেন কিংবা যারা ছাত্রলীগ, যুবলীগ করছেন কিংবা যারা রাজনীতিতে আসতে চাচ্ছেন তারা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জীবনী পড়ে দেখতে পারেন। চেষ্টা করে দেখতে পারেন একজন সুরঞ্জিত হওয়া যায় কিনা?

লেখকঃ সহকারি অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়