হাওর বার্তা ডেস্কঃ তদানীন্তন গৌরাধিপতি আলাউদ্দিন হোসেন শাহীর রাজস্ব সচিব (দেওয়ান) ছিলেন কালীদাস সিংহ। তিনি প্রতিদিন সকালে ব্রাহ্মণকে সোনার নির্মিত একটি ক্ষুদ্রাকৃতির হস্তিমূর্তি প্রদান না করে অন্নজল গ্রহণ করতেন না বলে কথিত আছে। এ কারণে তার নামের সাথে ‘গজদানী’ শব্দটি সংযুক্ত হয়ে কালীদাস গজদানী নামে পরিচিত হন। কালীদাস গজদানী একদিন রাজ-দরবারে সেনাপতি কালাপাহাড়ের (কালাপাহাড়ের প্রকৃত নাম রাজচন্দ্র বা রাজেন্দ্র) সাথে ধর্ম নিয়ে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে কালাপাহাড়ের কাছে পরাস্ত হন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণপূর্বক সুলেমান খাঁ নাম ধারণ করেন।
নও মুসলিম সুলেমান খাঁ’র দুই পুত্রের মধ্যে ঈশা খাঁ ছিলেন ইতিহাস খ্যাত বীর। ষোড়শ শতাব্দীর শেষপাদে ঈশা খাঁ তার পিতৃব্য কুতুব খাঁ’র সাহায্যে পূর্ববঙ্গে এক বিস্তৃত জনপদের শাসনভার প্রাপ্ত হন। তিনি বর্তমান নারায়ণগঞ্জের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত খিজিরপুর নামক স্থানে বাসস্থান নির্মাণ করেন।
খ্রিষ্টিয় ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলায় যে ক’জন ভূম্যাধিকারী মুঘল রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন নৃপতি হওয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন ইতিহাসে তারা ‘বার ভূঞা’ নামে খ্যাত। বার ভূঞার মধ্যে খিজিরপুরের ঈশা খাঁ ছিলেন সর্বোচ্চ পরাক্রমশালী এবং তিনিই বার ভূঞার অধিনায়ক ছিলেন। ঈশা খাঁ ক্রমে সরকার বাজুহা ও সরকার সোনারগাঁয়ের শাসনভারও প্রাপ্ত হন। বঙ্গদেশের শেরপুর-দশকাহনিয়া, এগারসিন্দুর, একছালা, ত্রিবেণী, খিজিরপুর, হাজীগঞ্জ, কলাগাছিয়া, কর্তাভু, বক্তারপুর, চরসিন্দুর, মহেশ্বরদী, কাটরাব প্রভৃতি স্থানে ঈশা খাঁ তার শাসন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন।
মুঘল রাজশক্তির বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে ঈশা খাঁকে বেশ কয়েকবার মুঘল সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। এ সকল যুদ্ধে তিনি পশ্চাদাপসরণ করে কিছুদিন পর অধিকতর শক্তি সঞ্চয়পূর্বক হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। মুঘলের বিরুদ্ধে ঈশা খাঁ’র অনেক যুদ্ধের মধ্যে এগারসিন্দুরের যুদ্ধটিই ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত যুদ্ধ হিসাবে পরিগণিত। ষোড়শ শতাব্দীতে ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁকে অবস্থিত এগারসিন্দুর এলাকাটি উল্লেখযোগ্য নৌবন্দর ও বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে।
মুঘল রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহী বীর, স্বাধীনচেতা অকুতোভয় সিংহপুরুষ ঈশা খাঁ’র স্মৃতিধন্য কিশোরগঞ্জ জেলার দুই ঐতিহাসিক স্থান জঙ্গলবাড়ি ও এগারসিন্দুর সম্পর্কে এ পর্যায়ে আলোকপাতের প্রয়াস নেয়া হ’ল:
জঙ্গলবাড়ি: ঈশা খাঁ’র দ্বিতীয় রাজধানী
কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে আনুমানিক ৬ কি.মি. পূর্বে জঙ্গলবাড়ির অবস্থান। এখানে কোচ বংশীয় সামন্ত রাজা লক্ষ্মণ হাজরা রাজত্ব করতেন। ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী নরসুন্দার কূল ঘেঁষে অবস্থিত জঙ্গলাকীর্ণ এই স্থানটি নানা দিক থেকেই নিরাপদ স্থান হিসাবে বিবেচিত হতো। রাজবাড়ির চতুর্দিকে খননকৃত পরিখা (স্থানীয় ভাষায় আড়া) লক্ষ্মণ হাজরার প্রাসাদকে বহিঃশক্রর আক্রমণ থেকে অনেকটাই নিরাপদ রেখেছে। এই সামন্তরাজের অধিকৃত স্থানটি ‘হাজরাদি পরগনা’ নামে সুপরিচিত ছিল।
বার ভূঞার অধিনায়ক বীর ঈশা খাঁ মুঘল সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে রাজধানী খিজিরপুর পরিত্যাগপূর্বক ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁয়ে রাজধানী স্থাপন করেন। অতঃপর তিনি মুঘল সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নতুন উদ্যমে শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করেন। ইত্যবসরে মুঘল সুবাদারকে বারবার পরাস্ত করায় ঈশা খাঁ’র শৌর্য-বীর্যের প্রসিদ্ধি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ভাওয়ালের ফজল গাজী, বিক্রমপুরের চাঁদরায়, ভুলুয়ার লক্ষ্মণ মানিক, চন্দ্রদ্বীপের কন্দর্প নারায়ণ প্রমুখ ঈশা খাঁ’র সাথে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হন। এদিকে উরিষ্যা এবং বঙ্গের বিদ্রোহী পাঠান জায়গীরদারগণ মুঘল সৈন্যের কাছে পরাস্ত হয়ে দলে দলে ঈশা খাঁ’র সাথে মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তোলেন। ঈশা খাঁ কামরূপ রাজ্যের রাঙ্গামাটি (বর্তমানে ধুবড়ি) অধিকার করে বীরদর্পে জঙ্গলবাড়ির দিকে এগিয়ে আসেন। জঙ্গলবাড়ির রাজা লক্ষ্মণ হাজরার বিরুদ্ধে প্রজা নিপীড়নের অভিযোগ থাকায় ঈশা খাঁ দূত মারফত লক্ষ্মণ হাজরাকে বিনাযুদ্ধে জঙ্গলবাড়ি পরিত্যাগের নির্দেশ পাঠান। কিন্তু লক্ষ্মণ হাজরা এতে কর্ণপাত করেননি। ফলে ঈশা খাঁ ক্ষিপ্ত হয়ে অতর্কিতে জঙ্গলবাড়ির প্রাসাদ আক্রমণ করেন। রাজা লক্ষ্মণ হাজরা ঈশা খাঁ’র সৈন্যের বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন এবং প্রাণ নিয়ে প্রাসাদ ত্যাগ করে পলায়ন করেন। জঙ্গলবাড়ির প্রাসাদ অধিকার করে ঈশা খাঁ প্রাসাদের নিরাপত্তা বেষ্টনি ও ভৌগলিক অবস্থান দেখে এতোই আকৃষ্ট হন যে, তিনি অতঃপর জঙ্গলবাড়িতে তার দ্বিতীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। জঙ্গলবাড়ি হয়ে ওঠে বীর ঈশা খাঁ’র অধিকৃত এক নান্দনিক স্থান।
ঈশা খাঁ’র স্মৃতি বিজড়িত জঙ্গলবাড়ি কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর অন্যতম একটি। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ঈশা খাঁ’র বংশধরদের দ্বারা এখানে একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মিত হয়। মুঘল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদটির চারকোণে চারটি সুদৃশ্য মিনার বা টারেট রয়েছে। ঐতিহাসিক জঙ্গলবাড়িতে প্রাচীনত্বের নিদর্শন হিসাবে কালের সাক্ষী হয়ে এই মসজিদটি আজও টিকে আছে। তবে মসজিদের দেয়ালে সংস্কার-কাজ করায় সেই প্রাচীন আমেজ অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। জঙ্গলবাড়ির প্রাসাদের চতুর্দিকে খননকৃত সেই পরিখার (আড়া) চিহ্ন আজও লক্ষ করা যায়।
এগারসিন্দুর; ঈশা খাঁ’র বীরত্বখচিত ঐতিহাসিক দূর্গ:
ষোড়শ শতাব্দীতে এগারসিন্দুর বিখ্যাত নৌ-বন্দর হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁকে অবস্থিত পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দুর স্থানটি নদীবন্দরের সুবাদে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল। দেশ-দেশান্তর হতে বড় বড় বাণিজ্যতরী এই বন্দরে নিয়মিত নোঙর করতো। আমীর-ওমরাহ আর বণিকগণের প্রাসাদোপম আবাস ভবনের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে এগারসিন্দুর তৎসময়েও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। মুঘল বিদ্রোহী ঈশা খাঁ এগারসিন্দুরে তার দুর্গ স্থাপন করে তিন দিক থেকে জলপথকে নিয়ন্ত্রিত ও সুরাক্ষিত করেছিলেন। ঈশা খাঁ তার এই দূর্গকে বহিঃশত্র“র আক্রমন থেকে রক্ষার জন্য দূর্গের চতুর্দিকে পরিখা খননসহ সুদৃশ্য প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন। দূর্গের চারপাশে স্থাপন করেছিলেন ব্যাঘ্র-মুখ কামান।
১৫৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল রাজপুত মানসিংহ বঙ্গবিহারের সুবেদার পদ প্রাপ্ত হয়ে বিহার, উরিষ্যা ও বঙ্গদেশের বিদ্রোহ দমনে ব্রতী হন। ১৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মানসিংহ ঈশা খাঁ’র রাজধানী সোনারগাঁও আক্রমন ও অধিকার করেন। সোনারগাঁয়ের পতন-সংবাদে ঈশা খাঁ পশ্চাদাপসরণ করে এগারসিন্দুর দূর্গে চলে আসেন। ইতোমধ্যে মানসিংহ তার সৈন্যদল নিয়ে লক্ষ্যা নদীর উজানপথে যাত্রা করে বানার নদীর বাম তীরে তোটকে (বর্তমানে টোক) শিবির স্থাপন করেন। এ অবস্থায় ঈশা খাঁ মানসিংহের কাছে দূত মারফত এ মর্মে বার্তা প্রেরণ করনে যে, উভয় পক্ষের যুদ্ধ হলে হাজার হাজার সৈন্যের মৃত্যু অবধারিত। সুতরাং সাধারণ সৈন্যদের যুদ্ধে লিপ্ত না করে তিনি স্বয়ং মানসিংহকে তার সঙ্গে সরাসরি মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানান। মানসিংহ ঈশা খাঁ’র এই আহ্বানে সাড়া দিলেন এবং পরদিন যুদ্ধক্ষেত্রে জামাতা দুর্জয় সিংকে (মতান্তরে দুর্জন সিং) প্রেরণ করলেন। দুর্জয় সিং ঈশা খাঁ’র সাথে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরাভূত ও নিহত হন। জামাতার মৃত্যু-সংবাদে ক্ষুব্ধ মানসিংহ অতঃপর নিজে ঈশা খাঁ’র সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন। পরপর তিনদিন উভয়ের মধ্যে উদায়স্ত যুদ্ধ হ’ল। তৃতীয় দিন যুদ্ধরত অবস্থায় ঈশা খাঁ’র তরবারীর আঘাতে রাজপুত মানসিংহের তরবারী দ্বি-খণ্ডিত হয়ে গেল। নিরস্ত্র মানসিংহ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু তাকে বিস্মিত করে বীর ঈশা খাঁ নিজের খাপ হতে মানসিংহের হাতে তরবারী তুলে দিয়ে বললেন, ‘নিরস্ত্র শত্র“র সাথে আমি যুদ্ধ করি না; এবার এই তরবারী দ্বারা পুনরায় যুদ্ধ শুরু করুন’।
ঈশা খাঁ’র এরূপ সৌজন্য ও বীরত্ব দেখে মানসিংহ অভিভূত ও বিস্মিত হলেন এবং যুদ্ধের পরিবর্তে ঈশা খাঁ’র সাথে বন্ধুত্বের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন। অতঃপর মানসিংহ সসম্মানে বীর ঈশা খাঁকে সম্রাট আকবরের দরবারে নিয়ে এলেন। পরাক্রমশালী মুঘল সম্রাট আকবর সব বর্ণনা শুনে ঈশা খাঁকে তার দক্ষিণ পাশে পৃথক মসনদে উপবেশন করার অনুমতি দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করলেন। অতঃপর সম্রাট আকবর ঈশা খাঁকে ‘মসনদে আলী’ ও ‘বার্জুবানে বাঙ্গালা’ উপাধি দিয়ে বার্ষিক ৩৬,০০০ টাকা আয়ের নিষ্কর ভূ-সম্পত্তির জায়গীর ও ২২টি পরগনার শাসনভার প্রদান করেন। অবশ্য ঈশা খা’র ‘মসনদে আলী’ উপাধি প্রাপ্তির বিষয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। ভিন্নমত অনুযায়ী ত্রিপুরার রাজা তাকে ‘মসনদ আলী’ উপাধি দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে।
আজীবন স্বাধীনচেতা বীরকেশরী ঈশা খাঁ তার প্রথম স্ত্রী ফাতেমা খাতুনের গর্ভজাত মুসা খাঁ ও মোহাম্মদ খাঁ নামক দুই পুত্র এবং নিঃসন্তান দ্বিতীয় স্ত্রী অলি-নিয়ামৎ খানম (সোনামণি)কে রেখে ১৫৯৮ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা জেলার মহেশ্বরদী পরগণার বক্তারপুর নামক স্থানে তাঁর সমাধি রয়েছে।
ঈশা খাঁ’র মৃত্যুর পর এগারসিন্দুরের ঐতিহাসিক গৌরব লুপ্ত হতে শুরু করে। কথিত আছে, সম্রাট শাহ্জাহানের রাজত্বকালে আসামের রাজা ৫শত রণতরী নিয়ে জলপথে ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী বিভিন্ন নগর ও বাজারে লুট করতে করতে এগারসিন্দুরে আসেন এবং এই বন্দরে লুটপাট শেষে বন্দরটি বিনষ্ট করেন।
এগারসিন্দুরে আজও সেই ঐতিহ্যময় ইতিহাসের নির্দশন লক্ষ করা যায়। বড় বড় দিঘি, সমাধি, মসজিদ ও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এখানে দৃষ্টিগোচর হয়। এছাড়া নিরগীন শাহ্, শাহ্ গরীবুল্লাহ ও কয়েকজন অজ্ঞাত লোকের পাকা সমাধি ও দু’টি প্রাচীন মসজিদ আজও অক্ষুন্ন আছে। এগারসিন্দুরে অবস্থিত শাহ্ মাহমুদের মসজিদ, ভিটা ও বালাখানা আজও আগ্রহী পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মধ্যযুগীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার নিয়ে অহঙ্কারের ঋজুতায় মাথা তুলে আজও দাঁড়িয়ে আছে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক জঙ্গলবাড়ি ও এগারসিন্দুর।