হাওর বার্তা ডেস্কঃ ‘কি গান মাঝি হুনাইলা, কি বাঁশি মাঝি বাজাইলা/কর্ণফুলীর সাম্পানওয়ালা/ আঁর মন হারি নিলা…’ কর্ণফুলী নদী আর সাম্পান মাঝিদের নিয়ে এমন অনেক গান আছে। কয়েক বছর আগেও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের ধারক কর্ণফুলী নদীর সুবিশাল বুক জুড়ে ছিল নৌকা-সাম্পানের অবাধ বিচরণ।
স্থানে স্থানে নদীর থৈ থৈ রূপালি পানির ধারে ছিলো খেয়া পারাপারের মুখরতা। ঘাটে ঘাটে সারাক্ষণ ছিল বৈঠা-জলের শব্দ। কিন্তু সেই দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। যান্ত্রিক সভ্যতার দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী নৌকা-সাম্পানগুলো, ফুরিয়ে যাচ্ছে মাঝিদের সোনালি দিন। একসময় কর্ণফুলী পাড়ের মানুষের সাথে নৌকা-সাম্পানের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। নদী তীরের বাসিন্দাদের জীবনের জন্য ছিল নৌকার নিবিড় প্রয়োজন। বাজার-হাটে যাতায়াত থেকে শুরু করে বিয়ের অনুষ্ঠানেরও একমাত্র বাহন ছিল পালতোলা নৌকা। উন্নত সড়কপথ না থাকায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেও নৌকা ছিল একমাত্র ভরসা।
কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় এসে সড়ক যোগাযোগের উন্নতি হওয়ায় ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের দখলে চলে যাচ্ছে সবকিছুই।
ফলে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের ঐতিহ্য নানা নামের বাহারি নৌকা। নদী থেকে নৌকা-সাম্পানের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন এসব নৌকা-সাম্পানের সাথে জড়িত মাঝি পরিবারের সদস্যরা। কর্ণফুলী নদীর খেয়া ঘাটের মাঝিরা এখন তাদের আদি পেশা পাল্টিয়ে ফেলছেন। মাছধরা, গাছ-বাঁশকাটা, ধানাকাটসহ দৈনিক শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন বিকল্প পেশায় চলে যাচ্ছেন তারা।
পার্বত্য রাঙামাটির লুসাই পাহাড়ে সৃষ্টি হয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় সাগরের মোহনায় মিলিত হয়েছে কর্ণফুলী। আর এই কর্ণফুলী নদীকে ঘিরেই হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকা, স্বপ্ন, ভালোবাসা, বেঁচে থাকা। একসময় নদীর দুই পাড়ে কয়েক শ ঘাট ছিল। এসব ঘাট দিয়ে নৌকা-সাম্পানে চড়ে পারাপার হত যাত্রীরা। এখন সেই দিন আর নেই। কর্ণফুলী নদীর বোয়ালখালী, আনোয়ারা, পতেঙ্গা, ফিশারিঘাটসহ কয়েকটি এলাকায় নৌ পারাপার এখনো কিছুটা সচল থাকলেও উজানের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও কাপ্তাই অংশের মাঝিরা পেশা পাল্টাচ্ছেন। অধিকাংশ নৌকার মাঝি পেশা পাল্টিয়ে নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এখন এসব এলাকায় খেয়া পারাপার নেই বললেই চলে। কর্ণফুলী নদী থেকে ৭০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হওয়ায় সেখানেও টিকে থাকতে পারছে না তারা। কর্ণফুলী নদীর খেয়াঘাটের মাঝিদের এখন চরম দুর্দিন চলছে। রাঙ্গুনিয়ার অর্ধ শতাধিক নদীঘাটের তিন শতাধিক মাঝি পরিবারে চলছে অভাব অনটন। ইঞ্জিনচালিত নৌকার দৌরাত্ম্য থাকায় মালামাল পরিবহনেও এখন তাঁদের ডাক পড়ে না। আগের মতো তাঁদের নৌকায় চড়ে কেউ আর নদী পারাপার হচ্ছে না। তবুও যাত্রীর আশায় কেউ কেউ নদীঘাটে অলস সময় পার করছেন।
রাঙ্গুনিয়ার কোদালা ঘাটের খেয়ামাঝি উজ্জ্বল দাস জানান, চন্দ্রঘোনা থেকে বেতাগী পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের প্রায় অর্ধ শতাধিক স্থানে নৌকায় খেয়া পারাপার হত। মাঝিরা খেয়া পারাপার করে পরিবারের খরচ জোগাতো। উৎসব পার্বণে বাড়তি আয় হত। উপজেলার রাঙ্গুনিয়া অংশের চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট, রাইখালী বাজারঘাট, ধোপাঘাট, কোদালা বাজারঘাট, কাট্টইল্ল্যা ঘাট, মরিয়মনগর ঘাট, রশিদিয়া পাড়া ঘাট, ইছামতিঘাট, ব্যুহচক্রঘাট, শিলক ফকিরাঘাট, রাস্তারমাথাঘাট, ইছাখালীঘাট, সরফভাটা মরাখালঘাট, গোডাউনঘাট, ভূমিরখীল ঘাট, গোডাউন ঘাট, কাউখালীঘাট, পাইট্ট্যালিঘাট, চিরিঙ্গা ঘাট, স’মিল ঘাট, বেতাগী গোলাম বেপারি ঘাটসহ অর্ধশতাধিক ঘাটে মাঝিমাল্লারা নৌকা ও সাম্পানে করে যাত্রী ও মালামাল পারাপার করত। তখন মাঝিরা মনোবল নিয়ে এ পেশায় নিয়োজিত ছিল। তাদের মনে ছিল আনন্দ, কণ্ঠে ছিল কোকিল কণ্ঠের সুরে রূপালি গান। পারিবারিক জীবনে ছিল অফুরন্ত স্বপ্ন ও সুখ। এখন এসব ঘাটের অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। দুয়েকটি চালু থাকলেও যাত্রী তেমন পাওয়া যায় না।
মরিয়মনগর ঘাটের মাঝি আবদুল গফুর জানান, নদীর নাব্যতা হারানোর ফলে এবং কিছু কিছু ঘাটে ইঞ্জিন চালিত বড় নৌকার মাধ্যমে যাত্রী ও মালামাল পারাপার করা হচ্ছে। অনেক স্থানে ব্রিজ হওয়ায় এখন আর তেমন নৌকার ভাড়া নেই। আয় উপার্জন আগের মতো আর হয় না। অন্যদিকে বেশির ভাগ মাঝি মহাজনদের কাছ থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে নদীতে চালাতে হয়। মালিকরা নৌকা ভাড়া আগের তুলনায় অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া এখন ঘাট মালিকদের টোল প্রদান ও মালিকের নৌকা ভাড়া প্রতিদিন পরিশোধ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। রুটি রুজির তাগিদে মাঝিরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-তুফান উপেক্ষা করে নৌকা চালিয়ে যা উপার্জন করে তার বেশির ভাগই নৌকা মালিক ও ঘাট মালিকদের পাওনা বাবদ পরিশোধ করতে হয়। এতে অবশিষ্ট আয়ের অংশ দিয়ে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য। মাঝিদের অনেকেই এ পেশায় ২৫/৩০ বছর যাবত জড়িয়ে রয়েছেন। তাদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকে এই পেশা ছাড়তে পারছেন না। আবার জীবিকার তাগিদে অনেকে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। মাঝিদের মধ্যে অনেক পরিবার ভূমিহীন। তাছাড়া এদের কোন ঋণেরও ব্যবস্থা নেই। ফলে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
কর্ণফুলীকে ঘিরে বেড়ে ওঠা শত শত সাম্পান মাঝির একজন মো. কামাল মাঝি। বয়স তাঁর ৪৫ পেরিয়েছে। কর্ণফুলীর বুকে রাঙ্গুনিয়া-কাপ্তাই অংশে সাম্পান চালিয়েই তাঁর জীবন চলে। কর্ণফুলীর তীরেই তাঁর সংসার, ভালোবাসায় বসবাস।
কামাল মাঝি গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘কর্ণফুলীর সাম্পান মাঝি আঁই…’ (কর্ণফুলীর সাম্পান মাঝি আমি)। কর্ণফুলী নদীতে সাম্পানের সেই সুসময় এখন আর নেই, নদীতে এখন আর পাল তোলা সাম্পান চলে না। সাম্পানের স্থান দখল করে নিয়েছে ইঞ্জিনচালিত বোট (নৌকা)। এই যান্ত্রিক সময়েও নিজের হাতে বৈঠা মেরে কর্ণফুলীর বুকে গৌরবের সঙ্গে সাম্পান চালিয়ে যাচ্ছেন কামাল মাঝি। বললেন, ‘আমি কর্ণফুলীর সাম্পান মাঝি হিসেবে গর্বিত। ’
১৫ বছর বয়স থেকেই কর্ণফুলীতে সাম্পান চালাচ্ছেন কামালের ভাই জামাল মাঝি। তিনি বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীই ছিল চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যের মূলকেন্দ্র। নদীপথেই বাণিজ্য হত লক্ষ কোটি টাকার। দূরদূরান্তের মানুষের যাতায়াতের মূল মাধ্যম ছিল এই নদীপথের নৌকা আর সাম্পান। নদীর বুকে কেঁ-কোঁরত কেঁ-কোঁরত দাঁড় টানার শব্দে চলত সাম্পান। দেখেছি নদীর কত চড়াই-উতরাই। কত বিপদসংকুল পরিবেশে নদীতে সাম্পান চালিয়েছি। সাম্পান ডুবিতে কয়েকবারই ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠেছি, আবার সাম্পানের বৈঠা ধরেছি। ’
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, ‘নৌকা ও সাম্পানই ছিল এই এলাকার আদি বাহন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিন নৌকা ও সড়কপথের আবেদন রয়েছে। তাই বলে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবে না। সেই নৌকা-সাম্পানগুলোর কদরও যাতে সব সময় থাকে তারও একটা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে।