ঢাকা ০৪:৩৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যৌতুকের বহুমাত্রিক কুফল

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:১০:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ জুন ২০১৮
  • ৩৩৯ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ যৌতুক মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের ওপর চরম আঘাত হানে। কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা চাকরিজীবী হলে ঘুষ ও অন্যান্য দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ী হলে চোরাকারবারি, মজুতদারিসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। শ্রমজীবী হলে আগাম শ্রম বিক্রি করে শ্রমের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। কৃষিজীবী হলে কৃষিজমি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। যৌতুক নারীশিক্ষা হ্রাস করে। বাবা মেয়ের শিক্ষার পেছনে অর্থ ব্যয় না করে যৌতুকের অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে নারীশিক্ষার হার কমে যায়, নারীরা অশিক্ষিত থেকে যায়। অশিক্ষিত মায়ের সন্তানও অশিক্ষিত হয়। পরিবার ও সমাজে অশিক্ষা এবং মেধাশূন্যতা দেখা দেয়। অশিক্ষিত মা ও শিশুদের পুষ্টিহীনতাজনিত রোগব্যাধি বৃদ্ধি পায়

বিয়ে মানুষের নীতি ও নৈতিকতা বৃদ্ধি করে। এর মাধ্যমে সন্তান জন্মলাভ করে। ভবিষ্যৎ বংশধারা সুরক্ষা পায়। যদি এর সূচনা হয় লোভ, অশুচি ও অনৈতিকতার মাধ্যমে, অন্যায় উপার্জনের মধ্যমে, বিয়ের কোনো এক পক্ষ, বিশেষ করে কনেপক্ষকে বরপক্ষ দ্বারা শোষণের মাধ্যমে, তা হলে এই ধরনের বিয়ের মধ্যে পবিত্রতা, পারস্পরিক বিশ্বাস, সহানুভূতি ও ভালোবাসা থাকে না। পবিত্রতা, পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসাহীন বিয়ের মাধ্যমে মিলন আর ব্যভিচারের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। বিয়ে ও বিয়েবহির্ভূত মিলনের মধ্যে তফাত শুধু সামাজিক বন্ধন, পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততার। বিয়ের মাধ্যমে মিলনে পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততা থাকে। আর বিয়েবহির্ভূত মিলনে তা থাকে না।

এজন্যই ইসলাম বিয়েবহির্ভূত মিলন হারাম করেছে। যৌতুকের বিয়েতে পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততা থাকে না। সুতরাং ব্যভিচার যদি নিষিদ্ধ হয়, হারাম হয়, অশুচি হয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়, সমাজে ঘৃণিত হয়, তাহলে যৌতুক কেন অশুচি হবে না, হারাম হবে না, সামাজিকভাবে ঘৃণিত হবে না? ব্যভিচারের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ যদি অপবিত্র হয়, ভালো কাজে ব্যয় করা নিষিদ্ধ হয়, তাহলে যৌতুকের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ কেন অপবিত্র হবে না, ভালো কাজে নিষিদ্ধ হবে না? মেশকাতুল মাসাবিহের একটি হাদিসের মর্মানুযায়ী, ‘ফেরত না দেওয়ার নিয়তে কোনো অর্থ প্রাপ্তির লোভে যে ব্যক্তি কোনো নারীকে বিয়ে করে সে একজন ব্যভিচারী।’ যৌতুকলোভীর জন্য এর চেয়ে আর খারাপ কী উদাহরণ হতে পারে?

মানববংশ রক্ষায় স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই সমান অবদান। বরং সন্তান লালনপালনে মায়ের অবদান বেশি। সন্তান জন্মের ক্ষেত্র তৈরি হয় বিয়ে নামক একটি পূতপবিত্র বন্ধনের মাধ্যমে। আর এ বন্ধনেরই যদি গোড়াপত্তন হয় একটি অন্যায্য-অমানবিক শর্তারোপের মধ্য দিয়ে, তাহলে এ বন্ধন থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানসন্ততির ওপর যে এর খারাপ প্রভাব পড়বে, তা অস্বীকার্য। সামান্য অর্থের লোভে পড়ে যৌতুকলোভীরা আল্লাহ তায়ালার দেওয়া একটি বিধানের কত ক্ষতি করেছে। বিয়ে কোনো সওদা বা বাণিজ্য নয়, আর্থিক লাভ-ক্ষতির বিষয় নয়, এটি একটি পবিত্র বন্ধন। এ দ্বারা এক জোড়া মানব-মানবীর পরস্পরের অধিকার ও কর্তব্য স্থাপিত হয়। একজন আরেকজনের জন্য হালাল হয়। এটি কোনো আর্থিক বা বৈষয়িক জিনিস নয়। বেহেশতি নেয়ামত। এই বন্ধন অনুষ্ঠিত হয় বেহেশতে প্রথম মানব-মানবী আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) এর মাধ্যমে। আর এ বন্ধন ঘটিয়েছেন স্বয়ং রাব্বুল আলামিন।

যৌতুক চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের চেয়েও খারাপ। চোর, ডাকাত ও ছিনতাইকারী যেমন অন্যের মাল জোর করে ছিনিয়ে নেয়, যৌতুক গ্রহণকারীও তাই করে। স্বেচ্ছায় কেউ যৌতুক দেয় না। দায়ে পড়েই যৌতুক দেয়। সুতরাং চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো যৌতুক গ্রহণও হারাম। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে না।’                          (সূরা বাকারা : ১৮৮)।

জন্মগতভাবে শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে পুরুষ নারী অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। তাদের যেমন উৎপাদনক্ষমতা বেশি, তেমনি নিজের ও স্ত্রীর নিরাপত্তা বিধানের ক্ষমতাও বেশি। তাই ইসলাম নারী অর্থাৎ স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পুরুষ তথা স্বামীর ওপর অর্পণ করেছে। আর এই কারণে মিরাস তথা উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রেও মেয়ের তুলনায় ছেলের ভাগ দ্বিগুণ করা হয়েছে। এই একই কারণে স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণের আর্থিক সামর্থ্য অর্জন না করা পর্যন্ত বিয়ে বিলম্বিত করতে ইসলাম পুরুষকে পরামর্শ দিয়েছে। এরূপ বলা হয়নি যে, আর্থিক সংগতি না থাকলে স্ত্রী বা স্ত্রীর অভিভাবক থেকে অর্থ নিয়ে বিয়ে করতে হবে। শারীরিক শক্তি অধিক উপার্জনক্ষমতার কারণে যেখানে আল্লাহ নারীর ওপর পুরুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, সেখানে বিয়ের সময় নারীর কাছ থেকে পুরুষের যৌতুক নামক অর্থ আদায় আল্লাহ প্রদত্ত পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বেরই অবমাননা। কোরআনের বাণী ‘পুরুষ স্ত্রীলোকের ওপর নেতৃত্ব পেয়েছে এজন্য যে, পুরুষরাই পারে নারীকে বাইরের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা করতে।’ (সূরা নিসা : ৩৪)।

এই আক্রমণ শারীরিক হোক, নৈতিক হোক কিংবা আর্থিক। আর্থিক অসহায়ত্ব থেকে নারীকে রক্ষার জন্য যেখানে পুরুষকে নারীর নেতা বানানো হয়েছে, সেখানে পুরুষ কর্তৃক নারীর কাছ থেকে বিয়ের সময় যৌতুক আদায় পুরুষের জন্য সত্যি অবমাননাকর ও লজ্জাজনক কাজ। শারীরিকভাবে দুর্বল নারীর কাছ থেকে শারীরিকভাবে সবল পুরুষের কোনো সুবিধা আদায় পুরুষের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার পরিপন্থি। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের অস্বীকার কুফরির শামিল। এই ব্যাপারে মহান রাব্বুল আলামিনের ঘোষণা হচ্ছে ‘তোমরা যদি আমার দেওয়া নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করো, তাহলে তা আমি বাড়িয়ে দেব। আর যদি অস্বীকার করো, অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে জেনে রেখো আমার শাস্তি খুবই কঠিন।’ (সূরা ইবরাহিম : ৭)। সুতরাং যৌতুকলোভী পুরুষকে আখেরাতে আল্লাহর আজাব এবং দুনিয়ায় অপমানিত ও লাঞ্ছিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আখেরাতে আল্লাহর শাস্তি এবং দুনিয়ায় সামাজিকভাবে অপমানিত হওয়া থেকে বাঁচতে হলে যৌতুকের লোভ পরিত্যাগ করতে হবে।

তাছাড়া যৌতুক মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের ওপর চরম আঘাত হানে। কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা চাকরিজীবী হলে ঘুষ ও অন্যান্য দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ী হলে চোরাকারবারি, মজুতদারিসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। শ্রমজীবী হলে আগাম শ্রম বিক্রি করে শ্রমের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। কৃষিজীবী হলে কৃষিজমি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। যৌতুক নারীশিক্ষা হ্রাস করে। বাবা মেয়ের শিক্ষার পেছনে অর্থ ব্যয় না করে যৌতুকের অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে নারীশিক্ষার হার কমে যায়, নারীরা অশিক্ষিত থেকে যায়। অশিক্ষিত মায়ের সন্তানও অশিক্ষিত হয়। পরিবার ও সমাজে অশিক্ষা এবং মেধাশূন্যতা দেখা দেয়। অশিক্ষিত মা ও শিশুদের পুষ্টিহীনতাজনিত রোগব্যাধি বৃদ্ধি পায়।

আইন করে এই বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটন সম্ভব কি না, তা বলতে না পারলেও এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের আলেমসমাজ যদি এর মূলোৎপাটনে সর্বান্তকরণে এগিয়ে আসেন, তাহলেই সম্ভব হবে জাহেলিয়াতের এই অভিশাপ থেকে নারীদের রক্ষা করা। এ দেশের আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখরা অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন, এখনও করে যাচ্ছেন। যৌতুকের মাধ্যমে জাহেলিয়াতের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তা প্রতিরোধে তারা যথাযথভাবে এগিয়ে আসবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা। জন্ম, বিয়ে ও মৃত্যুতে তাদের উপস্থিতি অনিবার্য ও সমাজ সংগঠনের অবদান অনস্বীকার্য। বিয়ের সময় যদি তারা তাদের এই ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্বটুকু হেকমতের সঙ্গে পালন করেন, তাহলে নারী নির্যাতন ও নারী অধিকার হরণকারী বিয়ের যৌতুকের অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতি মুক্তি পাবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক : শিক্ষক, বাইতুন নূর মাদ্রাসা ঢাকা

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

যৌতুকের বহুমাত্রিক কুফল

আপডেট টাইম : ০৩:১০:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ জুন ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ যৌতুক মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের ওপর চরম আঘাত হানে। কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা চাকরিজীবী হলে ঘুষ ও অন্যান্য দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ী হলে চোরাকারবারি, মজুতদারিসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। শ্রমজীবী হলে আগাম শ্রম বিক্রি করে শ্রমের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। কৃষিজীবী হলে কৃষিজমি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। যৌতুক নারীশিক্ষা হ্রাস করে। বাবা মেয়ের শিক্ষার পেছনে অর্থ ব্যয় না করে যৌতুকের অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে নারীশিক্ষার হার কমে যায়, নারীরা অশিক্ষিত থেকে যায়। অশিক্ষিত মায়ের সন্তানও অশিক্ষিত হয়। পরিবার ও সমাজে অশিক্ষা এবং মেধাশূন্যতা দেখা দেয়। অশিক্ষিত মা ও শিশুদের পুষ্টিহীনতাজনিত রোগব্যাধি বৃদ্ধি পায়

বিয়ে মানুষের নীতি ও নৈতিকতা বৃদ্ধি করে। এর মাধ্যমে সন্তান জন্মলাভ করে। ভবিষ্যৎ বংশধারা সুরক্ষা পায়। যদি এর সূচনা হয় লোভ, অশুচি ও অনৈতিকতার মাধ্যমে, অন্যায় উপার্জনের মধ্যমে, বিয়ের কোনো এক পক্ষ, বিশেষ করে কনেপক্ষকে বরপক্ষ দ্বারা শোষণের মাধ্যমে, তা হলে এই ধরনের বিয়ের মধ্যে পবিত্রতা, পারস্পরিক বিশ্বাস, সহানুভূতি ও ভালোবাসা থাকে না। পবিত্রতা, পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসাহীন বিয়ের মাধ্যমে মিলন আর ব্যভিচারের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। বিয়ে ও বিয়েবহির্ভূত মিলনের মধ্যে তফাত শুধু সামাজিক বন্ধন, পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততার। বিয়ের মাধ্যমে মিলনে পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততা থাকে। আর বিয়েবহির্ভূত মিলনে তা থাকে না।

এজন্যই ইসলাম বিয়েবহির্ভূত মিলন হারাম করেছে। যৌতুকের বিয়েতে পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততা থাকে না। সুতরাং ব্যভিচার যদি নিষিদ্ধ হয়, হারাম হয়, অশুচি হয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়, সমাজে ঘৃণিত হয়, তাহলে যৌতুক কেন অশুচি হবে না, হারাম হবে না, সামাজিকভাবে ঘৃণিত হবে না? ব্যভিচারের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ যদি অপবিত্র হয়, ভালো কাজে ব্যয় করা নিষিদ্ধ হয়, তাহলে যৌতুকের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ কেন অপবিত্র হবে না, ভালো কাজে নিষিদ্ধ হবে না? মেশকাতুল মাসাবিহের একটি হাদিসের মর্মানুযায়ী, ‘ফেরত না দেওয়ার নিয়তে কোনো অর্থ প্রাপ্তির লোভে যে ব্যক্তি কোনো নারীকে বিয়ে করে সে একজন ব্যভিচারী।’ যৌতুকলোভীর জন্য এর চেয়ে আর খারাপ কী উদাহরণ হতে পারে?

মানববংশ রক্ষায় স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই সমান অবদান। বরং সন্তান লালনপালনে মায়ের অবদান বেশি। সন্তান জন্মের ক্ষেত্র তৈরি হয় বিয়ে নামক একটি পূতপবিত্র বন্ধনের মাধ্যমে। আর এ বন্ধনেরই যদি গোড়াপত্তন হয় একটি অন্যায্য-অমানবিক শর্তারোপের মধ্য দিয়ে, তাহলে এ বন্ধন থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানসন্ততির ওপর যে এর খারাপ প্রভাব পড়বে, তা অস্বীকার্য। সামান্য অর্থের লোভে পড়ে যৌতুকলোভীরা আল্লাহ তায়ালার দেওয়া একটি বিধানের কত ক্ষতি করেছে। বিয়ে কোনো সওদা বা বাণিজ্য নয়, আর্থিক লাভ-ক্ষতির বিষয় নয়, এটি একটি পবিত্র বন্ধন। এ দ্বারা এক জোড়া মানব-মানবীর পরস্পরের অধিকার ও কর্তব্য স্থাপিত হয়। একজন আরেকজনের জন্য হালাল হয়। এটি কোনো আর্থিক বা বৈষয়িক জিনিস নয়। বেহেশতি নেয়ামত। এই বন্ধন অনুষ্ঠিত হয় বেহেশতে প্রথম মানব-মানবী আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) এর মাধ্যমে। আর এ বন্ধন ঘটিয়েছেন স্বয়ং রাব্বুল আলামিন।

যৌতুক চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের চেয়েও খারাপ। চোর, ডাকাত ও ছিনতাইকারী যেমন অন্যের মাল জোর করে ছিনিয়ে নেয়, যৌতুক গ্রহণকারীও তাই করে। স্বেচ্ছায় কেউ যৌতুক দেয় না। দায়ে পড়েই যৌতুক দেয়। সুতরাং চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো যৌতুক গ্রহণও হারাম। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে না।’                          (সূরা বাকারা : ১৮৮)।

জন্মগতভাবে শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে পুরুষ নারী অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। তাদের যেমন উৎপাদনক্ষমতা বেশি, তেমনি নিজের ও স্ত্রীর নিরাপত্তা বিধানের ক্ষমতাও বেশি। তাই ইসলাম নারী অর্থাৎ স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পুরুষ তথা স্বামীর ওপর অর্পণ করেছে। আর এই কারণে মিরাস তথা উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রেও মেয়ের তুলনায় ছেলের ভাগ দ্বিগুণ করা হয়েছে। এই একই কারণে স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণের আর্থিক সামর্থ্য অর্জন না করা পর্যন্ত বিয়ে বিলম্বিত করতে ইসলাম পুরুষকে পরামর্শ দিয়েছে। এরূপ বলা হয়নি যে, আর্থিক সংগতি না থাকলে স্ত্রী বা স্ত্রীর অভিভাবক থেকে অর্থ নিয়ে বিয়ে করতে হবে। শারীরিক শক্তি অধিক উপার্জনক্ষমতার কারণে যেখানে আল্লাহ নারীর ওপর পুরুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, সেখানে বিয়ের সময় নারীর কাছ থেকে পুরুষের যৌতুক নামক অর্থ আদায় আল্লাহ প্রদত্ত পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বেরই অবমাননা। কোরআনের বাণী ‘পুরুষ স্ত্রীলোকের ওপর নেতৃত্ব পেয়েছে এজন্য যে, পুরুষরাই পারে নারীকে বাইরের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা করতে।’ (সূরা নিসা : ৩৪)।

এই আক্রমণ শারীরিক হোক, নৈতিক হোক কিংবা আর্থিক। আর্থিক অসহায়ত্ব থেকে নারীকে রক্ষার জন্য যেখানে পুরুষকে নারীর নেতা বানানো হয়েছে, সেখানে পুরুষ কর্তৃক নারীর কাছ থেকে বিয়ের সময় যৌতুক আদায় পুরুষের জন্য সত্যি অবমাননাকর ও লজ্জাজনক কাজ। শারীরিকভাবে দুর্বল নারীর কাছ থেকে শারীরিকভাবে সবল পুরুষের কোনো সুবিধা আদায় পুরুষের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার পরিপন্থি। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের অস্বীকার কুফরির শামিল। এই ব্যাপারে মহান রাব্বুল আলামিনের ঘোষণা হচ্ছে ‘তোমরা যদি আমার দেওয়া নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করো, তাহলে তা আমি বাড়িয়ে দেব। আর যদি অস্বীকার করো, অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে জেনে রেখো আমার শাস্তি খুবই কঠিন।’ (সূরা ইবরাহিম : ৭)। সুতরাং যৌতুকলোভী পুরুষকে আখেরাতে আল্লাহর আজাব এবং দুনিয়ায় অপমানিত ও লাঞ্ছিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আখেরাতে আল্লাহর শাস্তি এবং দুনিয়ায় সামাজিকভাবে অপমানিত হওয়া থেকে বাঁচতে হলে যৌতুকের লোভ পরিত্যাগ করতে হবে।

তাছাড়া যৌতুক মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের ওপর চরম আঘাত হানে। কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা চাকরিজীবী হলে ঘুষ ও অন্যান্য দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ী হলে চোরাকারবারি, মজুতদারিসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। শ্রমজীবী হলে আগাম শ্রম বিক্রি করে শ্রমের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। কৃষিজীবী হলে কৃষিজমি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। যৌতুক নারীশিক্ষা হ্রাস করে। বাবা মেয়ের শিক্ষার পেছনে অর্থ ব্যয় না করে যৌতুকের অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে নারীশিক্ষার হার কমে যায়, নারীরা অশিক্ষিত থেকে যায়। অশিক্ষিত মায়ের সন্তানও অশিক্ষিত হয়। পরিবার ও সমাজে অশিক্ষা এবং মেধাশূন্যতা দেখা দেয়। অশিক্ষিত মা ও শিশুদের পুষ্টিহীনতাজনিত রোগব্যাধি বৃদ্ধি পায়।

আইন করে এই বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটন সম্ভব কি না, তা বলতে না পারলেও এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের আলেমসমাজ যদি এর মূলোৎপাটনে সর্বান্তকরণে এগিয়ে আসেন, তাহলেই সম্ভব হবে জাহেলিয়াতের এই অভিশাপ থেকে নারীদের রক্ষা করা। এ দেশের আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখরা অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন, এখনও করে যাচ্ছেন। যৌতুকের মাধ্যমে জাহেলিয়াতের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তা প্রতিরোধে তারা যথাযথভাবে এগিয়ে আসবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা। জন্ম, বিয়ে ও মৃত্যুতে তাদের উপস্থিতি অনিবার্য ও সমাজ সংগঠনের অবদান অনস্বীকার্য। বিয়ের সময় যদি তারা তাদের এই ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্বটুকু হেকমতের সঙ্গে পালন করেন, তাহলে নারী নির্যাতন ও নারী অধিকার হরণকারী বিয়ের যৌতুকের অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতি মুক্তি পাবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক : শিক্ষক, বাইতুন নূর মাদ্রাসা ঢাকা