ঢাকা ১২:০৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সবজি সমৃদ্ধ ময়মনসিংহের ফুলপুরে নেই হিমাগার, বিপাকে চাষিরা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:০৩:৩০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ মার্চ ২০১৮
  • ৩৯৪ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সবজির এলাকা বলে পরিচিত ময়মনসিংহের ফুলপুরে নেই কোন হিমাগার। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপজেলার প্রায় দেড় লাখ কৃষক। ৩১৯.০১ আয়তনের ফুলপুর উপজেলায় মোট ফসলী জমির পরিমাণ ৬৩,১৪৮ হেক্টর। এবার সবজির বাম্পার ফলন পেলেও হিমাগার না থাকায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা।

এই উপজেলায় ছনধরা, রামভদ্রপুর, ভাইটকান্দি, সিংহেশ্বর, ফুলপুর, পয়ারী, রহিমগঞ্জ, বালিয়া ও বওলা নামে দশটি ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটিতেই এখন সবজি হয়। এর মধ্যে পয়ারী, গোপ্তেরগাঁও, ভাইটকান্দি, চরবাহাদুরপুর, চরনিয়ামত, রামভদ্রপুর, ডেফুলিয়া, বাঁশতলা ও কাঁকড়ারচরে সবজি চাষ বেশি হয়। আলু, টমেটো, শসা, বেগুন, ফুলকপি, বাধাকপি, মূলা, গাজর, কাঁচা মরিচ, করল্লা, লাউ, কুমড়া, বরবটি, লাল শাক, পুঁই শাক, পুদিনা শাক, ধনিয়া, ঝিঙেসহ নানা রকম শাক-সবজি চাষ হয় ওইসব এলাকায়।

এসব এলাকায় যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন হয় স্থানীয় চাহিদা পূরণ করেও তা থেকে প্রায় ৮০ মেট্রিক টন সবজি প্রতি বছর দেশ ও দেশের বাইরে বিক্রি করা যায়। এখানকার সবজি রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি করা হয়। এবার ১,১১৫ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছে বলে উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে।

গত বছর ৯৫০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছিল। এবার সবজি চাষ বেড়েছে প্রায় পৌণে দুইশ’ হেক্টর। ফলনও খুব ভাল হয়েছে। এরপরও কৃষকের মন খারাপ। গোপ্তেরগাঁওয়ের কৃষক মিয়া হোসেন ও মকবুল মেম্বার জানান, ‘আমরার ক্ষেতে সবজির ফলন ভাল অইছে। অইলে কি অইবো আমরা তো এর দাম পাই না। ‘কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘এইনো একটা বিরিজ নাই। ট্রাক আইতারে না। সময় মতো মালামাল বিক্রি করতারি না। করলেও মাথাত কইরা খরিয়া নদীর হেইফারে নিয়া হাইদ্যা আধা মূইল্যে বিক্রি করণ লাগে। ‘

ওই এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ফুলপুরে যুদি একটা হিমাগার থাকতো তাইলেও আমরা অতডা ঠগতাম না। অইন্য নিয়া রাইখ্যা দিতাম। পরে দর অইলে বেঁচতাম!’

ডেফুলিয়ার সবজি চাষী মীর ও কাকড়ারচরের আব্দুল জলিল জানান, ‘আমরার জমিতে আলু, টমেটো, ডেংগা, চিচিঙা, শসা সব ফসলই অয়। কিন্তু সীজনে সব ফসলই হস্তায় বেঁইচ্যালানি লাগে। একটা হিমাগার থাকলে ওইসব সবজি সংরক্ষণ করা যাইতো। ‘

আমুয়াকান্দা বাজারের সবজি বিক্রেতা হাশেম, আমিনুল ইসলাম, দুলাল, ফুলপুর বাসস্ট্যান্ডের হেলাল উদ্দিন, ইলিয়াস, ছনকান্দা বাজারের আনোয়ার হোসেন, দিলিপ কুমার ও সবজি বিক্রেতা জামিরুলের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা সীজনে কমমূল্যে সবজি কিনতে পারলেও হিমাগার না থাকায় তা সংরক্ষণ করতে পারেন না। ফলে অনেক সময় কম মূল্যেই বিক্রি করে দিতে হয়। তা না হলে পঁচে নষ্ট হয়ে যায় মাল। এতে প্রায়ই তারা ক্ষতিগ্রস্তও হয়ে থাকেন। বর্তমানে সীম, গাজর, বরবটি, ঝিঙেসহ গুণা কয়েকটি সবজির দাম বেশি হলেও টমেটো, আলু, বেগুন ও মূলাসহ প্রায় সব সবজিরই তুলনামূলক দাম কম।

আমুয়াকান্দা বাজারের কাঁচা বাজার ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম জানান, যে টমেটো এখন ৭ টাকা কেজি মাসখানেক পরে তা বেড়ে ৬০-৭০ টাকা হয়ে যাবে। আলুর কেজি বর্তমানে ১৫ টাকা, কিন্তু মাস দুয়েক মাস পর তা বেড়ে হতে পারে ৪০-৫০ টাকা। সীম এখন ২০ থেকে ২৫ টাকা। তা ৭০-৮০ টাকা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একই অবস্থা গাজর, কপি ও বেগুনসহ অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় সবজির বেলায়ও।

রামভদ্রপুর, চরনিয়ামত ও বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শরীরের রক্ত পানি করে ফলানো কৃষকের কষ্টার্জিত সবজি ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্ষেতে পাইকার যাচ্ছে না এবং ওইসব সবজি সংরক্ষণের কোন হিমাগারও নেই। কথা হয় কৃষক মাসুদ রানার সাথে। তিনি বলেন, নিজের জমি নেই। ১০ কাঠা জমি রেন নিয়ে টমেটো করছিলাম। এখন বেঁচতে পারতেছি না। পাইকার আসে না। ক্ষেতের টমেটো ক্ষেতেই পঁচে গলে নষ্ট হচ্ছে।

আমুয়াকান্দা, ছনকান্দা, ভাইটকান্দিসহ উপজেলার বড় বড় বাজার ঘুরে দেখা যায়, বেগুন, টমেটো, কপি, সীম, শসাসহ অনেক সবজি নষ্ট হচ্ছে। বিক্রি না করতে পেরে রাস্তা ও ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন তারা। অথচ হিমাগার থাকলে এ অবস্থা হতো না।

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি অফিসার সুকল্প দাস বলেন, ফুলপুর কৃষিতে ন্যায্যমূল্য পেতে হলে হিমাগারের বিকল্প নেই। হিমাগার থাকলে ক্রেতারাও সহনীয় মূল্যে সবজি কিনতে পারবেন। এ বিষয়ে ময়মনসিংহ কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. এস এম আবুল হোসেনের নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছোট আকারের হলেও ফুলপুরে একটি হিমাগারের খুবই প্রয়োজন। সরকারীভাবে ব্যবস্থা না হলে প্রাইভেটভাবে হলেও উদ্যোগ নেয়া দরকার। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতারাও সহযোগিতা করতে পারেন বলে তিনি জানান। এমপি শরীফ আহমেদ বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর সাথে কথা বলব। ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে একটি হিমাগারের জন্য ফুলপুরবাসী মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সবজি সমৃদ্ধ ময়মনসিংহের ফুলপুরে নেই হিমাগার, বিপাকে চাষিরা

আপডেট টাইম : ০১:০৩:৩০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ মার্চ ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সবজির এলাকা বলে পরিচিত ময়মনসিংহের ফুলপুরে নেই কোন হিমাগার। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপজেলার প্রায় দেড় লাখ কৃষক। ৩১৯.০১ আয়তনের ফুলপুর উপজেলায় মোট ফসলী জমির পরিমাণ ৬৩,১৪৮ হেক্টর। এবার সবজির বাম্পার ফলন পেলেও হিমাগার না থাকায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা।

এই উপজেলায় ছনধরা, রামভদ্রপুর, ভাইটকান্দি, সিংহেশ্বর, ফুলপুর, পয়ারী, রহিমগঞ্জ, বালিয়া ও বওলা নামে দশটি ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটিতেই এখন সবজি হয়। এর মধ্যে পয়ারী, গোপ্তেরগাঁও, ভাইটকান্দি, চরবাহাদুরপুর, চরনিয়ামত, রামভদ্রপুর, ডেফুলিয়া, বাঁশতলা ও কাঁকড়ারচরে সবজি চাষ বেশি হয়। আলু, টমেটো, শসা, বেগুন, ফুলকপি, বাধাকপি, মূলা, গাজর, কাঁচা মরিচ, করল্লা, লাউ, কুমড়া, বরবটি, লাল শাক, পুঁই শাক, পুদিনা শাক, ধনিয়া, ঝিঙেসহ নানা রকম শাক-সবজি চাষ হয় ওইসব এলাকায়।

এসব এলাকায় যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন হয় স্থানীয় চাহিদা পূরণ করেও তা থেকে প্রায় ৮০ মেট্রিক টন সবজি প্রতি বছর দেশ ও দেশের বাইরে বিক্রি করা যায়। এখানকার সবজি রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি করা হয়। এবার ১,১১৫ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছে বলে উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে।

গত বছর ৯৫০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছিল। এবার সবজি চাষ বেড়েছে প্রায় পৌণে দুইশ’ হেক্টর। ফলনও খুব ভাল হয়েছে। এরপরও কৃষকের মন খারাপ। গোপ্তেরগাঁওয়ের কৃষক মিয়া হোসেন ও মকবুল মেম্বার জানান, ‘আমরার ক্ষেতে সবজির ফলন ভাল অইছে। অইলে কি অইবো আমরা তো এর দাম পাই না। ‘কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘এইনো একটা বিরিজ নাই। ট্রাক আইতারে না। সময় মতো মালামাল বিক্রি করতারি না। করলেও মাথাত কইরা খরিয়া নদীর হেইফারে নিয়া হাইদ্যা আধা মূইল্যে বিক্রি করণ লাগে। ‘

ওই এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ফুলপুরে যুদি একটা হিমাগার থাকতো তাইলেও আমরা অতডা ঠগতাম না। অইন্য নিয়া রাইখ্যা দিতাম। পরে দর অইলে বেঁচতাম!’

ডেফুলিয়ার সবজি চাষী মীর ও কাকড়ারচরের আব্দুল জলিল জানান, ‘আমরার জমিতে আলু, টমেটো, ডেংগা, চিচিঙা, শসা সব ফসলই অয়। কিন্তু সীজনে সব ফসলই হস্তায় বেঁইচ্যালানি লাগে। একটা হিমাগার থাকলে ওইসব সবজি সংরক্ষণ করা যাইতো। ‘

আমুয়াকান্দা বাজারের সবজি বিক্রেতা হাশেম, আমিনুল ইসলাম, দুলাল, ফুলপুর বাসস্ট্যান্ডের হেলাল উদ্দিন, ইলিয়াস, ছনকান্দা বাজারের আনোয়ার হোসেন, দিলিপ কুমার ও সবজি বিক্রেতা জামিরুলের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা সীজনে কমমূল্যে সবজি কিনতে পারলেও হিমাগার না থাকায় তা সংরক্ষণ করতে পারেন না। ফলে অনেক সময় কম মূল্যেই বিক্রি করে দিতে হয়। তা না হলে পঁচে নষ্ট হয়ে যায় মাল। এতে প্রায়ই তারা ক্ষতিগ্রস্তও হয়ে থাকেন। বর্তমানে সীম, গাজর, বরবটি, ঝিঙেসহ গুণা কয়েকটি সবজির দাম বেশি হলেও টমেটো, আলু, বেগুন ও মূলাসহ প্রায় সব সবজিরই তুলনামূলক দাম কম।

আমুয়াকান্দা বাজারের কাঁচা বাজার ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম জানান, যে টমেটো এখন ৭ টাকা কেজি মাসখানেক পরে তা বেড়ে ৬০-৭০ টাকা হয়ে যাবে। আলুর কেজি বর্তমানে ১৫ টাকা, কিন্তু মাস দুয়েক মাস পর তা বেড়ে হতে পারে ৪০-৫০ টাকা। সীম এখন ২০ থেকে ২৫ টাকা। তা ৭০-৮০ টাকা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একই অবস্থা গাজর, কপি ও বেগুনসহ অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় সবজির বেলায়ও।

রামভদ্রপুর, চরনিয়ামত ও বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শরীরের রক্ত পানি করে ফলানো কৃষকের কষ্টার্জিত সবজি ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্ষেতে পাইকার যাচ্ছে না এবং ওইসব সবজি সংরক্ষণের কোন হিমাগারও নেই। কথা হয় কৃষক মাসুদ রানার সাথে। তিনি বলেন, নিজের জমি নেই। ১০ কাঠা জমি রেন নিয়ে টমেটো করছিলাম। এখন বেঁচতে পারতেছি না। পাইকার আসে না। ক্ষেতের টমেটো ক্ষেতেই পঁচে গলে নষ্ট হচ্ছে।

আমুয়াকান্দা, ছনকান্দা, ভাইটকান্দিসহ উপজেলার বড় বড় বাজার ঘুরে দেখা যায়, বেগুন, টমেটো, কপি, সীম, শসাসহ অনেক সবজি নষ্ট হচ্ছে। বিক্রি না করতে পেরে রাস্তা ও ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন তারা। অথচ হিমাগার থাকলে এ অবস্থা হতো না।

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি অফিসার সুকল্প দাস বলেন, ফুলপুর কৃষিতে ন্যায্যমূল্য পেতে হলে হিমাগারের বিকল্প নেই। হিমাগার থাকলে ক্রেতারাও সহনীয় মূল্যে সবজি কিনতে পারবেন। এ বিষয়ে ময়মনসিংহ কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. এস এম আবুল হোসেনের নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছোট আকারের হলেও ফুলপুরে একটি হিমাগারের খুবই প্রয়োজন। সরকারীভাবে ব্যবস্থা না হলে প্রাইভেটভাবে হলেও উদ্যোগ নেয়া দরকার। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতারাও সহযোগিতা করতে পারেন বলে তিনি জানান। এমপি শরীফ আহমেদ বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর সাথে কথা বলব। ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে একটি হিমাগারের জন্য ফুলপুরবাসী মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন।