হাওর বার্তা ডেস্কঃ নড়াইলে বাণিজ্যিকভাবে বেড়েছে সুপারির চাষ। ইতোমধ্যে জেলার বিভিন্ন এলাকার সুপারির হাট জমে উঠেছে। নড়াইলের স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সুপারি যাচ্ছে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের অন্তত ২০ জেলায়। এসব হাটকে সামনে রেখে জেলার প্রায় ২ হাজার মৌসুম ব্যাবসায়ী ব্যস্ত সময় পার করছেন। গত বছরের তুলনায় এ বছরে সুপারির দাম বেশি তাই বেশ খুশি স্থানীয় সুপারি চাষিরা।
নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব থেকেই সুপারি উৎপাদন হতো এ জেলায় কিন্তু তখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সুপারির চাষ হতো না। তখন শুধু জেলার বিভিন্ন বসতভিটার চারপাশে, বিভিন্ন পতিত জমিতে, ঘের অথবা পুকুর পাড়ে, রাস্তার পাশে সুপারি গাছ ছিল। সুপারির ফলন ভালো হওয়ায় ও বাজারে সুপারির দাম ভালো থাকায় জেলার চাষিরা সুপারি চাষের দিকে আগ্রহ দেখায়।
১০ বছর আগে জেলার চাষিরা সল্প পরিসরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সুপারির চাষ শুরু করে। আর এ চাষে লাভবান হওয়ায় দিন দিন সুপারি চাষ বেড়েছে। চলতি বছরে জেলায় ৬৪৫ হেক্টর জমিতে সুপারির আবাদ হয়েছে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৭৩৫ টন।
জানা গেছে, জেলায় মোট প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে সুপারি চাষ হয়। তবে কৃষি বিভাগ বলছে জেলায় সুপারি বাগান অনেক থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে ৬৪৫ হেক্টর জমিতে এ চাষ করা হয়েছে। জেলার তিন উপজেলাতেই এ চাষ ভালো হয়। তবে সদরে ও লোহাগড়া উপজেলাতে সুপারি চাষ অনেক। সাধারনত বেলে-দোঁআশ মাটিতে সুপারি চাষ ভালো হয়।
জুলাই-আগস্ট থেকে শুরু করে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সুপারির চারা লাগানো হয়। ৫ ফুট বাই ৫ ফুট দূরত্ব রেখে প্রতিটি চারা লাগাতে হয়। চারা লাগানোর ৭-৮ বছর পর থেকে ফল আসা শুরু হয়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে গাছে ফুল আসে ফুল থেকে ফল হয় এরপর আশ্বিন-কার্তিক মাসে পরিপক্ব সুপারি গাছ থেকে পাড়া হয়।
প্রতিহেক্টর জমিতে ২.৬৮ টন সুপারি উৎপাদন করা হয়। সুপারি গাছে তেমন কোন রোগ হয় না। তবে সুপারি পাকার আগে কোনো কোনো গাছে সুপারিতে পোকা লাগে। এক ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করে সেটি দমন করা যায়। একটি গাছ থেকে অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ বছর একভাবে ফল পাওয়া যায়।
নড়াইলে সাধারনত বিভিন্ন হাটে-বাজারে সুপারি বেচাকেনা হয়। তবে জেলার সবচেয়ে বড় পাইকারী হাট সদরের রূপগঞ্জ হাট এবং লোহাগড়া উপজেলার এ্যাড়েন্দা বাজার। রূপগঞ্জ বাজারে প্রতিদিনই সুপারি বেচাকেনা হয়, তবে রোববার ও বৃহস্পতিবারে বড় পাইকারী হাট বসে। এ্যাড়েন্দা বাজারে সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবারে সুপারির বড় পাইকারী হাট বসে, এহাটে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে সুপারি কিনে নিয়ে যায়।
ব্যবসায়ীরা জানান, মৌসুমে জেলায় শতাধিক হাট, বাজার ও বিভিন্ন স্থানে সুপারি বেচা কেনা হয়। চাষিদের কাছ থেকে সুপারি কিনে সাধারণত তিনটি পদ্ধতিতে সেগুলো বিক্রি করে থাকেন। কাচা সুপারি রোদে শুকিয়ে সুপারির খোসা (খোলস) ফেলে দিয়ে প্রতিকেজি শুকনা সুপারি ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি করে। পাকা সুপারি বাজার থেকে কেনে পানিতে ৩ থেকে ৪ মাস পচন দিয়ে (ভিজিয়ে) সেগুলো বাজারে বিক্রি করেন, পানিতে ভেজানো সুপারিকে স্থানীয় ভাষায় মজা সুপারি বলে, এই মজা সুপারির চাহিদা বেশি তাই দামও ভালো পাওয়া যায়।
চাষিরা জানান, অন্যান্য ফসলের তুলনায় সুপারি চাষে খরচ অনেক কম। চারা লাগানোর প্রথম ২-৩ বছর একটু কষ্ট করতে হয়। তখন ছোট চারা গরু ছাগলে খেয়ে ফেলার ভয় থাকে। প্রথম দিকে জমিতে স্বল্প পরিমাণ সারও দিতে হয়। ৫-৬ বছর পর গাছে ফল আসে। একবার ফল আসলে একাধারে অন্তত ৪০ বছর ফল পাওয়া যায়। ফল আসার পরে তেমন কোন খরচ হয় না। প্রতিটা গাছ থেকে বছরে আকারভেদে ৩শ থেকে ৫শ পিস সুপারি পাওয়া যায়।
এ্যাড়েন্দা বাজারের ব্যাবসায়ী জয়নুল আবেদিন জানান, স্থানীয়ভাবে ২০০ পিস সুপারিতে এক কুড়ি হয়। বর্তমান বাজারে প্রতিকুড়ি সুপারি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি মৌসুমে আমরা বিভিন্ন বাজার ও গ্রামের চাষিদের কাছ থেকে সুপারি কিনে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করি এতে আমাদের লাভ ভালো হয়।
লোহাগড়া উপজেলার এ্যড়েন্দা গ্রামের সুপারি চাষি নয়ন শেখ জানায়, বাপ দাদার আমল থেকেই আমাদের বাড়িতে অনেক সুপারি গাছ ছিল। প্রতিবছর আমি বসতভিটার সুপারি গাছ থেকে অনেক সুপারি বিক্রি করি। গত ৭ বছর পূর্বে এক একর ২২ শতক জমিতে সুপারি বাগান করেছি। আমার নতুন বাগানে গত বছর থেকেই কিছু কিছু গাছে ফল এসেছিল। এ বছর বাগানের প্রায় সব গাছেই ফল হয়েছে। এ বছরে আমার বাগানে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছি খরচ বাদে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা লাভ হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক শেখ আমিনুল হক বলেন, জেলার মাটি সুপারি চাষের জন্য খুব উপযোগী। সুপারি একটি লাভজনক ফসল হওয়ায় জেলার অনেক চাষিরা তাদের পতিত জমিতে সুপারির বাগান করছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে বলেও জানান কৃষি কর্মকর্তা।