Exif_JPEG_420

শিক্ষায় বাণিজ্যিক প্রবণতা রোধ করতে হবে অধ্যক্ষ আসাদুল হক

যেকোনো প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার পূর্বশর্ত হলো যথাযথ আইনকানুন ও সেগুলোর প্রয়োগ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০’ নামে একটি আইন রয়েছে। সাধারণত যেকোনো আইন অমান্য হলে দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অমান্য হলে কি শাস্তির ব্যবস্থা আছে? প্রকৃত অর্থে ওই আইন যথাযথভাবে অনুসরণ ও তা তদারকির যথাযথ ব্যবস্থা রয়েছে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০’-এ স্পষ্ট বলা আছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে অলাভজনক ও সেবামূলক। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এসব প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ অলাভজনকভাবে চলছে কি না এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর এ সন্দেহের পেছনেও যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে।

সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে সারা দেশে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রতিবাদের মুখে ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পরে ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোর ওপর আরোপিত ৭.৫ শতাংশ ভ্যাটও স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। শিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপ ইস্যুটি অনেকটাই স্পর্শকাতর বিষয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার কেন ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ আমরা জানি, প্রতিবছরই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও এ ধরনের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইচ্ছামতো বাড়ানো হয় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি। টিউশন ফি বৃদ্ধি কিংবা কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যথাযথভাবে কার্যকর আছে কি না তা বাস্তবে দৃশ্যমান হয় না।

গণমাধ্যমে জানতে পারি, দেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কালো তালিকায়। তবু কেন ওসব কালো তালিকাভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিপূর্ণভাবে বন্ধের নজির পাওয়া যায় না? বরং অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সনদ বাণিজ্যের অভিযোগ থাকলেও সেগুলো বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য টিউশন ফি নিয়ে কোনো অভিন্ন বা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। ফলে ইচ্ছামতো টিউশন ফি গুনতে হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করতে তিন থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো অলাভজনক এবং ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে চলার বিধান থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, একই পরিবারের সদস্যরা ট্রাস্টি বোর্ডের সব পদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রশাসনিক পদে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে অযোগ্য শিক্ষককে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ তদারকি হয় না বললেই চলে। ফলে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি অর্থেই লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। এতে স্বাভাবিকভাবেই ভ্যাটের প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছিল।

বাংলাদেশে ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকায়ই রয়েছে ৫০টি। সারা দেশে এখনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শতাধিক অবৈধ ক্যাম্পাস রয়েছে। কিন্তু ইউজিসি সম্প্রতি ৪৮টি ক্যাম্পাসের ওপর সতর্কতা জারি করেছে (১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫, কালের কণ্ঠ)। গত ২৩ জুন শিক্ষাসচিব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভিক্টোরিয়া ও অতীশ দীপঙ্করের দুটি ক্যাম্পাস পরিদর্শনে গিয়ে কোনো নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না বলে ক্ষুব্ধ হন। ইউজিসির কালো তালিকায় থাকা ক্যাম্পাসগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের আইনগত ক্ষমতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে। কিন্তু অবৈধ ঘোষণা করা ক্যাম্পাস বন্ধ না করে পুনরায় তার শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষাসচিবের দেখতে যাওয়ার বিষয়টিও প্রশ্নসাপেক্ষ।

শুধু এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসই নয়, এ রকম অনেক ক্যাম্পাস কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেগুলো ইউজিসি কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত থাকলেও এখনো তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। স্বাভাবিকভাবেই আশঙ্কা করা যায়, দ্রুত এসব ক্যাম্পাস বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ না নিলে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ক্রমেই বাড়বে ও শিক্ষার মান ক্রমেই হ্রাস পাবে।

এর আগে টিআইবি পরিচালিত ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ গবেষণা প্রতিবেদনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অনিয়মের তথ্য প্রকাশ পায়। ওই প্রতিবেদনে শিক্ষার বেহাল ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের অগ্রাধিকারের চিত্র ফুঠে ওঠে। সম্প্রতি আরো ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে লবিং-তদবির অব্যাহত রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায় (২৮ জুন ২০১৫, সম্পাদকীয়, কালের কণ্ঠ)। উদ্যোক্তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজনৈতিক দল বা অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী ও কিছু এনজিও কর্তা। আগেও মূলত তাঁরাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমোদন পেয়েছেন। এভাবে শত শত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিলেই কি বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষায় দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে, নাকি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা বিশ্বপরিসরে কেবল নিন্দিত ও স্বীকৃতিহীনই হতে থাকবে?

গত ২৯ নভেম্বর ২০১৪ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ‘নামসর্বস্ব গ্র্যাজুয়েট তৈরির কারখানা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে সরাসরি সনদ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ১৫ প্রতিষ্ঠান, উপাচার্য ছাড়াই চলছে ২৩ বিশ্ববিদ্যালয়, সারা দেশে অবৈধ ক্যাম্পাস প্রায় ২০০টি প্রভৃতি তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইউজিসির সীমাবদ্ধতা’, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈধ ভিসি নেই’ প্রভৃতি শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয় কিংবা প্রতিবেদন দেখে রীতিমতো হতবাক হতে হয় শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সাধারণ মানুষকে। ইউজিসির মনিটরিং ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও সনদ বাণিজ্যসহ আইনানুগ নয় এমন কাজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে এমন ধারণাই পাওয়া যায় যে নতুন-পুরনো অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

সম্প্রতি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই শাখা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখলেও গোপনে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০’-এর শর্ত পূরণ না করেই চলছে। বিদ্যমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যথাযথ তদারকির ব্যবস্থা করে সেখানে মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী ভর্তি, টিউশন ফি- প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে কার্যকর নীতিমালা আবশ্যক। আমরা আশা করি, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাববে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর