ঢাকা ০৬:২৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরে, উত্তরবঙ্গে তাঁরা কেমন আছেন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:৩২:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ অক্টোবর ২০১৭
  • ৩২৫ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমার এক বন্ধু প্রায় তিন দশক ধরে ইউরোপের এক সচ্ছল দেশে সপরিবারে বাস করে। মাঝেমধ্যেই দেশে বেড়াতে আসে, তবে গ্রামে খুব একটা যায় না। এবার এসে গ্রামে গিয়েছিল। টেলিফোনে আমাকে বলল, ‘বাংলাদেশ নাকি অনেক আগায়ে গেছে, কিন্তু গ্রামের মানুষ এত গরিব ক্যান?’
আমি বললাম, ‘তুই গরিবির কী দেখলি? গ্রামের মানুষ কি অনাহারে আছে? তাদের পরনে কি কাপড় নাই? গ্রামের বাচ্চারা কি খালি পায়ে ঘুরে বেড়ায়?’
এই সব জিজ্ঞাসাকে আমি যে গরিবির চিহ্ন বা দারিদ্র্যের সূচকরূপে উপস্থাপন করলাম, তা শুনে আমার প্রবাসী বন্ধুটি বিস্ময় প্রকাশ করল: ‘এই একুশ শতকে আইস্যাও এই তোর বিবেচনা? শুধু খাইতে পাওয়া আর উলঙ্গ না থাকার মানেই দেশের আগায়ে যাওয়া? এইটারে মানুষের জীবন কয়?’
বন্ধুর বাড়ি নেত্রকোনা। গত এপ্রিলে অকালে অতিবৃষ্টি ও আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে যে পাঁচ জেলার হাওরের বোরো ফসল নষ্ট হয়েছে, নেত্রকোনা সেগুলোর একটা। সে জেলার ৬৬ হাজার ৩৮০ হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। এটা পুরো জেলায় মোট আবাদকৃত জমির ৬০ শতাংশ। খালিয়াজুড়ি উপজেলার সব হাওরের সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারি হিসাবে গোটা জেলায় ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৮০ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই বিপর্যয় ঘটেছে পাঁচ মাস আগে, তারপর থেকে সেখানকার দরিদ্র মানুষেরা কেমন আছেন, বিশেষত তাঁদের শিশুরা কী খেয়ে বেঁচে আছে, সে বিষয়ে খোঁজ নিতে আমাদের নেত্রকোনা প্রতিনিধিকে ফোন করেছিলাম। তিনি বললেন, ওই অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের অবস্থা শোচনীয়, তাঁরা অনাহারে-অর্ধাহারে কোনো রকমে বেঁচে আছেন। কাজকর্ম নেই, বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবারের পুরুষেরা ঢাকা বা অন্য কোনো শহরে কাজের সন্ধানে চলে গেছেন। অনেক পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের উপস্থিতি অনেক কমে গেছে। শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে।
আমার ইউরোপবাসী বন্ধুটি নেত্রকোনার গ্রামাঞ্চলে গিয়ে মানুষের এই দুর্দশা দেখেই মর্মাহত হয়েছে, সে এটাকে মানুষের জীবন বলে মেনে নিতে পারেনি। তাই বাংলাদেশের ‘এগিয়ে যাওয়া’ তার কাছে নির্মম পরিহাস বলে মনে হয়েছে। এই চিত্র শুধু নেত্রকোনার নয়, এপ্রিলে আমি সুনামগঞ্জে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে এসেছি মানুষের দুর্দশা। ওই জেলার বোরো ফসলের সম্পূর্ণটাই নষ্ট হয়ে গেছে। হাওরাঞ্চলে বছরে একবারই ধান ফলে, সেই ধানের পুরোটাই অতিবৃষ্টি আর ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। সেই যে ফসলহারা মানুষের হাহাকার শুরু হয়েছে, দীর্ঘ পাঁচ মাস পরও তা থামেনি। থামার কথা নয়; কারণ, ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া হাওরে এখনো পানি আছে, সেখানে নতুন করে ফসল বুনতে আরও এক মাস অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে দরিদ্র মানুষের দুঃখ-কষ্ট আরও বেড়েছে। তাঁরা হাওরের পানিতে মাছ ধরার অধিকার চেয়েছিলেন, সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন হাওরের বিলগুলো যেন ইজারা দেওয়া না হয়। কিন্তু তাঁদের আবেদন কাজে আসেনি। তাঁরা হাওরের সবখানে মাছ ধরতে পারছেন না। ইজারাদারদের লোকেরা বরাবরের মতোই তাঁদের বাধা দিচ্ছে। আমাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধিও টেলিফোনে আমাকে জানালেন, হাওরতীরের অনেক গ্রামের অনেক পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কাজের সন্ধানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে গেছেন। নেত্রকোনার মতো সুনামগঞ্জেরও অনেক দরিদ্র পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে বস্তিবাসী হয়েছে।
হাওরাঞ্চলের ফসলহানির শিকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার অবসান না হতেই জুন-জুলাইয়ে এল বিরাট আকারের বন্যা। ৩৩টি জেলার আমন ফসল নষ্ট হলো। নানা মাত্রার ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলো মোট ৭৫ লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে অন্তত তিন লাখ মানুষ ঘরবাড়িসুদ্ধ সমস্ত কিছু হারিয়ে একদম নিঃস্ব হয়ে গেল। সরকারের ত্রাণ তৎপরতা শুরু হলো, কিন্তু মাঠপর্যায়ে সেই তৎপরতা ভালো ছিল না। ত্রাণ চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে প্রচুর। অনেক দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত নারী আমাকে বলেছেন, তাঁরা কিছুই পাননি। কেউ কেউ অভিশাপ দিয়েছেন: যারা গরিবের হক মেরে খাচ্ছে, তাদের ওপর যেন আল্লাহর গজব পড়ে। আমি বগুড়ার সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি উপজেলার কিছু বন্যাদুর্গত গ্রামে মানুষের মুখে এসব অভিযোগ শুনতে পেয়েছি। গাইবান্ধা জেলায় ব্রহ্মপুত্রের পুব পাড়ে খাটিয়ামারির চরাঞ্চলের বিপুলসংখ্যক বন্যাদুর্গত মানুষ কোনো ত্রাণ সাহায্যই পাননি বলে অনেকের মুখে অভিযোগ শুনেছি। সরকার বেশ ঘটা করে ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, খাবারের অভাবে একজন মানুষও কষ্ট পাবে না। কিন্তু কত মানুষ যে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছিল, সেই খবর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নেননি। তাঁদের খাতা-কলমে হিসাব ছিল পাক্কা: এত এত টন চাল বিতরণ করা হয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু যেসব দুর্গত মানুষ প্রাপ্য পরিমাণে পাননি, তাঁদের হক যে মেরে খাওয়া হয়েছে, সেই খবর কেউ রাখেনি।
এখন তাঁরা কেমন আছেন? সর্বগ্রাসী বন্যার আঘাতে বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গের গরিব মানুষেরা? আমাদের রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও বগুড়া জেলার প্রতিনিধির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে জানা গেল, উত্তরবঙ্গে কার্তিক মাসের আগমন নতুন করে টের পাওয়া যাচ্ছে। আগে কার্তিক মাসে মঙ্গা হতো, এখন আর হয় না। কিন্তু এ বছর বন্যার কারণে সেই দুর্দশা অনেকটাই ফিরে এসেছে। গাইবান্ধার প্রতিনিধি বললেন, এলাকায় কোনো কাজকর্ম নেই, গ্রামগুলোর অধিকাংশ পুরুষমানুষ কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে গেছেন। প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য এত প্রকট যে তাঁদের অনাহার দশা চলছে। সরকারের ত্রাণ তৎপরতা শেষ হয়ে গেছে। ঈদুল আজহার পর থেকে আর কোনো দুর্গত মানুষ সরকারি সাহায্য পাচ্ছেন না। স্বল্পমূল্যে যে চাল বিক্রি করা হচ্ছে, তা শুধু শহরাঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেই চাল কেনার টাকাও অধিকাংশ গরিব মানুষের কাছে নেই। স্বল্প মূল্যে, অর্থাৎ ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির কর্মসূচির বেশি প্রয়োজন ছিল প্রত্যন্ত চর বা গ্রামাঞ্চলে; কারণ, সেখানকার গরিব মানুষের নৌকা কিংবা অন্য কোনো যানবাহনের পেছনে টাকা খরচ করে চাল কেনার জন্য শহরে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য চরাঞ্চলের যেসব দরিদ্র শিশুকে নদী পারাপার করতে হয়, তাদের অধিকাংশেরই স্কুলে যাওয়া বন্ধ আছে। শিশুদের কষ্ট বেশি, তারা পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না। প্রধানত নুন-ভাত খেয়ে তারা দিনাতিপাত করছে। তাদের মায়েদের অবস্থাও ভালো নয়। এবারের বন্যার কারণে আমাদের শিশু ও নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতির নিঃসন্দেহে অনেক অবনতি ঘটবে।
সরকারের পক্ষ থেকে বন্যাদুর্গত মানুষকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, নতুন ফসল না ওঠা পর্যন্ত সরকার তাঁদের পাশে থাকবে। কিন্তু সরকার এই আশ্বাস পূরণ করেনি। বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে সরকার নেই। বন্যার সময় বেসরকারি উদ্যোগে যেসব ত্রাণ কার্যক্রম চলেছে, সেগুলোও স্বভাবতই শেষ হয়ে গেছে। বিপুলসংখ্যক দুর্গত, দুস্থ, গরিব মানুষের পাশে এখন আসলে কেউ নেই। শুধু তা-ই নয়, আমরা তাঁদের কথা ভুলে গেছি। সংবাদমাধ্যমে তাঁদের খবর আর পাওয়া যায় না, তাঁরা এখন আর খবরের বিষয় নন। এখন আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আরেক জনগোষ্ঠীর দুর্দশা নিয়ে: এক মাসের বেশি সময় ধরে আমাদের সংবাদমাধ্যম প্রায় সম্পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করে আছে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের দিকে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বর্বর নিধনযজ্ঞ, প্রাণভয়ে তাদের পালিয়ে আসা, এখানে আসার পর তাদের মানবেতর জীবন—এসব অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু তাই বলে হাওর ও উত্তরাঞ্চলের বন্যাদুর্গত বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের কথা আমরা পুরোপুরি ভুলে যাব, আমাদের কাছে তাদের আর কোনো সংবাদমূল্যই থাকবে না—এমন সংবেদনহীনতা সত্যিই দুঃখজনক। বিশেষভাবে দুঃখজনক এই যে খোদ সরকার তাঁদের কথা ভুলে গেছে, ভুলে গেছে তাঁদেরকে দেওয়া আশ্বাসের কথা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হাওরে, উত্তরবঙ্গে তাঁরা কেমন আছেন

আপডেট টাইম : ০৫:৩২:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ অক্টোবর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমার এক বন্ধু প্রায় তিন দশক ধরে ইউরোপের এক সচ্ছল দেশে সপরিবারে বাস করে। মাঝেমধ্যেই দেশে বেড়াতে আসে, তবে গ্রামে খুব একটা যায় না। এবার এসে গ্রামে গিয়েছিল। টেলিফোনে আমাকে বলল, ‘বাংলাদেশ নাকি অনেক আগায়ে গেছে, কিন্তু গ্রামের মানুষ এত গরিব ক্যান?’
আমি বললাম, ‘তুই গরিবির কী দেখলি? গ্রামের মানুষ কি অনাহারে আছে? তাদের পরনে কি কাপড় নাই? গ্রামের বাচ্চারা কি খালি পায়ে ঘুরে বেড়ায়?’
এই সব জিজ্ঞাসাকে আমি যে গরিবির চিহ্ন বা দারিদ্র্যের সূচকরূপে উপস্থাপন করলাম, তা শুনে আমার প্রবাসী বন্ধুটি বিস্ময় প্রকাশ করল: ‘এই একুশ শতকে আইস্যাও এই তোর বিবেচনা? শুধু খাইতে পাওয়া আর উলঙ্গ না থাকার মানেই দেশের আগায়ে যাওয়া? এইটারে মানুষের জীবন কয়?’
বন্ধুর বাড়ি নেত্রকোনা। গত এপ্রিলে অকালে অতিবৃষ্টি ও আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে যে পাঁচ জেলার হাওরের বোরো ফসল নষ্ট হয়েছে, নেত্রকোনা সেগুলোর একটা। সে জেলার ৬৬ হাজার ৩৮০ হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। এটা পুরো জেলায় মোট আবাদকৃত জমির ৬০ শতাংশ। খালিয়াজুড়ি উপজেলার সব হাওরের সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারি হিসাবে গোটা জেলায় ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৮০ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই বিপর্যয় ঘটেছে পাঁচ মাস আগে, তারপর থেকে সেখানকার দরিদ্র মানুষেরা কেমন আছেন, বিশেষত তাঁদের শিশুরা কী খেয়ে বেঁচে আছে, সে বিষয়ে খোঁজ নিতে আমাদের নেত্রকোনা প্রতিনিধিকে ফোন করেছিলাম। তিনি বললেন, ওই অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের অবস্থা শোচনীয়, তাঁরা অনাহারে-অর্ধাহারে কোনো রকমে বেঁচে আছেন। কাজকর্ম নেই, বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবারের পুরুষেরা ঢাকা বা অন্য কোনো শহরে কাজের সন্ধানে চলে গেছেন। অনেক পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের উপস্থিতি অনেক কমে গেছে। শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে।
আমার ইউরোপবাসী বন্ধুটি নেত্রকোনার গ্রামাঞ্চলে গিয়ে মানুষের এই দুর্দশা দেখেই মর্মাহত হয়েছে, সে এটাকে মানুষের জীবন বলে মেনে নিতে পারেনি। তাই বাংলাদেশের ‘এগিয়ে যাওয়া’ তার কাছে নির্মম পরিহাস বলে মনে হয়েছে। এই চিত্র শুধু নেত্রকোনার নয়, এপ্রিলে আমি সুনামগঞ্জে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে এসেছি মানুষের দুর্দশা। ওই জেলার বোরো ফসলের সম্পূর্ণটাই নষ্ট হয়ে গেছে। হাওরাঞ্চলে বছরে একবারই ধান ফলে, সেই ধানের পুরোটাই অতিবৃষ্টি আর ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। সেই যে ফসলহারা মানুষের হাহাকার শুরু হয়েছে, দীর্ঘ পাঁচ মাস পরও তা থামেনি। থামার কথা নয়; কারণ, ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া হাওরে এখনো পানি আছে, সেখানে নতুন করে ফসল বুনতে আরও এক মাস অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে দরিদ্র মানুষের দুঃখ-কষ্ট আরও বেড়েছে। তাঁরা হাওরের পানিতে মাছ ধরার অধিকার চেয়েছিলেন, সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন হাওরের বিলগুলো যেন ইজারা দেওয়া না হয়। কিন্তু তাঁদের আবেদন কাজে আসেনি। তাঁরা হাওরের সবখানে মাছ ধরতে পারছেন না। ইজারাদারদের লোকেরা বরাবরের মতোই তাঁদের বাধা দিচ্ছে। আমাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধিও টেলিফোনে আমাকে জানালেন, হাওরতীরের অনেক গ্রামের অনেক পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কাজের সন্ধানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে গেছেন। নেত্রকোনার মতো সুনামগঞ্জেরও অনেক দরিদ্র পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে বস্তিবাসী হয়েছে।
হাওরাঞ্চলের ফসলহানির শিকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার অবসান না হতেই জুন-জুলাইয়ে এল বিরাট আকারের বন্যা। ৩৩টি জেলার আমন ফসল নষ্ট হলো। নানা মাত্রার ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলো মোট ৭৫ লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে অন্তত তিন লাখ মানুষ ঘরবাড়িসুদ্ধ সমস্ত কিছু হারিয়ে একদম নিঃস্ব হয়ে গেল। সরকারের ত্রাণ তৎপরতা শুরু হলো, কিন্তু মাঠপর্যায়ে সেই তৎপরতা ভালো ছিল না। ত্রাণ চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে প্রচুর। অনেক দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত নারী আমাকে বলেছেন, তাঁরা কিছুই পাননি। কেউ কেউ অভিশাপ দিয়েছেন: যারা গরিবের হক মেরে খাচ্ছে, তাদের ওপর যেন আল্লাহর গজব পড়ে। আমি বগুড়ার সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি উপজেলার কিছু বন্যাদুর্গত গ্রামে মানুষের মুখে এসব অভিযোগ শুনতে পেয়েছি। গাইবান্ধা জেলায় ব্রহ্মপুত্রের পুব পাড়ে খাটিয়ামারির চরাঞ্চলের বিপুলসংখ্যক বন্যাদুর্গত মানুষ কোনো ত্রাণ সাহায্যই পাননি বলে অনেকের মুখে অভিযোগ শুনেছি। সরকার বেশ ঘটা করে ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, খাবারের অভাবে একজন মানুষও কষ্ট পাবে না। কিন্তু কত মানুষ যে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছিল, সেই খবর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নেননি। তাঁদের খাতা-কলমে হিসাব ছিল পাক্কা: এত এত টন চাল বিতরণ করা হয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু যেসব দুর্গত মানুষ প্রাপ্য পরিমাণে পাননি, তাঁদের হক যে মেরে খাওয়া হয়েছে, সেই খবর কেউ রাখেনি।
এখন তাঁরা কেমন আছেন? সর্বগ্রাসী বন্যার আঘাতে বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গের গরিব মানুষেরা? আমাদের রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও বগুড়া জেলার প্রতিনিধির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে জানা গেল, উত্তরবঙ্গে কার্তিক মাসের আগমন নতুন করে টের পাওয়া যাচ্ছে। আগে কার্তিক মাসে মঙ্গা হতো, এখন আর হয় না। কিন্তু এ বছর বন্যার কারণে সেই দুর্দশা অনেকটাই ফিরে এসেছে। গাইবান্ধার প্রতিনিধি বললেন, এলাকায় কোনো কাজকর্ম নেই, গ্রামগুলোর অধিকাংশ পুরুষমানুষ কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে গেছেন। প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য এত প্রকট যে তাঁদের অনাহার দশা চলছে। সরকারের ত্রাণ তৎপরতা শেষ হয়ে গেছে। ঈদুল আজহার পর থেকে আর কোনো দুর্গত মানুষ সরকারি সাহায্য পাচ্ছেন না। স্বল্পমূল্যে যে চাল বিক্রি করা হচ্ছে, তা শুধু শহরাঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেই চাল কেনার টাকাও অধিকাংশ গরিব মানুষের কাছে নেই। স্বল্প মূল্যে, অর্থাৎ ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির কর্মসূচির বেশি প্রয়োজন ছিল প্রত্যন্ত চর বা গ্রামাঞ্চলে; কারণ, সেখানকার গরিব মানুষের নৌকা কিংবা অন্য কোনো যানবাহনের পেছনে টাকা খরচ করে চাল কেনার জন্য শহরে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য চরাঞ্চলের যেসব দরিদ্র শিশুকে নদী পারাপার করতে হয়, তাদের অধিকাংশেরই স্কুলে যাওয়া বন্ধ আছে। শিশুদের কষ্ট বেশি, তারা পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না। প্রধানত নুন-ভাত খেয়ে তারা দিনাতিপাত করছে। তাদের মায়েদের অবস্থাও ভালো নয়। এবারের বন্যার কারণে আমাদের শিশু ও নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতির নিঃসন্দেহে অনেক অবনতি ঘটবে।
সরকারের পক্ষ থেকে বন্যাদুর্গত মানুষকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, নতুন ফসল না ওঠা পর্যন্ত সরকার তাঁদের পাশে থাকবে। কিন্তু সরকার এই আশ্বাস পূরণ করেনি। বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে সরকার নেই। বন্যার সময় বেসরকারি উদ্যোগে যেসব ত্রাণ কার্যক্রম চলেছে, সেগুলোও স্বভাবতই শেষ হয়ে গেছে। বিপুলসংখ্যক দুর্গত, দুস্থ, গরিব মানুষের পাশে এখন আসলে কেউ নেই। শুধু তা-ই নয়, আমরা তাঁদের কথা ভুলে গেছি। সংবাদমাধ্যমে তাঁদের খবর আর পাওয়া যায় না, তাঁরা এখন আর খবরের বিষয় নন। এখন আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আরেক জনগোষ্ঠীর দুর্দশা নিয়ে: এক মাসের বেশি সময় ধরে আমাদের সংবাদমাধ্যম প্রায় সম্পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করে আছে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের দিকে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বর্বর নিধনযজ্ঞ, প্রাণভয়ে তাদের পালিয়ে আসা, এখানে আসার পর তাদের মানবেতর জীবন—এসব অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু তাই বলে হাওর ও উত্তরাঞ্চলের বন্যাদুর্গত বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের কথা আমরা পুরোপুরি ভুলে যাব, আমাদের কাছে তাদের আর কোনো সংবাদমূল্যই থাকবে না—এমন সংবেদনহীনতা সত্যিই দুঃখজনক। বিশেষভাবে দুঃখজনক এই যে খোদ সরকার তাঁদের কথা ভুলে গেছে, ভুলে গেছে তাঁদেরকে দেওয়া আশ্বাসের কথা।