বেগম খালেদা জিয়া অবশেষে লন্ডন গেলেন। পার্টির অফিশিয়াল ভার্সন হচ্ছে, তিনি চিকিৎসা এবং পুত্র, দুই পুত্রবধূ ও নাতনিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে একসঙ্গে বকরি ঈদ সেরে আসার উদ্দেশ্যে প্রায় দুই সপ্তাহাধিককালের এ সফরে গেছেন। স্মরণকালের মধ্যে এত দীর্ঘদিন তার দেশের বাইরে থাকার নজির নেই। তার এ সফর নিয়ে বেশ কথাবার্তা হয়েছে। এর পেছনে অবশ্য কারণ ছিল। কয়েকবারই তিনি এ সফরসূচি পরিবর্তন করেছেন। এর আগে তার ওমরাহ্ পালনের জন্য সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল। তাতে তার কয়েকজন সফরসঙ্গীর ভিসা জটিলতার কথা শোনা গিয়েছিল। মিডিয়াতেও তা এসেছিল। কিন্তু তেমন কোনো সমস্যা ছিল না বলে বেগম জিয়ার নিজের বা দলের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। ফলে সৌদি আরবের সঙ্গে বেগম জিয়া ও বিএনপির সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এমন কথাও শোনা গিয়েছিল যে, সবার নয়, তার কয়েকজন সফরসঙ্গীর ব্যাপারে সমস্যা ছিল। প্রশ্ন উঠেছিল, এমন ব্যক্তিদের বেগম জিয়া কেন সঙ্গে রাখতে চান যাদের ব্যাপারে বন্ধুভাবাপন্ন সৌদি আরবেরও আপত্তি থাকে! পরে দলের পক্ষ থেকে হালকা আভাস দেওয়া হয়েছিল যে, ‘চিকিৎসার্থে’ তার বিলাতবাসী পুত্র তারেক রহমানের ভিসা জটিলতার কারণে তিনি সৌদি আরব এসে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না বলে তার সে সফর বাতিল হয়েছিল। লন্ডন সফর নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে পর্যবেক্ষকরা ভিন্ন রাজনৈতিক কারণও বিবেচনায় এনেছিলেন। তারা বলতে চেয়েছেন যে, সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বিবেচনায় দেশে একটি আগাম নির্বাচনের বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী-মিনিস্টার এবং শাসক দলের কোনো কোনো নেতা যদিও বলছেন যে, ২০১৯ সালের আগে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এসব কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সম্প্রতি দলে ও সরকারে শক্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের একটি বক্তব্যকে এ ব্যাপারে অধিকতর প্রণিধানযোগ্য গণ্য করছেন। তার বক্তব্যটি এমন- আগাম নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে দেশের সংবিধান এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে। তিনি চাইলে নির্ধারিত সময়ের আগে নির্বাচন হতে পারে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলে ও সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই শুধু নন, তার আরেকটা সুনামও আছে যে, অন্য অনেকের মতো তিনি বাজে কথা বলেন কম। তাই তার বক্তব্যের অন্তর্নিহিত সুর বিশ্লেষণ করে বলা চলে যে, আগাম নির্বাচনের একটা চিন্তাভাবনা প্রধানমন্ত্রী এবং তার ঘনিষ্ঠ নীতিনির্ধারক সহকর্মীদের মধ্যে আছে। লক্ষণীয় যে, গত দুই মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো প্রকার নেতিবাচক সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত রয়েছেন। তেমন বিবেচনা থেকে পরবর্তী নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়াকে বাইরে রাখার একটা কৌশলী খেলা সরকার পক্ষ খেলতে পারে। পাঠক, আপনারা লক্ষ করে থাকবেন যে, বেশ কিছুদিন ধরে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বেগম জিয়ার সাজা হয়ে যেতে পারে বলে একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে এবং এমন ফৌজদারি মামলায় দুই বছরের বেশি সাজা হলে তিনি কারামুক্তির পরও পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচনের অযোগ্য হবেন। সরকারের ক্ষমতার শরিক, সাবেক স্বৈরাচার এরশাদ তো গলা ফাটিয়ে বলছেন যে, তিনি বেগম জিয়াকে জেলে দেখতে চান। সরকারের আরেক প্রভাবশালী মন্ত্রী তো বেগম জিয়াকে কোন কারাগারে রাখা হবে সেই ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন। এসব বিবেচনায় এমন ধারণা করা অমূলক নয় যে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটা কূটকৌশল সরকার অবলম্বন করতেও পারে। বিএনপির পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় এমন অভিযোগ করা হয়েছে। বেগম জিয়ার বাইরে যাওয়ার এক প্রোগ্রাম বাতিল এবং কোনোটা বারবার পেছানোয় এ আলোচনায় নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে যে, সরকার বেগম জিয়াকে ভিন্ন কৌশলেও আটকানোর চেষ্টা করতে পারে, তিনি বাইরে গেলে কোনো একটি অজুহাত সৃষ্টি করে তার দেশে ফেরায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আমাদের সবার মনে থাকার কথা যে, ওয়ান-ইলেভেনের পর চিকিৎসার জন্য প্যারোলে বিদেশ যাওয়ার পর মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার পথেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। বেগম জিয়াকেও বাইরে পাঠানোর চেষ্টায় ব্যর্থ না হলে, অর্থাৎ তাকেও যদি বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সেই সময়ে সত্যিই হয়তো বিপদে পড়ে যেতেন। এ ক্ষেত্রে বেগম জিয়ার জেদ বা দৃঢ়তা তাকে সাহায্যই করেছে বলতে হবে। তা না হলে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা প্রায় কার্যকর হয়েই যাচ্ছিল। এখন তো বেগম জিয়া একা, তাকে নির্বাচনী সব প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে রেখে বা দূরে রেখে ক্ষমতাসীনরা সুবিধা নেওয়ার কথা ভাবতে পারে এমন ধারণা বিএনপি মহলেও প্রবল। বেগম খালেদা জিয়ার কোনো সফর বাতিল এবং কোনো সফর বারবার পেছানোর ব্যাপারে এমন আশঙ্কা কাজ করে থাকতে পারে। কিন্তু অবশেষে তিনি গেলেন তো! তাহলে এমন সব ধারণা ও প্রচারের ব্যাপারে এখন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কী হতে পারে?
বিএনপি এখন মহাসংকটেই আছে। আন্দোলন-সংগ্রামে তো নেই-ই, সাংগঠনিক কার্যক্রমও বন্ধ প্রায়। স্থবির হয়ে আছে এত বিপুল জনসমর্থিত একটি দল, ভাবতেই অবাক লাগে। আমরা সবাই জানি, জনসমাদৃত একটি রাজনৈতিক দল এমন খারাপ দশায় পড়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং অযোগ্য নেতৃত্বের বারবার ব্যর্থতায়। বিএনপি নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় যুক্ত আছে। তাহলো ক্ষমতায় থাকাকালে অনেকের সীমাহীন দুর্নীতি। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এদের অনেকেরই সাহসী ও গৌরবদীপ্ত ভূমিকা ছিল। বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্ব যেমন এসব নেতাকে প্রেরণা জুগিয়েছে, সহকর্মীদের আন্তরিক ও কার্যকর ভূমিকাও বেগম জিয়ার হাতকে অধিকতর শক্তিশালী করেছে। নেত্রী এবং তার সহযোদ্ধারা ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। কারও কারও মধ্যে তখনো যে স্খলন ছিল না তা নয়। কাউকে কাউকে নানাভাবে হাত করে নিয়েছিলেন এরশাদ। একটি বিশেষ সংস্থা এ ব্যাপারে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সাহায্য করেছিল বলে প্রচার ছিল। আন্দোলনরতদের মধ্যেও কারও কারও ব্যাপারে সন্দেহ-অবিশ্বাস ছিল। বিশেষ করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে কোনো কোনো তারকা ছাত্রনেতা সম্পর্কে বেশ কানাঘুষা ছিল। কিন্তু অধিকাংশের দৃঢ়তা এবং আন্দোলনের তীব্রতার মুখে আন্দোলন নস্যাতের গোপন প্রয়াস ব্যর্থ হয়। যারা সেদিন সাহসী ভূমিকা পালন করে তাদের নেত্রীর পেছনে পাহাড়ের মতো অটল ছিলেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, তাদের অনেকেই পরবর্তীকালে অঙ্গ দল থেকে কিংবা তৃণমূল থেকে দলের উপরি কাঠামোর নেতৃত্বে এসেছেন, দল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দু-তিনবার এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। অনেকেই এখন দলের সিনিয়র নেতা, নীতিনির্ধারণী সংস্থা দলের স্থায়ী কমিটিরও সদস্য। এদের অনেকের বিরুদ্ধেই এখন দলের তৃণমূলের এবং সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের অন্তহীন অভিযোগ। অভিযোগ হচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহার করে, দুর্নীতি-অসদুপায় অবলম্বন করে এরা কেউ কেউ শত কোটি, এমনকি হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। এরা আমাদের সমাজের অতি চেনা লোক। বিএনপির রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে, অর্থাৎ এমপি-মন্ত্রী এবং সরকারি নানা ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির মালিক হওয়ার আগে এদের বিত্তবৈভব কী ছিল, আর এখন কী হয়েছে- এ দুইয়ের ফারাকই বলে দেবে এ ‘সাধুবাবারা’ কী করেছেন। পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় এক সময় এরা অনেক ঝুঁকি নিয়েছিলেন, এখন তাদের হারানোর ভয়। তাই ঝুঁকি নিতে চান না। সমালোচকরা বলেন, এরা আদর্শের জন্য দল করেননি, নিজের আখের গোছানোর জন্য গায়ে ‘রাজনীতির পালক’ জড়িয়েছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়াও এক সময় যত কঠোর ছিলেন, ক্ষমতাপ্রাপ্তির পর এদের ব্যাপারে ধীরে ধীরে নমনীয় হয়ে পড়েন। পাবলিক পারসেপশন জানার পরও তিনি এদের কাউকে কাউকে দলের অনেক উচ্চাসনে স্থান দিয়েছেন। বেগম জিয়াকে কে জবাবদিহি করবে যে, ম্যাডাম, জনশ্রুতি অনুযায়ী দুর্নীতিপরায়ণদের প্রতি আপনি দুর্বল হলেন কেন? বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে যে- জনগণের কাছে দুর্নীতিগ্রস্ত খারাপ লোক হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিরা দলের প্রাথমিক সদস্যপদ লাভেরও যোগ্য নন। তাহলে এরা নেতা হলেন কী করে? গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করা হলো কেন? এরাই বিএনপিকে ডুবিয়েছে এবং জনগণ কাঁধে-ঘাড়ে নিয়ে যতটুকু ভাসিয়ে রেখেছে, এমনও শোনা যায় সেটুকুও ডোবানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে যোগসাজশসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যর্থতা এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আন্দোলনের নামে পেট্রলবোমার হঠকারী রাজনীতির পর জনগণের হতাশা কাটানো ও প্রত্যাশা পূরণের মতো আশাজাগানিয়া কিছুই করতে পারেনি, পারছে না বিএনপি। তবে সব ব্যর্থতার পরও একটা ভালো দিক লক্ষ করা গেছে যে, যা করেছি ঠিক করেছি, এমন গোঁয়ার্তুমি করছে না বিএনপি। বরং মনে হচ্ছে, তাদের মধ্যে এই উপলব্ধি এসেছে যে, তারা ভুল করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে। এটাও বুঝতে পারছে যে, মজবুত সাংগঠনিক ভিত্তি ছাড়া রাষ্ট্রশক্তি নির্ভর একটা সরকারের বিরুদ্ধে তো বটেই, দেশব্যাপী সাদামাটা কোনো কর্মসূচিও পালন করা সম্ভব হয় না। ৬ সেপ্টেম্বর তার প্রমাণ তো হাতেনাতেই পাওয়া গেল। বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছিল ২০ দলীয় জোট। কাগজে-কলমে, আর প্রেসব্রিফিংয়েই ছিল সে কর্মসূচি। রাজধানী ঢাকায় পথেই নামেনি তারা। ঢাকার বাইরেও একই অবস্থা। এমন নয় যে, সরকার বাধা দিয়েছিল। এপ্রিল মাস থেকেই শোনা যাচ্ছিল, দল গুছিয়ে, পুনর্গঠন করে তারা আবার আন্দোলনে নামবে। হঠকারী কর্মসূচি দিলে কী হয় তা তো দেখা গেছে সাম্প্রতিক তিন মাসের অবরোধ-হরতালে। তাই বেগম জিয়া নিজেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, এখন থেকে গণদাবির ভিত্তিতে তারা গণসংশ্লিষ্ট কর্মসূচি দেবেন। তেমন একটি শীতল কর্মসূচি সফল করার মুরোদও দেখাতে পারেনি বিএনপি। ২০ দলের ব্যানারে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে জামায়াতের ভরসায় বসে থাকে দলটি। জামায়াত এখন প্রচণ্ড চাপের মুখে। বাঁচার জন্য তারা কোথাও কোথাও দলেবলে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে শুরু করেছে। আরও নানা কৌশল অবলম্বন করছে তারা। এটা স্বাভাবিক। আন্দোলন তুঙ্গে না উঠলে জামায়াত ঝুঁকিপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ নিয়ে সরকারকে এ মুহূর্তে আর বিরক্ত করতে চাইবে না, এটা রাজনীতিরই অঙ্ক। এ অঙ্ক জামায়াত বোঝে। সরকারও জামায়াতকে নিয়ে নানা ধরনের কৌশলী খেলা খেলতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, তেমন খেলা যে চলছে না তা-ও নয়। জামায়াতকে নিয়ে আওয়ামী লীগ আগেও খেলেছে। ছিয়াশির এরশাদীয় পাতানো নির্বাচনে বিএনপিকে না পেয়ে জামায়াতকে নিয়েই নির্বাচন করে এরশাদের ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জামায়াতকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আবদুর রহমান বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর পক্ষে গোলাম আযমের ‘দরবারেও’ ধরনা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কাজেই, ভোটের খেলায় কখন কী হয় বলা মুশকিল। জামায়াতের এখনকার এজেন্ডা তো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া নয়। তাদের এ মুহূর্তের চাওয়া হচ্ছে নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রক্ষা এবং দলের আনুষ্ঠানিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। এই লক্ষ্য অর্জনে তারা বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগকে বেশি উপযোগী মনে করে তাদের সঙ্গে একটা ‘ভোট লেন-দেন’ সমঝোতার সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করতেই পারে। একটি আগাম নির্বাচনের ব্যবস্থা করে বিএনপিকে তাতে পরাস্ত করে পুনরায় সরকার গঠনের নিশ্চয়তা লাভের কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগও যে তেমন কোনো সমঝোতায় যেতে পারে না, তেমন ‘তওবা’ কিন্তু আওয়ামী লীগ কখনো করেনি। এমতাবস্থায় সরকারবিরোধী আন্দোলন-লড়াইয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী পাওয়া না গেলেও জামায়াতকে জোটে ধরে রাখার চেষ্টা বিএনপিকে হয়তো করতে হবে। তবে বর্তমান চেহারার বিএনপির দাঁড়ানোর শক্তিই যে নেই। সেই শক্তি আহরণ করতে হবে। নিজের পায়েই দাঁড়াতে হবে বিএনপিকে। দল গোছানোর বা পুনর্গঠনের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে পাঁচ মাস ধরে। কিন্তু কই? ‘যেই লাউ, সেই কদুই’ তো! নানা টানাপড়েনের পর বেগম খালেদা জিয়া শেষ পর্যন্ত লন্ডন যাওয়ার পর আবার একটি বিষয় আলোচনায় এসেছে যে, দলকে ‘সিসিইউ’ থেকে উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে সলাপরামর্শ করার জন্যই কি তবে তিনি লন্ডন গেলেন? গত ১৩ সেপ্টেম্বরের লেখায় বেগম জিয়ার লন্ডন সফর স্থগিতকরণ সম্পর্কে যে তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেছিলাম; তবে কি সেসব কারণের অবসান হয়েছে? এমন প্রশ্ন আমাকে কেউ করতেই পারেন। আমার ধারণা, বেগম খালেদা জিয়া তার দেশে ফেরার পথে সরকার কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না- এমন বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই লন্ডন সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এ ব্যাপারে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলে তা দলের অনুকূলে আসবে বলেই হয়তো ভাবছেন। এমন কি দেশে ফেরা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলে তিনি নিজেই লন্ডন অবস্থান প্রলম্বিত করতে পারেন। ইতিমধ্যে অপারেশন ক্লিনহার্ট অবৈধ ঘোষণা করে সেই বিষয়ে দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত তার জন্য নতুন আরেকটি সংকট সৃষ্টি করেছে। দলের ব্যাপারে তারেক রহমানের হস্তক্ষেপ এখন শুভ হবে না, তাই দল নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা এড়ানোর জন্য তিনি লন্ডন সফর নিয়ে বারবার হয়তো ভাবছিলেন, এমন বিষয় উল্লেখ করেছিলাম। প্রশ্ন আসবে, তাহলে গেলেন যে! এটা একটা বড় প্রশ্ন বটে! লন্ডনে দলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মা-ছেলের আলোচনা হবে না, এ কথা এখন আর বলা যাচ্ছে না। এমন কি দেশে যদি আগাম একটি নির্বাচন হয়, সে ব্যাপারে দলের প্রার্থী নিয়েও আলোচনা হতে পারে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এখানেই বেগম খালেদা জিয়াকে দৃঢ়তা দেখাতে হবে। তারেক রহমানকে তার বোঝাতে হবে যে, দলের বর্তমান অবস্থা, নেতা, সংগঠক, কর্মী, সমর্থকদের অবস্থা তিনি তারেকের চেয়ে ভালো জানেন। তারেক রহমান একনাগাড়ে দীর্ঘ আট বছর দেশের বাইরে। লন্ডন থেকে ফোনালাপে দলের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। তাছাড়া ‘ভাইয়ার লোক’ বলে পরিচিত যাদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করার কথা, তারা দলের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কতটা জড়িত আর কতটা ল্যাং মারামারির সঙ্গে- সেটা অবশ্যই তাকে বিবেচনা করতে হবে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে যারা লন্ডনে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেন, তারা যে দলের নিবেদিতপ্রাণ, আদর্শবাদী, ত্যাগী নেতা-কর্মী নন তা বলাই বাহুল্য। সৎ, ত্যাগীরা ‘নেতা-দর্শনে’ এত টাকা পাবে কোথায়? যারা যান, দলের লড়াকু মাঠকর্মী, তৃণমূল সংগঠনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ কতটুকু তা সহজেই বোধগম্য। তারা বিভিন্ন পর্যায়ে নেতা বানানোর জন্য, এমন কি মনোনয়নের জন্যও ‘ভাইয়ার’ কাছে যাদের নাম সুপারিশ করবেন, তারা কি যোগ্য, আদর্শবাদী, ত্যাগী, জনপ্রিয় নেতাদের নাম প্রস্তাব করবেন? শোনা যায়, তদবিরের জন্য তারেক রহমানের পছন্দের কাউকে কাউকে ফাইন্যান্স করার লোকেরও নাকি অভাব নেই। তাই তারেক রহমান যতই দলের মঙ্গল চান না কেন, তার সব বাছাই দলের জন্য কল্যাণকর নাও হতে পারে। দলের শুভানুধ্যায়ীরা মনে করেন, বেগম খালেদা জিয়ার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া মঙ্গলজনক হবে। তারেক রহমানেরও বিষয়টি উপলব্ধি করা উচিত। তিন মাসের অবরোধ-হরতালে যাদের ইনফরমেশনের ভিত্তিতে লন্ডন থেকে তিনি ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, তাতে দলের ক্ষতি হয়েছে। একই সোর্স অব ইনফরমেশনের ভিত্তিতে দল পুনর্গঠন এবং আগামী নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের ব্যাপারেও তার পরামর্শ দলের জন্য সর্বনাশা হতে পারে। ২০০১ সালে তিনি দেশে থেকে যা করতে পেরেছিলেন, বর্তমানে বিলেতে বসে তা করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। কেউ কেউ বলছেন, বেগম খালেদা জিয়া তারেক রহমানকে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে কিছু দিন বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে মনোযোগী হওয়ার কথা বলতে পারেন। শুভানুধ্যায়ীরা মনে করেন, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশে অবস্থানরত এবং সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, লড়াই-সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী দায়িত্ববান প্রবীণ-নবীনের সমন্বয়ে গঠিত একটি যৌথ নেতৃত্ব কাঠামোই বিএনপিকে আবার আলোর পথে টেনে তুলতে পারে। লন্ডনে বেগম জিয়াকে বহনকারী গাড়ির ড্রাইভিং সিটে তারেক রহমানকে দেখা গেছে। এমন চমকের কোনো দরকার ছিল না। রাজনীতিতে এসবের কোনো মূল্য নেই। কখনো কখনো এমন ছেলেমানুষির জন্য উল্টা খেসারত দিতে হয়। সরকার এখন বলতে পারে, তারেক সুস্থ, চিকিৎসার জন্য তার আর লন্ডনে থাকার দরকার নেই। এ সংক্রান্ত তার আইনি সুযোগও সরকার বাতিল করার উদ্যোগ নিতে পারে। মাকে নিয়ে তিনি গাড়ির চালকের আসনে বসেছিলেন, গাড়ি চলে ইঞ্জিনের জোরে, দলের চালকের আসনে তাকে বসিয়ে দিলে দল যেভাবে চলা দরকার সেভাবে চলবে কিনা, ভাবা দরকার; কেননা দল ইঞ্জিনে চলে না। তৃতীয় যে বিষয়ের কথা বলেছিলাম, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপির সঙ্গে একটা সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করতে পারেন বেগম জিয়া- হ্যাঁ, তা করতেই পারেন। তারেক রহমান এই ব্যাপারে একটা ভূমিকা রাখতে পারেন বলে অনেকের বিশ্বাস। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তারেকের যোগাযোগের খবর আগেও শোনা গিয়েছিল। এ ব্যাপারে বেশ কিছু দিন সময় তো আছে বেগম জিয়ার হাতে। তবে সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, এই মুহূর্তে দলের সব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারেক রহমানের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব দলের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। তারেক রহমান তার জন্য উপযুক্ত সময়ে নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য একটু অপেক্ষা করলে ক্ষতি কী?