সুন্দরবনের সুন্দর ও নির্জনতা আমাদের হরহামেশাই চুপিসারে ডেকে বেড়ায়। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জোয়ারবিধৌত এ গড়ান বনভূমিতে। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা -এ তিন নদীর অববাহিকায় অবস্থিত বনটিতে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এ রাজকীয় বাঘের জন্য দুনিয়াজুড়ে বনটির আলাদা খ্যাতি।
ভারত ও বাংলাদেশের মতো দু’টি জনবহুল দেশের উপকূলজুড়ে এ বন। তাইতো ভ্রমণপিপাসুদের প্রথম পছন্দ সুন্দরবন।
কেন যাবেন?
দেখার মতো রয়েল বেঙ্গল টাইগার তো রয়েছেই। প্রায় চার’শর মতো বাঘ রয়েছে এ দৃষ্টিনন্দন রহস্যময় বনে। একক সংখ্যার হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বাঘ রয়েছে বনটিতে। মানুষখেকো বলে দুর্নাম আছে বটে, তবে এ বাঘদের দেখতে পাওয়াও বেশ বিরল। আপনার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলেই কেবল দেখতে পাবেন তাদের।
টাইগারদের খুঁজে খুঁজে এক নজর দেখার অভিজ্ঞতা কম রোমাঞ্চকর নয়। দুভার্গ্যবশতই যদি আপনি বাঘ দেখতে নাই পান, তবে নৌকার খলুইতে বসে শ্বাসমূলের বনটি দেখতে থাকুন, এক ধরনের স্বপ্নময় ঘোরে কেটে যাবে আপনার সময়। জালের মতো বিছানো শত শত নদী আর খালের বাঁকে বাঁকে সৌন্দর্যের পসরা দেখে প্রাণজুড়ানো অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন।
কিভাবে দেখবেন সুন্দরবন?
সুন্দরবনের ষাট ভাগ বাংলাদেশে ও বাকি চল্লিশভাগ ভারতে। যার ফলে ভারত-বাংলা এ দুই দেশ থেকে আপনি সুন্দরবন দেখতে পাবেন। সুন্দরবনের ভারতের অংশে ঢোকা যায় খুব সহজেই। তবে জঙ্গলের গহীনে যেতে হলে আপনাকে বাংলাদেশ থেকেই ঢুকতে হবে।
খুলনা থেকে নৌভ্রমণ
ম্যানগ্রোভের সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো বনের ভেতরে হারিয়ে গিয়ে রোমাঞ্চ ও শিহরণ অনুভব করা। সুন্দরবনে রয়েছে অপার রহস্য ও প্রশান্তি। সুন্দরের সেই প্রশান্তি পেতে চাইলে আপনি বনের ভেতরে তিন থেকে চারদিনের নৌভ্রমণে যেতে পারেন।
খুলনা থেকেই যেটা খুব সহজেই করা সম্ভব। নৌকায়ই আপনি খাবেন, ঘুমাবেন এবং সুযোগ বুঝে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বাঘের সন্ধানে বের হবেন। এরা খুব অভিজাত বাঘ, তাই দেখা পাওয়াও মুশকিল। হেঁটে গেলে সশস্ত্র বনপ্রহরীদের সঙ্গে যাবেন। অথবা ছোট্ট নদীতে ছোট নৌকায় চড়ে ঢেউয়ের তালে তালে দেখতে পারেন গড়ান, গোলপাতা, পশুর, কেওড়া, সুন্দরী, খলসে, বাইন, পশুর, গেওয়া, কেওড়া, হেতাল, গর্জন, ধুন্দল আর গেওয়ার সমাহার।
সুন্দরবনের দক্ষিণের বেশিরভাগই জনবিরল অঞ্চল। তন্ন তন্ন করে খুঁজে বাঘের দেখা না মিললেও বন্য শুকর, ডোরাকাটা হরিণ, বানর, কুমির, ডলফিন, হাঙ্গর, বন মোরগ ও সরীসৃপসহ বিপুল বৈচিত্রময় পাখি দেখতে পাবেন। মৌমাছির গুঞ্জনে হয়ত প্রকৃতির এ অভয়ারণ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন। বিভিন্ন টুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস সংস্থা সুন্দরবনে ভ্রমণের আয়োজন করে।
বেঙ্গল টুরস লিমিটেডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আশরাফ বলেন বাংলানিউজকে, খুলনা থেকে সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য তাদের নিজস্ব দু’টি জাহাজ রয়েছে। একটিতে ছাব্বিশ জন ও অন্যটিতে ৪৬ জন যাত্রী বহন করতে পারে। দুই রাত তিন দিনের ভ্রমণ খরচ হিসাবে তারা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্যে জনপ্রতি এগারো হাজার এবং বিদেশীদের কাছ থেকে পনেরো হাজার টাকা নেন। তবে মংলা থেকে সুন্দরবন ভ্রমণে তাদের কোনো জাহাজ নেই।
এছাড়াও রয়েছে গাইডটুরবিডি ও বাংলাদেশ ইকোটুরসসহ বিভিন্ন টুরিস্ট কোম্পানি।
গ্রিনবাংলা টুরসের কর্ণধার কিবরিয়া বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবন ভ্রমণের জন্যে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বয়স্কদের জন্য তাদের ঢাকা-সুন্দরবন-ঢাকা ১৫ হাজার টাকার বিশেষ প্যাকেজ রয়েছে। একটি প্যাকেজে ছয়জন পর্যন্ত পর্যটক যেতে পারবেন। শিশুদের জন্যে যেটির খরচ পড়বে ৮ হাজার টাকা। এছাড়া ১২ হাজার টাকায় তাদের নিয়মিত প্যাকেজ তো রয়েছেই।
মংলা থেকে একদিনের সুন্দরবন সফর
খুলনা থেকে কয়েকদিনের সুন্দরবন সফরের সামর্থ্য আপনার নাও থাকতে পারে। বিশেষ করে এ ধরনের সফরের ক্ষেত্রে সময় এবং অর্থ দু’টোরই অভাব থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনি নিজ উদ্যোগে কম খরচে মংলা বন্দরের ছোট নদী দিয়ে সুন্দরবনে একদিনের ভ্রমণে যেতে পারেন। এজন্য আপনাকে খুব একটা পূর্ব পরিকল্পনা করতে হবে না।
কেবল মংলার উদ্দেশে ঘর থেকে বের হবেন, লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে একসময় পৌঁছে যাবেন বন্দরের পর্যটন ঘাটে। ঢাকা থেকে মংলা বিভিন্ন কোম্পানির বাস সার্ভিস রয়েছে। মংলায় পৌঁছালে ব্যক্তিগত নৌকার মালিকরা আপনাকে খুঁজে নেবেন। থাকাতে চাইলে মংলা বাসস্ট্যান্ডের পাশে সরকার পরিচালিত পর্যটন হোটেল রয়েছে।
এছাড়া নদীর ভাটিতে নৌকায় করে আপনি করমজল ফরেস্ট স্টেশনে চলে যেতে পারেন। আর যদি সাততাড়াতাড়িই রওনা দেন, তবে হারবাড়িয়া বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমেও ভ্রমণ করতে পারেন। একটু হাঁটাহাটি করলে করমজল ফরেস্ট স্টেশনে আপনি একটি ছোট্ট চিড়িয়াখানা দেখতে পাবেন। কিন্তু আপনি যদি সুদূর সাফারি পার্কে না গিয়ে নৌকা ভ্রমণেও বের হন, তবে আপনি হতাশ হবেন না।
মধু আহরণ অভিযান
বাঘ, কুমিরসহ নানা হিংস্র প্রাণীকে ভয় না পেয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে গহীন জঙ্গল থেকে মধু আহরণ করে আসছেন মৌয়ালরা। এক্ষেত্রে মৌয়াল দলের সঙ্গে বনের গহীনে ঢুকে আপনিও নিতে পারেন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। কেবল বছরের দুই মাস মধু আহরণ করা হয়। তবে পর্যটন সংস্থাগুলো সাধারণত এপ্রিলে মধু আহরণ অভিযানের আয়োজন করে। এতে চার রাত তিনদিনের ভ্রমণে আপনার খরচ পড়বে সাড়ে তেরো হাজার টাকা। বিদেশীদের জন্যে একটু বেশি খরচ পড়বে, সাড়ে পনেরো হাজার টাকা।
কখন যাবেন?
সুন্দরবন ভ্রমণের জন্যে সবচেয়ে আরামের ও উপযুক্ত সময় হচ্ছে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস। তখন খুবই ঠাণ্ডা থাকে। সামান্য বৃষ্টিও হতে পারে এ সময়। তাপমাত্রা থাকে পনেরো থেকে পঁচিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। তবে জুন থেকে আগস্টে গ্রীষ্মের বৃষ্টি সুন্দরবনের সবুজ প্রকৃতিকে আরও সবুজাভ করে তোলে। তবে বন্যা আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনায় বাধা তৈরি করতে পারে। আর এপ্রিলে কেবল মধু আহরণ অভিযানে যেতে পারেন।