হাওর বার্তা ডেস্কঃ কৃষকের হালচাষ কার্যক্রম বিলুপ্তর সঙ্গে সঙ্গে কেবল গৃহস্থদের ঘর থেকে এক প্রকার হারিয়ে যাচ্ছে গরু-মহিষের লালন পালন। একসময় গ্রামীণ সমাজে প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরেই ছিল গরু-মহিষ ও অন্যান্য প্রাণী লালন পালন। সময়ের সঙ্গে কৃষি কাজে ইঞ্জিন চালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে এখন গ্রামের অনেক সাধারণ পরিবারই এসব পশু পালন এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছে। গরু-মহিষের পাল নিয়ে চরাঞ্চলে এখন আর আগের মতো রাখালদেরও দেখা যায় না। তবে মিরসরাই উপজেলার কয়েকটি চরাঞ্চলে এখনো অনেকে গরু-মহিষ লালন পালন করছেন। উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের মহুরি প্রজেক্ট ও চরশরৎ চরে গেলে এখনো মহিষের পাল দেখা যায়।
সরেজমিনে গেলে মুহুরী প্রকল্প এলাকায় একদল মহিষের পাল নিয়ে যাচ্ছিলেন স্থানীয় কৃষক নজরুল ইসলাম। তিনি কিশোর বয়স থেকেই রাখাল হিসেবেই এলাকায় সুপরিচিত। এ সময় তিনি শতাধিক মহিষ নিয়ে যাচ্ছেন মুহুরী গেট হয়ে পার্শ্ববর্তী সোনাগাজী উপজেলার পথে। দিনভর ফেনী নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরের উপকূল মিরসরাইয়ের ইছাখালী এবং মঘাদিয়া ইউনিয়নের চরশরৎ চরে মহিষের পাল নিয়ে দিন শেষে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরছেন। স্থানীয় গৃহস্থদের শত শত গরু-মহিষ বিচরণ করে দক্ষিণ উপকূলের ম্যানগ্রোভ বাগানে। সকালে সূর্য উদয়ের সঙ্গে শত শত মহিষের পাল নিয়ে বিস্তৃত বাগানের দূর সীমানায় ছুটে চলে তারা। সন্ধ্যায় মহিষ নিয়ে নির্দিষ্ট খোঁয়াড়ে ফিরে আসে।
সব মিলিয়ে এই চরাঞ্চলে শতাধিক মালিক পক্ষের ছোট-বড় মহিষের দল মিলে ১০ হাজার মহিষ রয়েছে। এসব মহিষের জন্য নেই কোনো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। কখনো কোনো মহিষ অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই প্রিয় গবাদি প্রাণীকে সুচিকিৎসার অভাবে হারাতে হয়। এতে প্রতি মহিষে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হয় মহিষ মালিকদের। অথচ একটি মহিষের পেছনে অনেক মালিকের প্রতি মাসে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা করে বিনিয়োগও হয়ে থাকে।
ইছাখালীর জনৈক মহিষের মালিক রহিম উল্লাহ বলেন, কোনো মহিষ অসুস্থ হয়ে পড়লে সদরে গিয়ে চিকিৎসক আনাতেও অনেক সময় দু’দিন সময় নিতে হয়। প্রথম দিন খবর জানালে সুবিধা মতো ২/১ দিন পরে উনারা আসেন। আবার এই জনপদ থেকে অসুস্থ মহিষ সেখানে নেয়াও অসম্ভব। তাই বছরে ১০ থেকে ২০টি মহিষ বিভিন্নভাবে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। এতে লাখ লাখ টাকার লোকসান হয়ে যায় উদ্যোক্তাদের।
এ বিষয়ে পশু চিকিৎসা বিভাগের চট্টগ্রামের বিভাগীয় প্রধান ডা. শহিদুল ইসলাম বলেন, উপকূলীয় এলাকার মহিষের মালিকরা আমাদের কাছে তাদের সব সমস্যা উল্লেখ করে আবেদন করলে আমরা অবশ্যই সেখানে একটি স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে প্রক্রিয়াগত আবেদন করব। এর পরও আমাদের মাঠকর্মীদের সঙ্গে মহিষের মালিকরা যোগাযোগ রাখলেও আশা করছি সব সেবা পেতে পারেন।
মুহুরী প্রকল্পের স্থানীয় সচেতন ব্যক্তি রুহুল আমিন জানান, এখানে মহিষের উন্নয়নে সুষম খাবার, ভ্যাক্সিনেশন আর কৃত্রিম প্রজনন- এই তিনটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি। পৃথক চারণভূমি সৃষ্টির মাধ্যমে মহিষের পর্যাপ্ত সুষম খাবারের নিশ্চয়তা, কৃষকের সচেতনতা আর প্রজননকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে মহিষ পালনে চরাঞ্চলের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। শহরভিত্তিক শিল্প সমৃদ্ধির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে দক্ষ ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত পরিচর্যা করা গেলে চরাঞ্চলেও দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে আবাদকৃত কৃষি জমি থেকে আবাদিত আমন ফসল ঘরে তুললে ইছাখালীর বিভিন্ন চরে দাবড়ে বেড়ায় কালো-ধূসর মহিষের পাল। চরভূমিতে জš§ানো ঘাস, হাইচা, কচুরিপানাসহ হরেক রকম সবুজ পাতা এখানের মহিষের খাবার। মহিষগুলো পালে পালে খাবার খেয়ে গা ডুবায় খাল-ডোবার জলে। আবার কয়েকটি দল চলে যায় উপকূলের সমুদ্র ঘেঁষা জলাশয়ে। সেখানে পানিতে গলা সমান ডুবে থেকে জাবর কেটে কেটে দিন শেষ করে। দিনের শেষে একসঙ্গে মিশে যায় ফের একসঙ্গে।
ফসলি মৌসুমে লাঙ্গল টেনে কোনোমতে বেঁচে আছে কেবল স্থানীয় জাতের অনুন্নত কাঁচা ঘাসনির্ভর এই মহিষগুলো বিভিন্ন চরে। ত৬েব দিনে দিনে মহিষের মাংসের চাহিদা বৃদ্ধি ও দুধের দাম বেশি থাকার কারণে সম্প্রতি মহিষের জাত উন্নয়ন ও মহিষ পালনে ঝুঁকছেন কৃষকরা। তা ছাড়া মহিষের মাংসতে গরুর মাংস থেকে স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকি অনেক কম। তাই আমিশের ঘাটতি পূরণসহ দুধের অভাব পূরণে মহিষ পালনে সামগ্রিক অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা প্রয়োজন। এ ছাড়া ঝুঁকিমুক্ত মাংস ও দুধের চাহিদা মেটাতে মহিষ পালনে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। মিরসরাইয়ের উপকূলের ম্যানগ্রোভ এলাকাসহ বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে এখন প্রয়োজন সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগ।