হাওর তীরে বেড়েই চলেছে চালের দাম

এ বছর মরণ এসেছে। আর কমবে না চালের দাম। ২৮ টাকার আতপ চাল এখন ৪৫ টাকা। ক্ষোভে দুঃখে এমনটিই জানালেন বোরো হারানো হাকালুকি হাওরপাড়ের ভূকশিমইল ইউনিয়নের কৃষক তমই মিয়া (৫০), ইসমেত আলী (৫৫), বদই মিয়া (৬২), আবুল হোসেন (৬৩), গুনবান বিবি (৬০), কাউয়াদিঘি হাওর পাড়ের জাহিদপুর গ্রামের বোরো চাষি আব্দুল মজিদ (৪৮), ফরজান মিয়া (৫০), আহমদ মিয়া (৬০)। তারা জানালেন, প্রতিদিনই তাদের (১৪-১৬ জনের) পরিবারে চাল লাগে ৪-৫ কেজি। স্থানীয় বাজারে কোনো চালই ৪০-৪৫ টাকার কমে মিলছে না। এ হিসেবে প্রতিদিনই তাদের শুধু চাল কিনতে প্রয়োজন পড়ছে দুই থেকে আড়াইশ’ টাকা। আর এর বাইরে অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ তো থাকছেই। তাদের মতো হাইল হাওরসহ জেলার অন্যান্য ছোট বড় হাওর পাড়ের বাসিন্দাদের একই অবস্থা। এখন বোরো ধান নষ্ট হওয়ার অজুহাতে হাওর পাড়ের ছোট দোকানি থেকে শুরু করে উপজেলা শহরের দোকানগুলোয় চালের দাম বেড়েই চলেছে। ২৫-২৬ দিনের ব্যবধানে স্থানীয় বাজারগুলোয় চালের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ১২-১৪ টাকা। জেলা শহরসহ সবকটি উপজেলা শহর ও স্থানীয় হাটবাজারগুলোয় হু হু করে বাড়ছে চালের দর। মাস দেড় মাস আগে যে আতপ (পাইজম) চালের দাম ছিল প্রতি বস্তা ১৫-১৬ শ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২৪-২৫শ টাকা। হাকালুকির তীরবর্তী বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়ার স্থানীয় বাজার ঘুরে চালের খুচরা ও পাইকারি দোকানগুলোয় এমন বাড়তি দাম লক্ষ্য করা যায়। একই অবস্থা কাউয়াদিঘি ও হাইল হাওর তীরবর্তী রাজনগর, মৌলভীবাজার, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাজারগুলোরও। কোথাও চালের দামের কমতি নেই। দেশে চালের কোনো ঘাটতি নেই তাহলে কেন এত দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন? এমন প্রশ্নে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, আমরা মহাজনদের কাছ থেকে বাড়তি দাম দিয়ে ক্রয় করছি বলেই তা দামে বিক্রি করছি। জেলা ও উপজেলা শহরের কজন পাইকারি চাল ব্যবসায়ী (আড়ৎদার) বলেন, বোরো হারানোতে আমাদের এলাকার অটোরাইস মিল বা চাতাল কলগুলো প্রায় বন্ধ। তাই স্থানীয় পর্যায়ে নেই চালের উৎপাদন। এ কারণে এখন আমরা যাদের কাছ থেকে চাল কিনছি তারাই মূলত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বোরো হারানোর অজুহাতে হাওর এলাকায় বেশি দরে চাল বিক্রি করছেন। আমরা এর প্রতিবাদ করলে তারা আমাদের চাল দেয়া বন্ধ করার হুমকি দেন। ব্যবসা ধরে রাখার স্বার্থে ওদের কাছ থেকে ক্রয় করা চাল আমরা অনেকটা অল্প লাভেই বাজারে ছেড়ে দিচ্ছি। তার পরও দাম অনেক বেশি এমনটি স্বীকার করছি। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের কোনো হাত নেই। তাছাড়া আগে যাদের চাল ও ধান মজুদ ছিল তারাও এ সুযোগে অধিক মুনাফার চিন্তায় চালের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। হাওর পাড়ের সাদিপুরের গ্রামের মুদিদোকানি তাজমান মিয়া, তাজই মিয়া, শাহিনা বেগম, সেলিম মিয়া জানালেন, অন্যান্য বছর এসময় তাদের দোকানে একবস্তা চাল বিক্রি করতে মাস দিন লাগত। কিন্তু এ বছর চালই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। ২-৩ দিনেই বিক্রি হচ্ছে এক বস্তা চাল। মৌলভীবাজার শহরের মুদিদোকানি উত্তম পাল, সেলিম আহম, শফিক মিয়া, সালাম আহমদসহ অনেকেই জানান, তারা এখন প্রতিকেজি আতপ (পাইজম) খুচরা বিক্রি করছেন ৪৮-৫০ টাকা। যা মাস দিন আগে ছিল ৩৫-৩৬ টাকা। কাটারি ভোগ ৫৭-৫৮ টাকা। মাস দিন আগে ছিল ৪০-৪৫ টাকা। বাসমতি মিনিকেট ৫৫-৫৬ টাকা। আগে ছিল ৩৮-৪০ টাকা। শাহজালাল (মধ্যম মোটা চাল) ৪৫-৪৬ টাকা। আগে ছিল ২৮-৩০ টাকা। জেলায় সবকটি উপজেলায় এবছর কমি বেশি বোরো ধান হারিয়ে যাওয়ায় হঠাৎ দাম বেড়েছে চালের। এখন হাওর পাড়ের লোকজনের সঙ্গে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-আয়ের লোকজনও চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। হঠাৎ এ জেলায় চালের দাম বাড়ার বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলা আইজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান মুজিব ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর মৌলভীবাজার জেলা সভাপতি ডা. সাদিক আহমদ বলেন, হাওর তীরের অসহায় মানুষগুলোর দুর্দিনে যারা সাহায্যের পরিবর্তে সিন্ডিকেট করে মুনাফার চেষ্টা করে তাদের হীনম্মন্যতার বিষয়টি বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে চালের বাজার মনিটরিং জোরদার করার জোরালো দাবি জানান তারা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর