আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে দুই ডজন প্রার্থী

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাজা-জমিদারদের তীর্থভূমি গৌরীপুর। জামিদারী শাসনামল না থাকলেও ইতিহাস ঐত্যিহের সাক্ষী হয়ে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাজা-জমিদারদের নানা স্মৃতিচিহ্ন। এ উপজেলা একটি পৌরসভা ও দশটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন ময়মনসিংহ-৩। এ আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থিতার ছড়াছড়ি। সবাই চান এমপি হতে। এ নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় পেতে কঠোর অবস্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।

সূত্রমতে, গৌরীপুর আসনে মোট ভোটার দুই লাখ ২৬ হাজার ৭২৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ এক লাখ ১৪ হাজার ১৬৪ জন এবং নারী ভোটার এক লাখ ১২ হাজার ৫৬১ জন। সংশোধিত তালিকায় এ সংখ্যা কমবেশি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি।

স্থানীয়রা জানায়, এ আসনের সাবেক এমপি প্রয়াত স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্যাপেন্ট (অব.) মজিবুর রহমান ফকির মারা যাওয়ার পর উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদ। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর একসময়ের আতঙ্কিত গৌরীপুরে স্বস্তি ফিরিয়ে আনলেও সম্প্রতি উপজেলা যুবলীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এ জনপদ। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহল ও সাধারণ মানুষের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

দলীয় একাধিক নেতাকর্মী জানান, বর্তমান এমপিকে বিব্রত করার জন্যই বিরোধী পক্ষের নেতাদের ইন্ধনে নানা সময়ে ঘটছে ছোট-বড় নানা অঘটন। তবে প্রশাসনের সহযোগিতায় এসব শক্ত হাতেই সামাল দিচ্ছেন এমপি নাজিম। তবে এমপিপুত্র জেলা যুবলীগ সদস্য তানজীর আহম্মেদ রাজীবকে নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে দলীয় পরিমণ্ডলের ভেতরে-বাইরে। ফলে আওয়ামী লীগের একটি পক্ষের এ বিষয়টি ইস্যু করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নেতারা।

তবে এসব বিষয়ে ময়মনসিংহ-৩ গৌরীপুর আসনের এমপি অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, সারাজীবন দেশের জন্য রাজনীতি করেছি। এখনো করছি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে উপনির্বাচনে এমপি হয়েছি। ভবিষতে দলীয় মনোনয়নে নেত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে চেষ্টা করছি প্রত্যাশিত জনসেবা করতে। কিন্তু এত অল্প সময়ে সব প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব না হলেও ইতোমধ্যে উপজেলায় ১৭ কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরণ, শতভাগ বিদ্যুতায়নের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন, বহুল প্রত্যাশিত জলভুরোঙ্গা ব্রিজ অনুমোদন, স্টেডিয়াম নির্মাণ, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, রেলস্টেশন আধুনিকায়ন, ৩টি উচ্চ বিদ্যালয়ে বহুতল ভবন নির্মাণ, ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংস্কারসহ উপজেলার ৭টি বাজার এবং এক হাজার পরিবার ও প্রতিষ্ঠানে ১০৩৬টি সোলার প্যানেল সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়াও আরো বেশ কিছু উন্নয়ন কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

সূত্রমতে, এ আসনে দু’দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা দুই ডজনের বেশি। তারা নানা কৌশলে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে করছেন নির্বাচনী গণসংযোগ। উপজেলা থেকে গ্রাম পর্যন্ত দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়েও লবিং-গ্রুপিংয়ে ব্যস্ত সময় পার করে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের পক্ষে টানার চেষ্টা করছেন তারা। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় তোলপাড় চলছে। তৃণমূল থেকে দলীয় হাইকমান্ড পর্যন্ত দৃষ্টি আকর্ষণে উপজেলার সীমানা পেরিয়ে জেলা সদরের পথে পথে লাখ লাখ টাকা খরচ করে করছেন প্রচারণা।

স্থানীয় সূত্রমতে, এ আসনে নৌকার মাঝি হতে মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়ে মাঠে কাজ করছেন বর্তমান এমপি ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদ, পৌর মেয়র সৈয়দ রফিকুল ইসলাম, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শরীফ হাসান অনু, কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক কৃষিবিদ ডক্টর সামিউল আলম লিটন, মোর্শেদুজ্জামান সেলিম, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মতিউর রহমান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলী আহম্মদ খান পাঠান সেলভী, অধ্যক্ষ একেএম আবদুর রফিক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম মুহাম্মদ আজাদ,

জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তুফা ভিপি বাবুল, পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. শফিকুল ইসলাম হবি, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের নেত্রী নাজনীন আলম, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সানাউল হক, উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রাবেয়া ইসলাম ডলি, নাজনীন আলম ও শিল্পপতি এম এ মামুন। ইতোমধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এলাকায় সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের খণ্ডচিত্র বিলবোর্ড আকারে নির্বাচনী এলাকায় তুলে ধরছেন। সভা-সমাবেশ থেকে শুরু করে উপজেলা সদর থেকে গ্রামাঞ্চলের সড়ক ও হাট-বাজারে তোরণ নির্মাণ করে ঈদ ও পুজার শুভেচ্ছাও জানাচ্ছেন। করেছেন পোস্টারিং।

দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, এমপি নাজিম পরিচ্ছন্ন ইমেজের ব্যক্তি এবং দলে পরীক্ষিত। আগামী নির্বাচনে এ আসনের মনোনয়ন পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বা অন্য কোনো কারণে মনোনয়ন পরিবর্তন হলে কে হবেন এ আসনের নৌকার কাণ্ডারী- তা এখন বলা মুশকিল। কারণ তৃণমূলে দীর্ঘ সময় ধরে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন তরুণ প্রায় হাফ ডজন প্রার্থী। এদের মধ্যে কৃষিবিদ ড. লিটন, শরীফ হাসান অনু এবং মুর্শেদুজ্জামান সেলিম তৃণমূলে বেশ জনপ্রিয়। ফলে আগামী নেতৃত্বে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ।

অপর একটি সূত্রমতে, ভোট রাজনীতিতে বার বার সফলতা দেখিয়ে নীরবে এগিয়ে চলছেন পৌর মেয়র সৈয়দ রফিক। ইতোমধ্যে মাঠ রাজনীতির হিসাব-নিকাশেও তিনি এ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। আগামী নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী পরিবর্তন হলে তিনিও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়বেন বলেও দাবি এ সূত্রের।

শরীফ হাসান অনু বলেন, বিগত সময়ে দলের নেতাকর্মীদের পাশে থেকে কাজ করছে। আশা করি দল আমাকে মূল্যায়ন করবে।

একই ধরনের বক্তব্য কৃষিবিদ ডক্টর সামিউল আলম লিটনের। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ জরিপে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী করছি। জনগণ আমার সঙ্গে আছে।

তবে মুর্শেদুজ্জামান সেলিম বলেন, সাংগঠনিকভাবে দল খুব দুর্বল হলেও নেতাকর্মীরা বেশ ঐক্যবদ্ধ। তারা নেতৃত্বের পরিবর্তন চায়। মনোনয়ন বিষয়ে আমি আশাবাদী।

সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের হাতেম আলী এমসিএ নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের নাজিম উদ্দিন আহমেদ এমপি নির্বাচিত হলেও ১৯৭৯ সালে বিএনপির অ্যাডভোকেট এ এফ এম নাজমুল হুদার কাছে পরাজিত হন। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির নুরুল আমিন খান পাঠান এ আসনে বিজয়ী হন। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের নজরুল ইসলাম আসনটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন।

কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তিনি ইহকাল ত্যাগ করলে তার স্ত্রী রওশন আরা নজরুল উপনির্বাচনে বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এবং ১৯৯৬ সালে ১২ জুনের নির্বাচনে বিএনপির অ্যাডভোকেট এ এফ এম নাজমুল হুদা আসনটি পুনরুদ্ধার করেন। ২০০১ সালে ডা. ক্যাপ্টেন (অব.) মজিবুর রহমান ফকির আসনটি দখলে নেয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের হাতেই বাঁধা পড়ে যায় এ আসনটি। ২০০৮ সাল ও ২০১৪ সালেও ডা. ক্যাপ্টেন (অব.) মজিবুর রহমান ফকির টানা তৃতীয়বারের মতো বিজয় ধরে রাখেন।

অপরদিকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যাও কম নয়। এ আসনের বর্ষীয়ান বিএনপি নেতা প্রয়াত আইনজীবী এএফএম নাজমুল হুদা মারা যাওয়ার পর যোগ্য নেতৃত্ব সংকটে সাংগঠনিকভাবে বেহাল অবস্থায় আছে দলটি। কেউ কাউকে মানতে নারাজ। ফলে বর্তমানে বহু গ্রুপে বিভক্ত এখন স্থানীয় বিএনপি। সম্প্রতি সময়ে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার মকবুল হোসেন বকুল মারা যাওয়ার পর এ সংকট আরো গভীর হয়েছে। তবে আগামী দিনে যোগ্য নেতৃত্ব পেলে বিএনপি শক্তিশালী অবস্থার প্রকাশ ঘটনাতে সক্ষম বলে মনে করছেন একাধিক সূত্র।

জানা যায়, আগামী নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন চাইছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এম ইকবাল হোসাইন, জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুল হক, বিএনপি নেতা ডা. আবদুস সালাম, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আহম্মেদ তায়েবুর রহমান হিরন, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান তানজিন চৌধুরী লিলি, শিল্পপতি শহীদুল আরেফিন খোকন প্রমুখ।

সূত্রমতে, এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন কে পাচ্ছে, তা বলা কঠিন। তবে বিগত নির্বাচনে এ আসনে ইকবাল হোসাইন দলীয় মনোনয়ন পেলেও গত ৯ বছরে তিনি দল গোছাতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে আগামী ভোটযুদ্ধের আগে তাকে কঠিন মনোনয়ন যুদ্ধে নামতে হবে। সে হিসেবে মনোনয়ন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শক্ত অবস্থানে রয়েছেন অ্যাডভোকেট নূরুল হক, হিরন ও ডা. সেলিম।

মামলা-হামলায় নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে থেকে আইনি সহযোগিতা দিয়ে ইতোমধ্যে সুনাম কুড়িয়েছেন অ্যাডভোকেট নূরুল হক। এ ছাড়াও দুঃসময়ে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নেও তিনি পরীক্ষিত নেতার স্বাক্ষর রেখেছেন। পিছিয়ে নেই উপজেলা চেয়ারম্যান হিরনও। তবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক নেই হিরনের। বিশেষ করে দলীয় নেতাকর্মীদের মারপিট-মামলায় হয়রানি করার কারণে তিনি বেশ বিতর্কিত খোদ দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে।

এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার আহম্মেদ তায়েবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য জানা যায়নি। তবে হিরন সমর্থকদের দাবি, এ সব বিরোধী পক্ষের আওয়াজ। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন এবং দলে তিনি সব সময়ই সক্রিয়।

এ ছাড়াও এ আসনে জোটগতভাবে মনোনয়ন চাইছেন জেলা ইসলামী ঐক্যজোটের সাধারণ সম্পাদক হাফেজ মাওলানা আবু তাহের খান। বিগত উপনির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার আওয়াজ দিচ্ছেন। দীর্ঘ সময় ধরে এ উপজেলায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকায় ভোট রাজনীতিতে তিনি একটি জায়গা করে নিয়েছেন বলেও দাবি একাধিক সূত্রের। সেই সঙ্গে এ আসন থেকে জেলা জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক মোশারফ হোসেন বাবুল প্রার্থী হতে পারেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। এমন হলে পাল্টে যেতে পারে ১৪ দলীয় জোটের মনোনয়ন হিসাব-নিকাশ।

সূত্রঃ মানবকণ্ঠ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর