হাওর বার্তা ডেস্কঃ সর্বনাইশ্যা বান আঙ্গরে সবকিছুই কাইড়া নিছে, খায়ে গ্যাছে ব্যাবাক ধান। এহন আঙ্গরে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়্যা না খায়েই থাহন নাগবো”- দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন কৃষক শাহজাহান আলী (৬৫)। বন্যায় তার প্রায় দুই বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। একই অবস্থা এখন জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার অধিকাংশ কৃষকেরই।
সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের বালিয়ামেন্দা গ্রামের কৃষক শাহজাহান আলী জানান, চলতি মওসুমে দুই দফা বন্যায় তার ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে প্রায় তিন বিঘা জমির রোপা আমন। তার ভাষায়, “ধার-দেনা কইর্যা আবাদ করছিলাম, বানে ব্যাবাক ধান নষ্ট হইয়্যা গলায় ফাঁস পড়ছে। সামনের দিন গুল্লে কিবায় যে যাবো, তা আল্লাই ভালা জানেন। ” ওই ইউনিয়নের ডাকাতিয়া মেন্দা গ্রামের আব্দুল আজিজ, সোবহান আলী, রসপাল গ্রামের ফরিদুল ইসলাম, বাদল মিয়াসহ অনেক কৃষকই জানান, চলতি বন্যায় যে পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হয়েছে, বিগত দুই যুগেও কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সরিষাবাড়ীতে এমন ক্ষতি হয়নি। বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে উপজেলার অধিকাংশ রোপা আমন। এ ছাড়া বীজতলা, পাট, সবজিসহ অন্যান্য ফসলও নষ্ট হয়ে গেছে।
কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান জানান, সরিষাবাড়ী পৌরসভাসহ উপজেলার আটটি ইউনিয়নেই বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে ৪৮৮৫ হেক্টর রোপা আমন, ১২৫ হেক্টর বীজতলা ও ৪২৫ হেক্টর সবজি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। অপরদিকে, বাণিজ্যিক পুকুর ও জলমহাল প্লাবিত হয়ে প্রায় দুই কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে বলে উপজেলা মৎস্য দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।
সরেজমিনে জানা গেছে, এ বছর সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা, পোগলদিঘা, সাতপোয়া ও ভাটারা ইউনিয়নের সবগুলো গ্রামসহ আটটি ইউনিয়নের ২২২টি গ্রাম অধিকাংশ বন্যাকবলিত হয়েছে। পৌর শহরের আরামনগর, শিমলা বাজার, সাতপোয়া ও ধানাটা গ্রাম পুরোটাই জলমগ্ন হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাস টার্নিমাল ডুবে বাসসহ সব ধরনের দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। জামালপুর-বঙ্গবন্ধু সেতু রেলপথের কয়েকটি জায়গায় রেললাইন বানের পানিতে ডুবে যাওয়ায় এ পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ডুবে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে পড়ে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা।
এ ছাড়া সরিষাবাড়ী থানা, ফায়ার সার্ভিস, কেন্দ্রীয় পোস্ট অফিস, খাদ্য গুদাম, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, সমাজসেবা অফিস, নির্বাচন অফিস, পশু হাসপাতাল ও তিনটি জুটমিলসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বানের পানি প্রবেশ করায় স্থবির হয়ে পড়ে উপজেলা পরিষদের স্বাভাবিক কাজকর্ম। এ উপজেলার সাড়ে চার লাখ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষই কমবেশি বন্যাকবলিত হয়। অথচ উপজেলা প্রশাসনের হিসাবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা মাত্র ৫০ হাজার মানুষ। ত্রাণ বিতরণের মাত্রাও অনেক কম।
সাতপোয়া ইউনিয়নের চর দাশেরবাড়ি গ্রামের সত্তরোর্ধ বৃদ্ধা আজিরন বেওয়া বলেন, “বাফু কী খাই, না খাই, ক্যাডা খোঁজ ন্যায়? হুনলাম কাইল নাহি কয়জন নেতা নাও নিয়ে আইছিল। তারা ওই পাড়াত গুড়-মুড়ি দিয়া গ্যাছে, আঙ্গরে পাড়াত আহে নাই। ” ভাটারা ইউনিয়নের চর হরিপুর গ্রামের দুদু মিঞা বলেন, “খালি হুনি সরকার নাহি বানের জইন্যে ম্যালা সাহায্য দিতাছে, কিন্তু কী যে দ্যায়- তাতো দেখতেই আছি। নাও দিয়্যা কয়জুন বড়লোক আহে, ছোড ছোড কয়ডা পোটলা হাতে ধরাইয়া দিয়ে খালি ফটো তুলে আর চইলা যায়। ”
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা.মমতাজ উদ্দিন বলেন, “বন্যার কারণে ডায়রিয়া, খোঁস-পাঁচড়া ও সর্দি-কাশিসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। ” উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফেরদৌস জানান, এ উপজেলার ৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্লাবিত হওয়ায় পাঠদান পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য সাতটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অস্থায়ীভাবে আশ্রয়ণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ ছাড়া পৌরসভা কার্যালয়ে খোলা হয়েছে একটি আশ্রয়ণ কেন্দ্র।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইয়েদ এ জেড মোরশেদ আলী বলেন, “সরকারিভাবে এ পর্যন্ত ৬৩ মেট্রিকটন জিআর চাল বরাদ্দ পেয়েছি, সেগুলো বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া শুকনো খাবার ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে।