হাওর বার্তা ডেস্কঃ মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কমতে শুরু করেছে পানি। মনু নদের পানি বিপদসীমার ১৮০ সেন্টিমিটার থেকে কমে ৬৮ সেন্টিমিটার উপর ও ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তবে পানি কমতে শুরু করলেও কমছে না পানিবন্দী ৩ লক্ষাধিক মানুষের দুর্ভোগ। বন্যায় বিধ্বস্ত বাড়ি ঘর মেরামত না করে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ফিরতে পারছে না ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষ। বন্যার পানির স্রোতে অনেক যায়গায় রাস্তা-ঘাট ভেঙে গেছে। নিচ থেকে মাটি বের হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও স্থানীয় উদ্যোগে রাস্তা মেরামত করে সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে।
মনু নদের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এবং শহর রক্ষা বাঁধ চরম ঝুঁকিতে পড়ায় সাইফুর রহমান সড়কটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার পর সড়কটি খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে পৌরকর্তৃপক্ষ।
জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, জেলায় মনু ও ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের ২৫ স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে পাঁচ হাজার ৩৯০ জনকে উদ্ধার করে ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। বন্যা ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করতে ১৬ জুন শনিবার সকাল থেকে সেনাবাহিনীর চারটি টিম কাজ করছে। তারা পানিবন্দীদের উদ্ধারে ১৮টি স্পিডবোট ব্যবহার করছে। পানির স্রোতে এ পর্যন্ত ভেসে গিয়ে ১১ জন মানুষ মারা গেছে।
ইতোমধ্যে জেলায় নগদ নয় লাখ ৪০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণের অপেক্ষায় আছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এছাড়া ৭৪৩ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। মজুদ আছে ৬৬৮ টন চাল। তিন হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট পাওয়ার আশ্বাস মিলেছে। শহরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিজিবি টহল দিচ্ছে।
সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে ৭৪টি মেডিকেল টিম বন্যাকবলিত এলাকায় কাজ করছে। সেনাবাহিনীর ২১ ইঞ্জিনিয়ার্সের একটি ইউনিট, জেলা পুলিশ, ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়ন, স্বাস্থ্যবিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, বিএনসিসি, রেডক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে। দুর্গত এলাকা থেকে জরুরি যোগাযোগের জন্য একটি (০১৭২৪৬৮৫৭৮৪) হটলাইন খোলা হয়েছে।
মৌলভীবাজার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, নদী ভাঙনের ফলে সৃষ্ট বন্যায় ৯৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্লাবিত হয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই থেকে তিন ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে। তবে পানি কমায় মৌলভীবাজারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তিনটি উপজেলার সঙ্গে স্বাভাবিক হয়েছে সড়ক যোগাযোগ।
কিন্তু শমশেরনগর-চাতলাপুর চেকপোস্ট সড়কের একটি ব্রিজ দেবে যাওয়ায় ভারতের সাথে বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ। কমলগঞ্জ উপজেলা এবং সিলেটের সঙ্গে এখনও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পানি কমে যাওয়ায় দৃশ্যমান হচ্ছে ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কও। চলমান গতিতে পানি কমতে থাকলে ১ থেকে ২ দিনের মধ্যে সড়ক থেকে পানি পুরোপুরি নেমে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা।
কুলাউড়ার টিলাগাঁও ইউনিয়নের বাগৃহাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রের অনন্ত, মুক্তা, রবীন্দ্র, গোপিকা মালাকার জানান, বন্যার পানি আকস্মিকভাবে প্রবেশ করায় ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি ধান-চালও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে বাড়িঘর মেরামত কাজ শেষ করে তবেই ফিরতে হবে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে।
কুলাউড়ার হাজীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল বাছিত বাচ্চু, শরীফপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব আলী, টিলাগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মালিক ও রাজনগরের কামারচাক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাজমুল হক সেলিম জানান, তাদের ইউনিয়নের রাস্তাঘাট সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। বিধ্বস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি। এসব ঘরবাড়ি মেরামত করার পর আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ফিরতে হবে। মানুষের জন্য সরকারি যে ত্রাণ পাওয়া গেছে তা বেশি বলা যাবে না।
কারণ মানুষের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সে তুলনায় বেশি বলার সুযোগ নেই। সড়ক ও জনপথ বিভাগ মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মিন্টু রঞ্জন দেবনাথ জানান, পানি পুরোপুরি না কমায় ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে যে সব যায়গায় পানি কমেছে তা দ্রুত মেরামত করে চলাচল উপযোগী করার চেষ্টা চলছে। শমশেরনগর-চাতলাপুর চেকপোস্ট সড়কের দেবে যাওয়া ব্রিজটি মেরামত করে সেখানে একটি বেইলি সেতু নির্মাণ করে সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, ‘মনু নদীর পানি বিপদসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ও ধলাই নদের পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি যে গতিতে কমছে তাতে আমরা আশাবাদী খুব তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম জানান, পানি না কমায় ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা সম্ভব হয়নি। ক্ষতিগ্রস্তদের সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে মনু নদীর পানি কমতে শুরু করলেও সৃষ্ট ভাঙন দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া পানি এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি ও রাজনগরের কাউয়াদিঘিতে গিয়ে পড়ছে। এতে হাওরাঞ্চলে পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে ওই এলাকায় নতুন করে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।