বাংলাদেশে প্রবীণ জীবনে অবসর এবং অবকাশ

আমাদের দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি প্রবীণ রয়েছেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণকারীরা আজীবন পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন। বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে অবসর গ্রহণকারীরা এককালীন আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। সরকারের বয়স্ক ভাতার আওতায় ২৭ লাখ প্রবীণ পেনশন পান। যারা কর্মক্ষেত্রে উচ্চ যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধার পরিচয় দিয়েছেন কিংবা উচ্চপদে বেশি বেতনে চাকরি করেছেন তারা অবসর গ্রহণের পর আর্থিক সংকটে পড়েন না। যারা নিম্নপদে কম বেতনে চাকরি করেছেন তারা অবসর গ্রহণের পর আর্থিক সংকটে পড়েন

অবসর গ্রহণ মানে কর্ম পরিত্যাগ করা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে অবসর গ্রহণের অর্থ হলো প্রাথমিক পেশাগত জীবনের অবসান। সামাজিক পর্যায়ে এর অর্থ হলো অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারানো। মোট কথা, অবসর হলো কর্মহীন হওয়া। অবসর দুই ধরনের হয়। স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্যতামূলক। একটি নির্দিষ্ট বয়সে অবসর গ্রহণ বাধ্যতামূলক। ব্যক্তি নিজের প্রয়োজনে কাজ ছেড়ে দিলে হবে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ। কর্মহীন হওয়া একজন মানুষের জন্য কষ্টকর। কর্মহীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং একই সঙ্গে সহকর্মী, সঙ্গী, সাথী বন্ধুবান্ধব হারান। যারা অবসর নিয়েছেন তারা কর্মহীন হওয়ার বেদনা বুঝতে পারেন সবচেয়ে বেশি। অবসর গ্রহণকারী ব্যক্তি হারান প্রাপ্ত সম্মান, নিজের গুরুত্ব, নিয়মমাফিক কাজ, কর্মস্থলের লোকজন, অর্থ। আমাদের কারও সঙ্গে প্রথম পরিচয় হলে জানতে চাই, ‘আপনি কী করেন?’ আমরা পেশা এবং প্রতিষ্ঠানের নাম বলে থাকি। কাজ শুধু ব্যক্তির পরিচিতিই দেয় না, সামাজিক মর্যাদাও নির্ধারণ করে দেয়। কেউ যদি পরিচয় দেন যে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পিয়ন, আবার অন্য একজন পরিচয় দেন যে, তিনি জেলা প্রশাসকের পিয়ন। পিয়নের পদটি একই মর্যাদার, তারপরও সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে কোন পিয়ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক— এ প্রার্থক্যটুকু যে কোনো মানুষই বুঝতে পারে। যদিও দুইজনই শিক্ষক। চাকরিরত পুলিশের ওসি আর অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের ওসির সঙ্গে অনেক ফারাক রয়েছে। অবসর গ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তি পরিচিতির সংকটে পড়ে। পরিচয় দেয়ার সময় বলে, সাবেক সচিব, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ইত্যাদি। সমাজ এবং পরিবারের মঙ্গলের জন্য ব্যক্তি তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কাজ করেন। সমাজের জন্য উৎপাদন, সম্পদ ও সুযোগ সৃষ্টি, সেবা, আবিষ্কার, প্রতিষ্ঠান, নির্মাণ ইত্যাদিতে নিয়োজিত থাকেন। দীর্ঘ সময় এতসব কাজ করার পর অবসর গ্রহণের সময় আসে। জীবনের অবশিষ্ট সময়টুকু যাতে ব্যক্তি তার খেয়াল-খুশি মতো শখের কাজ, হালকা কাজকর্মে অংশগ্রহণ করে জীবনকে উপভোগ করতে পারেন সে বন্দোবস্ত করা উচিত। আমাদের দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি প্রবীণ রয়েছেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণকারীরা আজীবন পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন। বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে অবসর গ্রহণকারীরা এককালীন আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। সরকারের বয়স্ক ভাতার আওতায় ২৭ লাখ প্রবীণ পেনশন পান। যারা কর্মক্ষেত্রে উচ্চ যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধার পরিচয় দিয়েছেন কিংবা উচ্চপদে বেশি বেতনে চাকরি করেছেন তারা অবসর গ্রহণের পর আর্থিক সংকটে পড়েন না। যারা নিম্নপদে কম বেতনে চাকরি করেছেন তারা অবসর গ্রহণের পর আর্থিক সংকটে পড়েন। আমাদের কর্মশক্তির একটি বড় অংশ কৃষি, শিল্প, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত রয়েছেন। কৃষিতে যে মানুষ জীবনের একটা বড় সময় কৃষক কিংবা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি অবসর গ্রহণের পর আর্থিক সংকটে পড়বেন। তার জীবনযাপন হুমকির মুখে পড়বে। পোশাক শিল্পে আমাদের শ্রমিকরা কাজ করে। চাকরিরত অবস্থায় যারা এখন নিজেদের সংসার চালাতে হিমশিম খান, আর অবসর গ্রহণের পর কী অবস্থা হবে এটা সহজেই বোঝা যায়। দোকান কর্মচারী হিসেবে কাজ এখন বহু লোক করেন। তাদের বেশিরভাগেরই নিয়োগপত্র নেই। অবসর গ্রহণের পর তাদের অবস্থা আরও বেশি কাহিল। অবসরকে মানুষ বেশি ভয় করে, কারণ আর্থিক সংকটে পড়বে সে জন্য। অবসর গ্রহণকারীদের পেনশন সুবিধা বাড়িয়ে দিলে বেশিরভাগ প্রবীণ অবসর গ্রহণকে জীবনের পুরস্কার হিসেবে নেবেন। যেসব চাকরিতে শারীরিক যোগ্যতাকে প্রধান হিসেবে দেখা হয় সেখানে ব্যক্তির শারীরিক অক্ষমতা অবসর গ্রহণে বাধ্য করে। সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীর সদস্যদের মাত্র ৩৫ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করতে দেখা যায়। সশস্ত্র বাহিনীর একজন সদস্য প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে অনেক ধরনের যোগ্যতা লাভ করেন। কম বয়সে এ অবসর বিবেচনার দাবি রাখে। দেশের গড় আয়ু দিন দিন বাড়ছে। একইভাবে কর্মক্ষম জনসংখ্যা দিন দিন কমছে। তার মানে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে বেকারত্ব এবং কর্মক্ষেত্রে অসন্তুষ্টি। নবীনদের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়ছে ফলে যোগ্যতাসম্পন্ন শারীরিকভাবে সক্ষম প্রবীণরা আলোচনার বাইরে থাকছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার আর তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ অল্প সময়ে অনেক কাজ করতে পারবে। ভবিষ্যতে দৈনিক শ্রমঘণ্টা ৮ ঘণ্টা থেকে কমে ৬ ঘণ্টা হতে পারে। সাপ্তাহিক ছুটি দুইদিনের পরিবর্তে তিনদিন হতে পারে। বছরে একমাস সবাই ছুটি পাবে প্রিয়জন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। বিশেষ করে পরিশ্রমের কাজ কমে যাবে। অবসর গ্রহণের যে বয়সসীমা আছে তা উঠে যেতে পারে। শারীরিক এবং মানসিকভাবে সক্ষম প্রবীণ ব্যক্তিরা ইচ্ছানুযায়ী কর্মক্ষেত্রে থাকতে পারবেন। যেমনটা পারেন আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতারা। আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, মন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে বেশি বয়সকেই সম্মানের চোখে দেখা হয়। আমাদের সমাজ মূলত প্রবীণবিদ্বেষী নয় বরং প্রবীণবান্ধব। প্রবীণদের নানা রকম সংকট থাকার পরও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর মূল্যবোধ আমাদের সমাজে রয়েছে। কিন্তু পাওয়ার জন্য যা কিছু করা হয় তাহলো কাজ। আর কাজ হতে দূরে থেকে সময় কাটানো হলো অবকাশ। অনেকেই মুক্ত সময় বা ফ্রি টাইমসকে অবকাশের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। অবকাশ আর ফ্রি টাইম এক কথা হতে পারে না। কেউ নির্দিষ্ট কাজের বাইরে হাতে কিছুটা সময় পেয়েছেন সেই সময় ঘর গোছানো, বাজার করা, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া, বাচ্চাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার করা ইত্যাদি অবকাশ হতে পারে না। প্রয়োজন মেটাতে যে কাজ সেটা স্বাধীনভাবে করার সুযোগ থাকলে তা অবকাশ হতে পারে না। অবকাশ ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব সময়, যে সময়ে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বৈধ শখের কাজ করেন। এ ধরনের কাজ হতে পারে বই পড়া, নাটক, সিনেমা দেখা, ভ্রমণ করা, শিকার কিংবা মাছ ধরা, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেয়া, তাস-দাবা খেলা, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ। অবকাশ হলো ব্যক্তির আত্মতুষ্টি। বার্ধক্যে অনেকেই প্রচুর সময় পান অবকাশ কাটানোর জন্য। আর্থিক এবং শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকের পক্ষে অবকাশ কাটানোর সুযোগ হয় না। গ্রামের প্রবীণরা গল্পগুজব, আত্মীয় বাড়ি বেড়ানো, মেলায় যাওয়া, ধর্মকর্ম করে, ধর্মীয় স্থান পরিদর্শন করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করে, বাচ্চাদের গল্প শুনিয়ে অবকাশ কাটান। উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রবীণরা সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করে অবকাশ কাটাতে বেশি পছন্দ করেন। এতে অনেক বেশি সম্মান এবং মর্যাদা পাওয়া যায়। সংগঠনে যুক্ত থেকে চক্ষুশিবির, শীতবস্ত্র বিতরণ, মেডিকেল ক্যাম্প, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কাজে অংশ নেন। কিছু সংখ্যক প্রবীণ টেলিভিশনে টকশো, পত্রিকায় কলাম লিখে অবকাশ যাপন করেন। কেউ কেউ স্থানীয় ক্লাবের মেম্বার হয়ে সামাজিক কাজে অংশ নেন। মেধাবী প্রবীণরা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে বক্তা, শ্রোতা হিসেবে অংশ নেন। মেধাবী প্রবীণদের মধ্যে কেউ কেউ বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বক্তব্য রেখে অবকাশ যাপন করেন। নিম্নবিত্তের প্রবীণরা সংসারকেন্দ্রিক অবকাশ যাপন করেন। জাল বোনা, তাস খেলা, বাগান করা, ফলফলাদির গাছের যত্ন নেয়া, বইপড়া, ধর্মকর্ম করা, হাঁটাহাঁটি করা, টিভি দেখা, শুয়ে-বসে চিন্তা করা, স্মৃতিচারণ করা, সেলাই, বুনন, কুটির শিল্পের কাজ ইত্যাদিতে সময় দিয়ে অবকাশ কাটান। কেউ কেউ নাতি-নাতনির সঙ্গে গল্প করে, খেলা করে অবকাশ যাপন করেন। অবকাশে মানুষ যাই করুক না কেন তা হবে নিজের ভালো লাগার জন্য, বাধ্য হয়ে নয় কিংবা সামাজিক চাপে পড়েও নয়। গবেষণায় দেখা যায়, প্রবীণরা অবকাশ যাপন করতে পারলে সৃজনশীল কাজে ভালো করেন। যেমন— কোনো জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা, ছবি আঁকা, লেখা, জনগণকে ভালো কাজে উদ্বুব্ধ করা, পারিবারিক সংকট মোকাবিলায় সহযোগিতা করা ইত্যাদি।

—লেখক : সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম
ট্রেজারার, বাংলাদেশ জেরোন্টলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএ)

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর