ঢাকা ০৭:৩৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পানছড়ির সাঁওতালরা ভালো নেই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:১০:৪৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ মে ২০১৫
  • ৩২২ বার

পানছড়ির সাঁওতালরা ভালো নেই। তাঁদের নেই বলতে কিছুই নেই। দিন কাটে কষ্টে। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। গ্রামে বাসা বেঁধেছে নানা সমস্যা। কোনো উন্নয়নকাজ হয়নি কোনো সরকারের আমলেই। তাঁদের কষ্ট শোনা বা সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যাঁদের ওপর বর্তায় তাঁরা কেউ খোঁজ নেন না।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অসেতু বিকাশ চাকমা জানান, বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের পৃথক বরাদ্দ থাকে না। তবু পরিষদ থেকে সাধ্যমতো সাঁওতালদের জন্য সহায়তার হাত বাড়ানো হয়।

পানছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা সাঁওতালদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে নিজেরা সংগঠিত না হওয়া এবং দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘আমি কয়েকবার সাঁওতালগ্রাম পরিদর্শন করে অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত হই। তাঁদেরকে আরো উদ্যোগী, উদ্যেমী ও কর্মঠ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে উপজেলা পরিষদে জমা দিতে বলেছি।’

তবে তাঁরা নিজেদের ব্যাপারে খুবই অসচেতন এবং অলস হওয়ায় প্রত্যাশামতো উন্নয়ন হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন উপজেলা চেয়ারম্যান। জানা গেছে, সাঁওতালরা জীবন-জীবিকার খোঁজে বৃটিশ আমলে পার্বত্যাঞ্চলে আসেন। কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত এসব সাঁওতাল পরিবার খাগড়াছড়ির পানছড়িতে আশ্রয় নেন ১৯৬০-১৯৬১ সালের দিকে। এখন প্রায় ১০০টি পরিবার পানছড়ির বড় সাঁওতালপাড়া, মঙ্গলকার্বারীপাড়া ও রামদাসকার্বারীপাড়ায় থাকে।

সাঁওতাল গ্রামের বাসিন্দারা জানান, পরীক্ষামূলকভাবে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হলে সাঁওতালদের বসতভিটা পানিতে ডুবে যায়। বাধ্য হয়ে পরের বছর আশ্রয়ের খোঁজে রাঙামাটি ছেড়ে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে ঠিকানা গড়ে তুলেন তাঁরা। মাঝে দীর্ঘসময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে তাঁরা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ পাননি।

সাঁওতালদের সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা দেনা মুরমু জানান, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর তাঁদের কিছুটা গুছিয়ে উঠার চেষ্টা যখন চলে তখনই স্বপ্নভঙ্গ! পানছড়ি উপজেলা পরিষদসহ সরকারি অবকাঠামো স্থাপনের জন্য দ্বিতীয়বার উচ্ছেদ হতে হয়েছে এসব সাঁওতাল পরিবারকে। ফলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন তাঁরা।

স্বাস্থ্যসচেতনতা না থাকায় নানা রোগব্যাধিতে ভুগছেন সাঁওতালরা। গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাস মিলন সাঁওতাল বলেন, ‘সাঁওতালরা সবদিক থেকেই পিছিয়ে। দারিদ্র্যতার কারণে লেখাপড়া করতে পারেন না। অন্যদিকে শিক্ষার অভাবে সচেতনতা বাড়ছে না। সাঁওতালদের স্বাভাবিক মৃত্যু খুবই কম। রোগশোকেই অধিকাংশ সাঁওতাল মারা যান।’

সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের পেনশনভোগী সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর অন্যতম মুরবি্ব বীর সাঁওতাল জানান, দিনমজুরি করে অনেক কষ্টে দিন কাটে সাঁওতালদের। বাচ্চাদের ভরণপোষণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় সবসময়।

সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বংশ পরম্পরায় সরকারের সড়ক ও জনপথ বিভাগে কাজ করে আসছিল। তবে শোভা সরেন বলেন, ‘আমার বাপদাদারা রোডে (সড়ক ও জনপথ বিভাগ) কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কিন্তু বিগত খালেদা জিয়া (বিএনপির আমল) সরকারের সময় থেকে সাঁওতালদের আর রোডে কাজ দেওয়া হয় না। ফলে পাহাড়ে কাঠ কেটে কোনো রকমে বেঁচে আছি আমরা।’

পানছড়ির অধিকাংশ সাঁওতাল অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন। যে পাহাড়ে ঠাঁই নিয়েছেন কোনোরকম বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজছেন, এরও নেই কোনো স্বীকৃতি। জমির কোনো রেকর্ডপত্র তাঁদের হাতে নেই। রাঙামাটিতে যাঁদের কাগজপত্র ছিল, তাঁরা কিছুটা সমতল (ঘোনা) জমি পেলেও সেখানকার ভূমিহীনরা এখনো থেকে গেছেন ভূমিহীন। অধিকাংশ সাঁওতাল বনে কাঠ সংগ্রহ করে তা বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

বড় সাঁওতালপাড়ার কার্বারী গুনু সরেন জানান, তাঁরা রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পানছড়িতে আসেন। সেখানে যাঁদের জমি ছিল তাঁরাই এখানে সমতল জমি পেয়েছে, বাকীরা পাননি। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘এখানে ঝাড়জঙ্গল আবাদ করছি, জায়গার মতো জায়গা করছি। বসবাস করছি। কিন্তু রেকর্ডপত্র পাইনি। রেকর্ডপত্র করতে যে টাকার প্রয়োজন, সে টাকাই বা জোগাড় হবে কী করে!’ বড় সাঁওতালপাড়ায় নিজেরাই ছোট্ট একটি মন্দির নির্মাণ করলেও বাকী দুটি সাঁওতালপাড়ায় কোনো মন্দির নেই। পর্যাপ্ত নলকূপ নেই। স্যানিটেশন সুবিধা সীমিত। বড় সাঁওতালপাড়া ও মঙ্গলকার্বারীপাড়ার মেঠোপথটি দিয়ে হাঁটাও কষ্টসাধ্য। পানছড়ি সদর উপজেলা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরের সাঁওতাল গ্রামটি দেখলে মনে হবে কোনো দূরগ্রাম। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। পার্বত্য জেলা পরিষদ সৃষ্টির পরও কোনো উন্নয়নকাজ হয়নি এই সাঁওতাল গ্রামে।

মঙ্গল কার্বারীপাড়ার সম মাদ্রি, বড় সাঁওতালপাড়ার গুনুই সাঁওতাল ও রামদাস কার্বারীপাড়ার রামদাস সরেন। এই তিনজন ওই তিন গ্রামের সর্দার। বড় সাঁওতালপাড়ার কার্বারী গুনু সরেন বলেন, ‘কষ্ট করে চলি কিন্তু কাউকে বিরক্ত করি না। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বার বা প্রশাসনের কাছে সাঁওতালরা বিচার-আচার নিয়ে যান না। শান্ত প্রকৃতির সাঁওতালদের নিয়ে বাড়তি চিন্তা করতে হয় না জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনকে।’

প্রথম এসএসসি পাস মিলন সাঁওতাল বলেন, ‘সরকারই তো নয়ই, পাহাড়ের অন্য মানুষও আমাদের আপন করে নিতে পারেননি। যে কারণে সাঁওতালরা খোলামেলাভাবে তাঁদের দাবি দাওয়া কিংবা নূ্যনতম অধিকারের বিষয়েও মুখ খুলেন না।’

একটি ভালো খবর, শিশুরা স্কুলে যায় : এতো সমস্যার মধ্যেও একটি ভালো খবর আছে। ইদানীং সাঁওতাল শিশুরা অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করেও স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছে। ‘দিনে আনে দিনে খায়’ এমন গরিব পরিবারের জন্য নিয়মিত স্কুলে পাঠানোও যে কতটা কঠিন, তা এলাকায় না গেলে বুঝা যাবে না। তারপরও শিশুদের স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস আশাবাদী করে তুলছে অনেককে। প্রতিদিন দুবেলা দুমুঠো ভাতের সংস্থান করতে যাঁদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে সেখানকার সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর শিক্ষাদীক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং সংস্কৃতি সচেতনতা সত্যিই একটি ইতিবাচক দিক। ১০ বছর আগে যেখানে একজন মিলন সাঁওতালই ছিলেন প্রথম এসএসসি পাস; সেখানে বর্তমানে চারজন সাঁওতাল ছেলে-মেয়ে এসএসসি পাস করেছে।

লক্ষী হেমরম নামে একজন সাঁওতাল মেয়ে পানছড়ি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু এখনো ভর্তির পুরো টাকা দিতে পারেননি। জানা গেছে, এখানকার আরো একজন ডিগ্রিতে পড়ছেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

পানছড়ির সাঁওতালরা ভালো নেই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা

আপডেট টাইম : ০৩:১০:৪৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ মে ২০১৫

পানছড়ির সাঁওতালরা ভালো নেই। তাঁদের নেই বলতে কিছুই নেই। দিন কাটে কষ্টে। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। গ্রামে বাসা বেঁধেছে নানা সমস্যা। কোনো উন্নয়নকাজ হয়নি কোনো সরকারের আমলেই। তাঁদের কষ্ট শোনা বা সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যাঁদের ওপর বর্তায় তাঁরা কেউ খোঁজ নেন না।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অসেতু বিকাশ চাকমা জানান, বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের পৃথক বরাদ্দ থাকে না। তবু পরিষদ থেকে সাধ্যমতো সাঁওতালদের জন্য সহায়তার হাত বাড়ানো হয়।

পানছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা সাঁওতালদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে নিজেরা সংগঠিত না হওয়া এবং দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘আমি কয়েকবার সাঁওতালগ্রাম পরিদর্শন করে অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত হই। তাঁদেরকে আরো উদ্যোগী, উদ্যেমী ও কর্মঠ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে উপজেলা পরিষদে জমা দিতে বলেছি।’

তবে তাঁরা নিজেদের ব্যাপারে খুবই অসচেতন এবং অলস হওয়ায় প্রত্যাশামতো উন্নয়ন হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন উপজেলা চেয়ারম্যান। জানা গেছে, সাঁওতালরা জীবন-জীবিকার খোঁজে বৃটিশ আমলে পার্বত্যাঞ্চলে আসেন। কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত এসব সাঁওতাল পরিবার খাগড়াছড়ির পানছড়িতে আশ্রয় নেন ১৯৬০-১৯৬১ সালের দিকে। এখন প্রায় ১০০টি পরিবার পানছড়ির বড় সাঁওতালপাড়া, মঙ্গলকার্বারীপাড়া ও রামদাসকার্বারীপাড়ায় থাকে।

সাঁওতাল গ্রামের বাসিন্দারা জানান, পরীক্ষামূলকভাবে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হলে সাঁওতালদের বসতভিটা পানিতে ডুবে যায়। বাধ্য হয়ে পরের বছর আশ্রয়ের খোঁজে রাঙামাটি ছেড়ে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে ঠিকানা গড়ে তুলেন তাঁরা। মাঝে দীর্ঘসময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে তাঁরা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ পাননি।

সাঁওতালদের সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা দেনা মুরমু জানান, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর তাঁদের কিছুটা গুছিয়ে উঠার চেষ্টা যখন চলে তখনই স্বপ্নভঙ্গ! পানছড়ি উপজেলা পরিষদসহ সরকারি অবকাঠামো স্থাপনের জন্য দ্বিতীয়বার উচ্ছেদ হতে হয়েছে এসব সাঁওতাল পরিবারকে। ফলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন তাঁরা।

স্বাস্থ্যসচেতনতা না থাকায় নানা রোগব্যাধিতে ভুগছেন সাঁওতালরা। গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাস মিলন সাঁওতাল বলেন, ‘সাঁওতালরা সবদিক থেকেই পিছিয়ে। দারিদ্র্যতার কারণে লেখাপড়া করতে পারেন না। অন্যদিকে শিক্ষার অভাবে সচেতনতা বাড়ছে না। সাঁওতালদের স্বাভাবিক মৃত্যু খুবই কম। রোগশোকেই অধিকাংশ সাঁওতাল মারা যান।’

সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের পেনশনভোগী সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর অন্যতম মুরবি্ব বীর সাঁওতাল জানান, দিনমজুরি করে অনেক কষ্টে দিন কাটে সাঁওতালদের। বাচ্চাদের ভরণপোষণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় সবসময়।

সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বংশ পরম্পরায় সরকারের সড়ক ও জনপথ বিভাগে কাজ করে আসছিল। তবে শোভা সরেন বলেন, ‘আমার বাপদাদারা রোডে (সড়ক ও জনপথ বিভাগ) কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কিন্তু বিগত খালেদা জিয়া (বিএনপির আমল) সরকারের সময় থেকে সাঁওতালদের আর রোডে কাজ দেওয়া হয় না। ফলে পাহাড়ে কাঠ কেটে কোনো রকমে বেঁচে আছি আমরা।’

পানছড়ির অধিকাংশ সাঁওতাল অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন। যে পাহাড়ে ঠাঁই নিয়েছেন কোনোরকম বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজছেন, এরও নেই কোনো স্বীকৃতি। জমির কোনো রেকর্ডপত্র তাঁদের হাতে নেই। রাঙামাটিতে যাঁদের কাগজপত্র ছিল, তাঁরা কিছুটা সমতল (ঘোনা) জমি পেলেও সেখানকার ভূমিহীনরা এখনো থেকে গেছেন ভূমিহীন। অধিকাংশ সাঁওতাল বনে কাঠ সংগ্রহ করে তা বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

বড় সাঁওতালপাড়ার কার্বারী গুনু সরেন জানান, তাঁরা রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পানছড়িতে আসেন। সেখানে যাঁদের জমি ছিল তাঁরাই এখানে সমতল জমি পেয়েছে, বাকীরা পাননি। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘এখানে ঝাড়জঙ্গল আবাদ করছি, জায়গার মতো জায়গা করছি। বসবাস করছি। কিন্তু রেকর্ডপত্র পাইনি। রেকর্ডপত্র করতে যে টাকার প্রয়োজন, সে টাকাই বা জোগাড় হবে কী করে!’ বড় সাঁওতালপাড়ায় নিজেরাই ছোট্ট একটি মন্দির নির্মাণ করলেও বাকী দুটি সাঁওতালপাড়ায় কোনো মন্দির নেই। পর্যাপ্ত নলকূপ নেই। স্যানিটেশন সুবিধা সীমিত। বড় সাঁওতালপাড়া ও মঙ্গলকার্বারীপাড়ার মেঠোপথটি দিয়ে হাঁটাও কষ্টসাধ্য। পানছড়ি সদর উপজেলা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরের সাঁওতাল গ্রামটি দেখলে মনে হবে কোনো দূরগ্রাম। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। পার্বত্য জেলা পরিষদ সৃষ্টির পরও কোনো উন্নয়নকাজ হয়নি এই সাঁওতাল গ্রামে।

মঙ্গল কার্বারীপাড়ার সম মাদ্রি, বড় সাঁওতালপাড়ার গুনুই সাঁওতাল ও রামদাস কার্বারীপাড়ার রামদাস সরেন। এই তিনজন ওই তিন গ্রামের সর্দার। বড় সাঁওতালপাড়ার কার্বারী গুনু সরেন বলেন, ‘কষ্ট করে চলি কিন্তু কাউকে বিরক্ত করি না। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বার বা প্রশাসনের কাছে সাঁওতালরা বিচার-আচার নিয়ে যান না। শান্ত প্রকৃতির সাঁওতালদের নিয়ে বাড়তি চিন্তা করতে হয় না জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনকে।’

প্রথম এসএসসি পাস মিলন সাঁওতাল বলেন, ‘সরকারই তো নয়ই, পাহাড়ের অন্য মানুষও আমাদের আপন করে নিতে পারেননি। যে কারণে সাঁওতালরা খোলামেলাভাবে তাঁদের দাবি দাওয়া কিংবা নূ্যনতম অধিকারের বিষয়েও মুখ খুলেন না।’

একটি ভালো খবর, শিশুরা স্কুলে যায় : এতো সমস্যার মধ্যেও একটি ভালো খবর আছে। ইদানীং সাঁওতাল শিশুরা অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করেও স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছে। ‘দিনে আনে দিনে খায়’ এমন গরিব পরিবারের জন্য নিয়মিত স্কুলে পাঠানোও যে কতটা কঠিন, তা এলাকায় না গেলে বুঝা যাবে না। তারপরও শিশুদের স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস আশাবাদী করে তুলছে অনেককে। প্রতিদিন দুবেলা দুমুঠো ভাতের সংস্থান করতে যাঁদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে সেখানকার সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর শিক্ষাদীক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং সংস্কৃতি সচেতনতা সত্যিই একটি ইতিবাচক দিক। ১০ বছর আগে যেখানে একজন মিলন সাঁওতালই ছিলেন প্রথম এসএসসি পাস; সেখানে বর্তমানে চারজন সাঁওতাল ছেলে-মেয়ে এসএসসি পাস করেছে।

লক্ষী হেমরম নামে একজন সাঁওতাল মেয়ে পানছড়ি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু এখনো ভর্তির পুরো টাকা দিতে পারেননি। জানা গেছে, এখানকার আরো একজন ডিগ্রিতে পড়ছেন।