হাওর বার্তা ডেস্কঃ ফারাক্কা বাঁধের ক্ষতির কথা চিন্তা করেই ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধবিরোধী লংমার্চ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এসেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সেই মরণ বাঁধ ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় এখন নাব্যতা হারিয়েছে প্রমত্তা পদ্মা নদী। একসময়ের উত্তাল পদ্মা এখন অনেকটায় জলশূন্য। এসব কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে দিন দিন কমছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। এই অবস্থায় জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের বিলুপ্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা। নদীতে ড্রেজিং ও দুই পারে বাঁধ নির্মাণ করে পদ্মায় স্বাভাবিক নাব্যতা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে জেলার পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ দ্য নেচার’।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের ঠুঠাপাড়া গ্রাম। এই এলাকা দিয়েই ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে প্রমত্তা পদ্মা। ওপারে ভারতের মালদহ জেলার আড়ঙ্গাবাদ ও শোভাপুর এলাকা। বাংলাদেশের ঠুঠাপাড়া পয়েন্ট থেকে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। সন্ধ্যার পর নদীপারে দাঁড়ালে ফারাক্কা বাঁধের ঝলমলে আলো দেখা যায় বলে জানায় স্থানীয়রা। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের এত কাছাকাছি এসেও পদ্মা নদীতে তেমন একটা পানি প্রবাহ দেখা যায়নি। নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে বালুচর। অনেকটা দূরে পদ্মার স্রোতহীন পানিপ্রবাহ দেখা যায়। বর্তমানে বেশ কয়েকটি চ্যানেলে ভাগ হয়ে পড়েছে পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহ।
স্থানীয়রা জানায়, গত অক্টোবর থেকেই অস্বাভাবিক হারে পদ্মা নদীতে পানি কমতে থাকে। পানি কমতে কমতে এখন পদ্মার বিশাল এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে বড় বড় বালুচর। পানি কমে যাওয়ার জন্য ভারতের ফারাক্কা বাঁধকে দায়ী করেছে স্থানীয়রা। তারা জানায়, ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চল।
মাসুদপুর গ্রামের আজিজুর রহমান জানান, বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময়ে পদ্মায় পানি থাকে না। তাই শুষ্ক মৌসুমে পাশে নদী থাকার পরও জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য মাটির নিচ থেকে পানি তুলতে হচ্ছে।
সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের অধিবাসী জাহাঙ্গীর আলী জানান, শুষ্ক মৌসুমে এসব এলাকায় নলকূপেও ঠিকমতো পানি ওঠে না। পানির অভাবে উর্বরতাশক্তি হারিয়ে ফেলছে জমি। ফলে ফলন দিন দিন কমছে। বেশি সার ব্যবহার করেও ফলন ভালো হচ্ছে না।
সদর উপজেলার ইসলামপুরের স্কুলশিক্ষক খাইরুল ইসলাম জানান, নদীতে পানি না থাকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষক ও জেলেরা। যুগ যুগ ধরে বংশপরস্পরায় সদর ও শিবগঞ্জে পদ্মা তীরবর্তী শত শত পরিবার একসময় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। অথচ এখন তারা বেকার হয়ে পড়েছে। অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে চলে গেছে অন্য পেশায়। তিনি বলেন, এখন পদ্মায় মাছ আর তেমন পাওয়া যায় না। এ ছাড়া জমিতে পানির অভাবে সেচকাজও ব্যাহত হচ্ছে। এক কথায় ফারাক্কা বাঁধের কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চল ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
পদ্মা বাঁচানোর দাবি সেভ দ্য নেচারের : পদ্মায় পানির ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণের দাবি জানিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ দ্য নেচার’। সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়ক রবিউল হাসান ডলার বলেন, বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্ট থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার উজানে ভারত ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে। ২০ কিলোমিটার দূরে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ এবং একতরফাভাবে ভারত পানি প্রত্যাহার করায় পদ্মা নদী এখন মৃতপ্রায়। শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কম থাকায় নদীটি মূল স্রোতধারা হারিয়ে এখন তিনটি আলাদা ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া পদ্মার মূল স্রোতধারা প্রতিবছর পরিবর্তিত হচ্ছে।
বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ করে ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে অকাল বন্যা এবং নদীভাঙন। এর ফলে প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পদ্মাপারের মানুষ ও ফসলি জমি। শুষ্ক মৌসুমে পানি শূন্যতা এবং অসময়ে বেশি পানিপ্রবাহের কারণে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। পদ্মার প্রাকৃতিক প্রবাহ ভারত থেকে নিয়ন্ত্রণ করার কারণে নদীর নাব্যতা হারিয়ে জেগে উঠছে চর। পদ্মা নাব্যতা হারানোয় দেশি জাতের মাছ, শুশুক, ঘড়িয়ালসহ নানা জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। শুশুক ও ঘড়িয়াল এখন বিলুপ্তপ্রায়। এভাবে চলতে থাকলে পদ্মা অদূর ভবিষ্যতে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এ অবস্থায় পানির ন্যায্য হিসসা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ