যখন ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করি হাওরের উদ্দেশ্যে, ভারাক্রান্ত ছিলো মন, ভাবছিলাম কি বলবো আমার স্বজনদের, যারা সব হারিয়েছেন? আমি কি তাদের সান্তনা দেব, নাকি জানতে চাইবো তোমরা এ বছর কি হারিয়েছো আর কীভাবেই হারিয়েছো?
খুব ভোরে কিশোরগঞ্জ থেকে নিকলীর পথে পা বাড়াই। আপনারা জানেন নিশ্চয়ই আমাদের কিশোরগঞ্জের হাওরের শুরু কটিয়াদি উপজেলার করগাঁও থেকে নিকলী দিয়ে। জারইতলা ইউনিয়নের পুড্ডা বাজারের উঁচু ব্রিজটা পেড়িয়ে তবেই নিকলী প্রবেশ করি। লোদার পুড্ডা থেকে শুরু করে নিকলী, নগর, মহরকোনা, কামালপুর, পূর্ব হাটি, দামপাড়া পর্যন্ত পুরো রাস্তায় ভেজা ধানের গাছগুলো রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। পুরো এলাকা পচা দুর্গন্ধে ভরপুর।
৫ মে ২০১৭ দামপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছিলাম। কারণ হাওরের বিদ্যমান বিপর্যয়ে হাওরপারের মানুষের ভাবনাগুলো জানাটা খুব জরুরি ছিলো আমাদের জন্য। তাই আমি পথে পথে কথা বলেছি গণমানুষের সাথে। তবে দুঃখের বিষয় এই দুর্যোগের দিনেও উপজেলার শীর্ষ কর্মকর্তা এলাকায় অনুপস্থিত!
মহরকোনা থেকে কামালপুর যেতে ফুটওভার ব্রিজের মুখে পাওয়া গেলো একদল নারীকে, যারা ভেজা ধান শুকানোর চেষ্টা করছেন রাস্তার উপর। জানতে চাইলাম, ‘ধান কাঁটার সুযোগ পেয়েছেন?’। বৃদ্ধ রহিমা বেগম বলেন, ‘কার ধান কেডা যে পানির তলেরতে কাটছে জানি না। বাড়ির ফুলাফাইনে যা পারছে কাইগ্যা আনছে।’
উল্লেখ্য এলাকায় এখন দিনমজুর পাওয়া যাচ্ছে না দৈনিক ১২০০ টাকা দিয়েও। যেখানে ধান পাওয়ার কথা ছিলো ৯০ মণ, সেখানে ২০ থেকে ২৫ মণ তুলতে পেরেছে। কিন্তু এই ধান থেকে চাল হবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমি নিজে ধানগুলো হাতে নিয়ে দেখেছি, দাঁত দিয়ে ধান কেটে চাল বের করেছি, পুষ্ট নয় যথেষ্ট, আবার একটু চাপ দিতেই দেখলাম ভেঙে চুরমাড়…
দামপাড়া ইউনিয়নের গোয়ালহাটি গ্রামের সুনাম উদ্দিন সাহেব গভীর হাওর এলাকায় যেখানে ধান চাষ করেছেন, সেখানে ৩০০ মণ ধান পাবেন বলে আশা করছিলেন। পানি আসায় সেখানে পুরো জমির ধান তলিয়ে যায়, একদল তরুণ যুবা তাকে প্রস্তাব দিলেন, তারা ডুবে যাওয়া জমির ধান কিনে নিতে চান। বিনিময়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা পাবেন সুনাম উদ্দিন।
জনাব সুনাম উদ্দীন ভাবলেন পানির নিচ থেকে ধান কেটে ঘরে তোলা তার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই ৩৫০০ টাকায় বিক্রি করেছেন ৩০০ মণ ধান! এই অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটেছে এবারে হাওরে…
পানির নিচে থাকা ধানের ভেজা চারা গুলো রাস্তায় শুকিয়ে কিছুটা ক্ষতি পোষানোর প্রাণান্তর চেষ্টায় আছেন এই মুহূর্তের হাওরপাড়ের নারী-পুরুষ সবাই। দামপাড়ার কৃষক পরিবারের সন্তান আক্কাস আলীর বৃদ্ধ মা স্থান সংকুলান না হওয়ায় বাঁশের মাচা বেয়ে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদে উঠেছেন ধান শুকানোর জন্য। ফাতেমা বেগম সেই ভোর রাত থেকেই ধান সেদ্ধ বসিয়েছেন বিশাল আকারের পাত্রে।
কিছুক্ষণ পর পর অল্প করে পানি দিচ্ছিলেন পাত্রে। জিজ্ঞাসা করলাম কতক্ষণ লাগবে এগুলো সেদ্ধ হতে? তিনি জানালেন আগামী কয়েকদিন লেগে যাবে। সেদ্ধ হওয়ার পর আবার ঠান্ডা করে রোদে শুকোতে হবে, এখন প্রকৃতি সদয় হলেই হলো…
মতবিনিময় সভায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় জনাব আমিনুল ইসলাম বলেছেন, মিঠামইন, অষ্টগ্রামের দিকে কয়েকটা নদী আগের মতো কার্যকর নেই, বিশেষ করে কাটখালের দিকে ধনু নদী শুকিয়ে গেছে। আবার হাওরের বিল, খালগুলো ক্রমেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই, কিশোরগঞ্জের প্রাণ নরসুন্দা নদীটি রাষ্ট্রীয় মদদে হত্যা করা হয়েছে। এখানে এটা উল্লেখ করতেই হবে, এই নরসুন্দা একটি নদ, আর এর জলের উৎস ছিলো আমাদের হাওর। তাই এই নদী দুটো সক্রিয় থাকলে হাওরে আসা উজান ঢলের পানি সহজেই নদীতে এসে পরতো আর রক্ষা পেতো হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল।
সমাজকর্মী জনাব খোকন বলেন, অন্য বছর গুলোতে আগে নদীর পানি বেড়ে তবেই হাওরে নামতো, এবার ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়েছে। এবার আগে হাওরে পানি এসেছে, তার পর নদীতে পড়েছে। নদী ও হাওরের সংযোগ খালগুলো ভরাট ও সমতল হয়ে যাওয়া এর জন্য দায়ী বলে যুক্ত করেন।
হাওর এলাকায় বোরো চাষ আগে হতো না, কিন্তু ফলন ভালো হওয়ায় গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে এখানে বোরো চাষ শুরু হয়। বোরো চাষে সময় লাগে বেশি। এখন যেহেতু পানি ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছে তাই এমন একটা ধান বা ফসল আমাদের বেছে নিতে হবে, যাতে সময় লাগবে তুলনামূলক ভাবে কম। তবে হাওর এলাকার মানুষ বোরো চাষ বেছে নিয়েছেন এইজন্য যে, এতে ফলন ভালো হয়। কিন্তু এই ধারা অব্যহত থাকলে কৃষকের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। এই বাস্তবতা যত দ্রুত হাওরের কৃষক বুঝতে পারবেন ততই মঙ্গল।
হাওরে এবার কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে সরকারি বেসরকারি হিসেবে যথেষ্ট গড়মিল রয়েছে। হাওরকে দুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হবে কি না সেটা নিয়ে চলছে রাজনীতি। আর এই সুযোগে চলছে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি যুদ্ধ। আমরা একদিন ভুলেই যাবো যে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কতিপয় ঠিকাদারের দুর্নীতি, অদক্ষতা ও সীমাহীন উদাসীনতায় ভেসে গিয়েছিলো আমাদের হাওরের বাঁধ।
একটা বিষয় আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়, আর সেটা হলো হাওর নিয়ে যে বা যারা সেইসবুক, টুইটার আর ইনস্টাগ্রামে পোস্ট বা স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, সমবেদনা জানাচ্ছেন, তারা কয়জন হাওর এলাকায় গিয়েছেন? সরকারি পর্যায়ে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে সেটা এতোটাই আপ্রতুল যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যারা আছেন তারা কোনভাবেই মুখ খুলছেন না। তাদের একটাই বক্তব্য, প্রকৃত দুঃস্থদের তুলনায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে অনেক কম, এমতাবস্থায় তারা নিজেরাও বিব্রত।
আমি এবার যেখানেই গিয়েছি প্রত্যেকেই ক্ষুদ্ধ হয়ে জানিয়েছেন যারা প্রকৃত অসহায়, তারা ত্রাণ পাননি। এখন কথা হচ্ছে, যে ত্রাণ পায়নি তারা ক্ষোভ প্রকাশ করবেন এটাই স্বাভাবিক, আবার আমাদের জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, উনাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি নেই বললেই চলে।
তারপরেও সীমিত বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে অনেকেই এগিয়ে আসছেন, হাওরপাড়ের মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আপনাদের সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি হাওরবাসীদের পক্ষ থেকে। সেই সাথে সুশীল সমাজের প্রতি আমার উদাত্ত আহ্বান, যদি সম্ভব হয় একটু সময় করে ঘুরে আসুন। দেখে আসুন আসলে আমাদের করুণ দশা…
বাংলাদেশের প্রতিটা অঞ্চলই ব্যতিক্রম। হাওরের সবকটি এলাকাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ভরপুর। তাই অঞ্চলভেদে স্থানীয় সমস্যা চিহ্নিত করার জন্য যারা বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন তাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ আপনারা দয়া করে হাওরপাড়ের মানুষের কথা আগে শুনুন। বোঝার চেষ্টা করুন, তাদের সাথে কথা না বললে বা তাদের প্রকৃত সমস্যা ধরতে না পারলে তাদের জন্য যে সমাধানই বের করুন তা কার্যকর হবে না। কারণ সমাধানের জন্য যেসকল কর্মসূচি হাতে নেয়া হবে বা বাস্তবায়ন করতে হাবে, সেটা কিন্তু তাদের দ্বারাই করতে হবে।
হাওরপাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ ও বিশেষজ্ঞদের সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া এই বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব।
লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী