সাগরপাড়ে প্রিয়জনদের অপেক্ষায় স্বজনরা

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকায় সাগরপাড়ে প্রিয়জনের অপেক্ষায় সময় কাটাচ্ছেন স্বজনরা। তাদের চোখেমুখে প্রিয়জন হারানোর উৎকণ্ঠা। সাগর থেকে ট্রলার ফিরতে দেখলেই তাদের সবাই ঝাপিয়ে পড়ছে প্রিয়জনদের খোঁজে। কেউ বিলাপ করছেন, কেউবা ফিরে যাচ্ছেন তীরে। বাড়ছে অপেক্ষার পালা, চলছে স্বজন হারাদের মাতম।

চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলার পারকি সমুদ্র সৈকতেও এমন অনেকে স্বজনদের অপেক্ষায় রাত-দিন কাটাচ্ছেন। তাদের মধ্যে সমুদ্র তীরবর্তি গ্রাম বাইশারি পাড়ার পারভিন আক্তার জানান, দুই বছর আগে অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে বাড়ির কাউকে না বলে গোপনে ট্রলারে করে বিদেশ পাড়ি দেন তার স্বামী বদিউল আলম।

সপ্তাহখানেক পর খবর পায় স্বামী মালয়েশিয়ার জঙ্গলে আটকা পড়েছে। এরপর দেখতে দেখতে দুই বছর কেটে গেলেও স্বামী বদিউল বেঁচে আছে, না মারা গেছে সে খবর জানা সম্ভব হয়নি। এখন অন্যরকম এক অজানা ইতিহাস হয়ে আছে এই যুবক বদিউল আলম।

তিনি বলেন, সেই থেকে স্থানীয় লোকজনের ঘরে কাজ করে পেটের ক্ষিধে মেটাই। একমাত্র সন্তানের মুখে দু’বেলা ভাত দিতে পারলেও অভাবের তাড়নায় কাপড়-চোপড় কিনতে পারি না। ছেলেকে নিয়ে প্রতিক্ষায় থাকি কখন ফিরবে সন্তানের বাবা। এরমধ্যে শুনি মালয়েশিয়ার জঙ্গলে বাংলাদেশির মৃত্যুর কাহিনী। এরপরও সাগরপাড়ে কোন ট্রলার আসলে মনে হয় স্বামী ফিরে এসেছে। গিয়ে দেখি না। তবুও বুকে আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকি সাগরের দিকে।

একই কথা বললেন কক্সবাজার পৌরসভার পরিচ্ছন্নকর্মী ফারেছা বেগমও। শহর থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে সাগর পাড়ের সমিতি পাড়ায় তার বাস। কখন স্বামী ফিরবে, বাবা ফিরবে সেই প্রতীক্ষায় অসহায় মা ছেলের সময় কাটছে সমুদ্রের তীরেই। তাদের ধারণা, যে পথে যাওয়া সে পথেই হয়তো একসময় ফিরে আসবে প্রিয় মানুষটি। তাই ৭ বছর বয়সী একমাত্র সন্তান জুনাইদকে সাথে নিয়ে নিরবে বসে থাকেন সাগর পাড়ের বালিয়াড়িতে।

এভাবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের কয়েকশ পরিবারে চলছে অজানা আতঙ্কে শোকের মাতম। আপন জনকে হারিয়ে দেশের শত শত মানুষ কাঁদছেন। নিখোঁজ মানুষের স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছে। কারো পিতা, কারো ভাই, কারো প্রিয় সস্তান নিখোঁজ রয়েছেন মাসের পর মাস। কখনো কখনো লাশ মিলছে। তবে যাদের সন্ধান মিলছে না তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে এ নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে নিখোঁজ প্রিয় মানুষগুলোর খোঁজ না পাওয়ায় এখন আর বাঁচার আশা দেখছেন না কেউই। এখন চাপা কান্না আর বুকফাটা আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে নিখোঁজ স্বজনের পরিবারগুলো। এতো দুর্ঘটনা আর নির্মম মৃত্যুর মিছিলেও কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না সমুদ্রপথে অবৈধ মানবপাচার।

তবে সম্প্রতি সময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বর্তমানে স্থবির রয়েছে মানবপাচার সিন্ডিকেটের কার্যক্রম। স্বল্প খরচে বিদেশ গিয়ে পরিবারে স্বচ্ছলতা আনার জন্য দালালদের খপ্পরে পড়ে ইতিমধ্যে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড যাওয়ার চেষ্টায় সাগর পাড়ি দিয়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ। এদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনের গন্তব্যে পৌঁছার গল্প শোনা গেলেও বেশীর ভাগেরই কপালে জুটেছে নিষ্ঠুর নির্যাতন এবং নির্মম মৃত্যু। পাড়ি দেয়া বেশীরভাগ মানুষের নাম যোগ হচ্ছে নিখোঁজের তালিকায়।

সরকারিভাবে কোন পরিসংখ্যান না থাকলেও একটি বেসরকারি হিসাব বলছে, অবৈধভাবে সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় গত ৪ বছরে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশী মানুষ নিখোঁজ এবং মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছেন।

কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এসআইএম আক্তার কামাল আজাদ জানান, তার ওয়ার্ডে বৃহত্তর সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, বন্দরপাড়া ও নাজিরারটেকসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। যাদের বেশীরভাগই অল্প খরচে বেশী টাকা আয় করার স্বপ্নে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছে।

তারা জানতেন না সমুদ্র পথে বিদেশ যাওয়া মানেই একটি অনিশ্চিত গন্তব্য। নৌপথে মানবপাচার ঠেকাতে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের কড়া সতর্কতার পরে কিছুটা বন্ধ রয়েছে। যদিও মানবপাচারকারী দালালদের বিরুদ্ধে তারা সবসময় সজাগ রয়েছেন বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ।

চট্টগ্রামের বিশেষ পুলিশ সুপার মুসলিম আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, মানবপাচারকারী দালালদের বিরুদ্ধে পুলিশ সবসময় জিরো টলারেন্স নিয়ে কাজ করছে। এজন্যে কমিউনিটি পুলিশের সহযোগিতায় জেলা পুলিশ জনসচেতনতা বাড়ানোর কাজও করছে। আশা করছি অল্প সময়ের মধ্যে মানবপাচারের কাজ শুন্যের কোটায় নেমে আসবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর