তিন জেলায় হাজারো পরিবার পানিবন্দি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ উজান থেকে নেমে আসা পানি ও ভারী বর্ষণের ফলে নীলফামারী, কুড়িগ্রাম এবং সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এসব জেলার হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে চলা প্রায় সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। সম্ভাব্য এই বন্যা মোকাবিলায় প্রশাসনের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রয়েছে। বিপদসীমার ওপরে তিস্তার পানি, ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে তিস্তা নদীর পানি গতকাল বিকাল ৩টায় বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

গত দুদিনের চেয়ে ২০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিস্তা পাড়ের বাসিন্দারা দাবি করেছেন। তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে এবং পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে বলেও তারা জানান। এতে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার তিস্তা অববাহিকার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী, গয়াবাড়ি ও জলঢাকা উপজেলার গোলমুণ্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকার ২৫টি চর ও গ্রামের পরিবারগুলো বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে ডালিয়াস্থ তিস্তা অববাহিকায় ভারী বর্ষণ চলছে।

গতকাল দুপুর ১২টার পর এ ধরনের খবর পাওয়া গেলেও তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, গত বুধবারের চেয়ে তিস্তার পানি দুই সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে সকাল ৬টা হতে দুপুর ১২ পর্যন্ত বিপদসীমার দুই সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিকাল ৩টায় পয়েন্টে বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই হিসাব মানতে নারাজ। তাদের দাবি, তিস্তা নদীর পানি কম করে হলেও বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড অজ্ঞাত কারণে নদীর পানির সঠিক হিসাব প্রকাশ করছে না। এদিকে তিস্তা ব্যারাজ কন্ট্রোল রুমের পানি প্রবাহের খাতায় গতকাল বেলা ১১টা পর্যন্ত হিসাব লেখা পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, ব্যারাজের উজানে ও ভাটিতে পানি প্রবাহ চলছে ৫৩ মিটার। যা ব্যারাজ পয়েন্টে বিপদসীমার (৫২ দশমিক ৬০ মিটার) ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে, গত দুদিনের চেয়ে নদীর গর্জন অনেকাংশে বেড়ে গেছে। নদীর ঢেউ দুর্বার গতিতে ভাটির দিকে ধাবিত হচ্ছে। ডিমলা উপজেলার পূবর্ ছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রভাষক আব্দুল লতিফ খান জানান, গত দুদিনের চেয়ে উজানের ঢলের গতি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

ফলে এলাকার নিচু ও উঁচু স্থানে নদীর পানি প্রবেশ করেছে। চরের গ্রামগুলোর ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। ইতোমধ্যে তার এলাকার ১ হাজার ৪০ পরিবারের বসতবাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। ঝাড়সিংহেশ্বর মৌজার ৬টি পরিবারের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার কারণে পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, উজানের ঢলের কারণে তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে ৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী তিস্তার পানি মাপা হচ্ছে।

নদীর পানি সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছিল।সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি : বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আট উপজেলার দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ওই এলাকার ঘরবাড়িতেও পানি উঠে গেছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন বেশির ভাগ মানুষ। দোয়ারাবাজার ও ছাতক উপজেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ দুই উপজেলার আমন বীজতলা এবং পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের সবকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ছাতক-সিলেট সড়কে পানি উঠে যাওয়ায় যান চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে।কুড়িগ্রামে বন্যায় শতাধিক পরিবার পানিবন্দি : অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রসহ কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে চলা সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গত দুদিনে অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে জেলার সদর উপজেলার ধরলা অববাহিকা ও রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এসব এলাকার অন্তত ৬টি গ্রামের শাতাধিক পরিবার।

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলা নদীর পানি ফেরিঘাট (সেতু পয়েন্ট) পয়েন্টে ৩৫ সেন্টিমিটার এবং তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ২৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা সদরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ধরলা নদীর পানি বাড়ার ফলে সদর উপজেলার হলোখানা ও পাঁচগাছি ইউনিয়নের ধরলা অবাহিকার বেশকিছু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বলে জানা গেছে। হলোখানা ইউনিয়নের বাসিন্দা রাহুল আহমেদ জানান, ধরলা নদীর পানি বাড়ার ফলে নদী তীরের বেশকিছু বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে নদী ভাঙন।

হলোখানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক জানান, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সারডোব গ্রামের একটি বাঁধ ভেঙে কয়েকটি বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে।বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সফিকুল ইসলাম জানান, সারডোপ গ্রামের একটি বাঁধ ওয়াশ আউট হয়েছে, তবে সেটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নয়। ওই বাঁধটি স্থানীয়রা নির্মাণ করেছিল। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেশকিছু বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে এই নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, চিলমারী, উলিপুর ও নাগেশ্বরীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ঢাল দেবে গেছে।

আমরা সেগুলো মেরামতের চেষ্টা করছি। সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন জানান, ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তার ইউনিয়নের গোবিন্দপুর, কদমতলা ও দক্ষিণ নওয়াবশ গ্রামের বেশকিছু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি বন্দি হওয়ার বিষয়টি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান এই চেয়ারম্যান। রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদুল হক প্রধান জানান, তিস্তা অববাহিকার বেশকিছু এলাকায় পানি বৃদ্ধির খবর পেয়েছি। আমরা দ্রুত তাদের সহায়তা করার ব্যবস্থা করছি। এছাড়া জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন জানিয়েছেন, সম্ভাব্য বন্যা মোকাবিলায় যে কোনো ধরনের সহায়তার জন্য প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর