তীব্র খাদ্য সংকটে ধুঁকছেন কিশোরগঞ্জের হাওরপাড়ের মানুষ। নজিরবিহীন আগাম বন্যায় নিঃস্ব এখানকার দুই লাখ কৃষক। ঘরে ঘরে অভাব। ধনী-গরিব বলে কিছুই নেই, সবারই সমান আকাল। বৈশাখে এমন ঘোর দুর্দিন এর আগে কখনো দেখেননি হাওরবাসী। ধান পাকার আগেই তছনছ হয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন। পানির নিচে পচছে তাদের সোনার ফসল। খাদ্যাভাবে বিক্রি করে দিচ্ছেন শেষ সম্বল গবাদিপশুও। হাওরজুড়ে কেবলই ফসলহারা কৃষকের হাহাকার। স্থানীয়রা বলছেন, প্রায় প্রতি বছরই নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের একমাত্র বোরো ফসলের কমবেশি ক্ষতি হয়ে থাকে। এতে তারা লোকসানের মুখে পড়লেও, কোন না কোন ভাবে সেই ধকল সামলে উঠতে পারেন। কিন্তু এবার যে বিপর্যয় ঘটেছে, তা সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তারা জানিয়েছেন, ফাল্গুন মাসের দিকেই হাওরের মানুষের খোরাকিতে টান পড়ে। ফাল্গুন-চৈত্র এই দুই মাস কষ্টে-সৃষ্টে কাটাতে হয় তাদের। বৈশাখে নতুন ফসল কাটা শুরু হলে, ‘চৈতের নিদান’ থেকে মুক্তি মিলে কৃষকের। পুরো বৈশাখ মাসে দিনরাতের হিসাব ভুলে কৃষক ব্যস্ত থাকেন ধান কাটা, মাড়াই আর শুকানো শেষে গোলায় তোলার কাজে। কিন্তু হাওরের কৃষকের এবার আর সেই ব্যস্ততা নেই। ফসল হারিয়ে এখন বেকার সময় কাটছে তাদের।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কিশোরগঞ্জ জেলার সম্পূর্ণ হাওর অধ্যুষিত উপজেলা চারটি। এগুলো হচ্ছে, ইটনা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন ও নিকলী। এছাড়া করিমগঞ্জ, কটিয়াদী, বাজিতপুর, তাড়াইল, ভৈরব ও কুলিয়ারচর উপজেলার অংশবিশেষ হাওর এলাকায় অবস্থিত। জেলায় এবারের বোরো মৌসুমে আবাদী জমির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার ৩২৬ হেক্টর। এর মধ্যে ইটনা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন ও নিকলী এই চারটি উপজেলাতেই বোরো আবাদ হয়েছিল ৮৩ হাজার ৩০২ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ইটনায় সর্বোচ্চ ২৭ হাজার ৬৬৫ হেক্টর, অষ্টগ্রামে ২৪২১২ হেক্টর, মিঠামইনে ১৬ হাজার ৩শ’ হেক্টর ও নিকলীতে ১৫ হাজার ১২৫ হেক্টর। এই চারটি উপজেলার সবগুলো হাওরই জলমগ্ন। কৃষকেরা বলছেন, এসব এলাকায় প্রায় শতভাগ জমির ফসলহানি ঘটেছে। এতে অন্তত দেড় লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর বাইরে বাজিতপুর উপজেলায় ১২ হাজার ৩৫০ হেক্টর, তাড়াইলে ১০ হাজার ৪০ হেক্টর, করিমগঞ্জে ৯ হাজার ৭৯৪ হেক্টর ও ভৈরবে ৬ হাজার ২৩০ হেক্টর আবাদী বোরো জমির সিংহভাগই অকাল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকায় আরো ৫০ হাজার মিলিয়ে কমপক্ষে দুই লাখ কৃষক আগাম বন্যায় সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন। বানের জল আর চোখের জলে একাকার কৃষক। তবে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৫৭ হাজার ৮৮৭ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত এসব জমি থেকে ২ লাখ ৪ হাজার ৩৪১ টন চাল উৎপাদিত হতো যার আর্থিক মূল্য ৮১৭ কোটি ৩৬ লাখ চুয়াল্লিশ হাজার চারশ’ টাকা। এর মধ্যে ইটনা উপজেলায় ১৯ হাজার ৭৮০ হেক্টর, মিঠামইন উপজেলায় ১৪ হাজার ১১০ হেক্টর, অষ্টগ্রাম উপজেলায় ১৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর, নিকলীতে ৫ হাজার ৮১৫ হেক্টর, করিমগঞ্জে ৩ হাজার ৪০ হেক্টর, তাড়াইলে ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর, বাজিতপুরে ৫৫০ হেক্টর, ভৈরবে ৩০৫ হেক্টর হোসেনপুরে ১১০ ও কটিয়াদীতে ৬০০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে মোট ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯২ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের করণশী গ্রামের বর্গাচাষী আদম খাঁ এবার ২ একর জমি করেছিলেন। জমি করতে গিয়ে মহাজনের কাছ থেকে দেড়ি সুদে ১৪ হাজার টাকা ছাড়াও একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। আগাম বন্যার পানিতে জমি তলিয়ে যাওয়ার পর থেকেই আছেন মহাসংকটে। আদম খাঁ বললেন, ‘পানিতে খেত যাঅনে অহন বাইচ্যা থাহনের আশাডাও শেষ অইয়্যা গেছে। ঘরে খাঅনই নাই, রেইনের চিন্তা করমু ক্যামনে। ৪টা মুখ যে কিতা দিয়া ভরমু, আল্লাঅই জানে।’ পাশের বাড়িরই হেলিম মিয়া জানালেন, ধারকর্জ করে ৭একর জমি করেছিলেন। সবটাই পানিতে তলিয়ে গেছে। এক আঁটি ধানও কেটে আনতে পারেননি। এখন ঘরে চাল নেই। ৪ জনের সংসার যে কিভাবে চালাবেন, এ চিন্তায় চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি। পাশের ঘরেই শয্যাশায়ী লাল খাঁ কাঁদতে কাঁদতে জানান, নিজের অসুস্থ। খোরাকির কথা ভেবে আত্মীয়স্বজনদের সহায়তায় এক একর জমি করেছিলেন তিনি। কিন্তু জমিতে করা সব খরচই এখন জলে গেছে। খোরাকির বাও (জোগাড়) আর অইলো না! বলে স্বগতোক্তি করলেন লাল খাঁ। জানালেন, ঘরে চাল না থাকায় এখন আত্মীয়স্বজনদের সহযোগিতাতেই খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটছে তার পরিবারের ৬ সদস্যের। লাল খাঁরই আত্মীয় জাহাঙ্গীরের ঘরেও একই দুরবস্থা। জানালেন, মাত্র ৭৫ শতক জমি করতে গিয়েই জড়িয়েছেন ঋণের জালে। জমি তলিয়ে যাওয়ায় এখন তার ঘরে শুধুই অভাব। করনশী গ্রামেরই নসেদ মিয়া দেড় একর জমিতে বোরো করেছিলেন। সর্বস্ব হারিয়ে এখন কাজের খোঁজে বাড়ি ছাড়ার জন্য পুটলা গোছাচ্ছেন তিনি। রাজধানী ঢাকায় দিনমজুরির কাজ করে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে ৬০ শতক জমি করেছিলেন মোল্লাহাটির ছায়েল মোল্লা। ঢাকায় থেকেই খবর পান তার জমি তলিয়ে যাওয়ার কথা। হতাশায় আর বাড়িই ফেরা হয়নি ছায়েলের। কেবল এসব প্রান্তিক কৃষকই নন, হাওরের বড় কৃষকদেরও একই অবস্থা। ঘরে অভাব থাকলেও মুখ ফোটে তা বলতে পারছেন না। যাদের গোয়ালে গরু আছে, তারা জলের দামে গরু বিক্রি করে পরিবারের জন্য চাল কেনা ছাড়াও বাজারসদাই করছেন। ইটনা সদরের বড়হাটি গ্রামের কৃষক হাজী মোক্তার হোসেন ৫০ একর জমি করে সর্বস্ব হারিয়েছেন। ফসল হারানোর শোকে নির্বাক হয়ে গেছেন বয়োবৃদ্ধ এই কৃষক। মিঠামইনের ঢাকী ইউনিয়নের চারিগ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া ২২ একর জমি করেছিলেন। কিন্তু জমিতে কাঁচি লাগাতেই পারেননি তিনি। ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী উপজেলার সব কৃষকেরই এখন একই দুরবস্থা। গত তিনদিন ধরে হাওরের প্রকৃতিতে ঝলমলে রোদ খেলা করলেও কৃষকের চোখের জল তাতে শুকাতে পারছে না। কেননা, তলিয়ে যাওয়া জমি থেকে যেসব কৃষক নৌকা আর শ্রমিক দিয়ে কিছু ধান কেটে এনেছিলেন, সেসবের অধিকাংশই টানা বৃষ্টিতে ভিজে এরই মধ্যে পচে গেছে। খলায় স্তূপ করে রাখা ধানে গজিয়েছে লম্বা লম্বা চারা। এই রোদে সেসব শুকানোর চেষ্টাও করছেন অনেকেই। কেননা ক্ষুধার রাজ্যে কোন কিছুই ফেলনা নয়!
সংবাদ শিরোনাম
হাওরে বানের জল চোখের জল একাকার
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ০৯:৩০:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩০ এপ্রিল ২০১৭
- ৩৬৪ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ