কার কথা সত্য। ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের- নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হাওরাবাসীর। হাওর এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এখনও ত্রাণ পাননি। খোলা বাজারে চাল বিক্রি শুরু হলেও তা শুধু জেলা ও উপজেলা শহরেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু যেসব এলাকা ডুবে গেছে সেই ওয়ার্ড বা ইউনিয়ন পর্যায়ে ওএমএসের মাধ্যমে চাল বিক্রির কোনো সুবিধা নেই। সময় এবং অর্থ ব্যয় করে উপজেলা বা জেলা সদরে যাওয়ার পর চাল পাবেন কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই। পর্যাপ্ত চাল না থাকায় দুপুরের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ ঢাকা থেকে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. মহসিন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চাহিদার তুলনায় বেশি ত্রাণ মজুদ রয়েছে। আমরা চাহিদা অনুযায়ীই ত্রাণ বরাদ্দ দিচ্ছি। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষের প্রশ্ন- তাহলে কার কথা সত্য। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা তালিয়ে যায়। বোরো ধান কাটার এ মৌসুমে হঠাৎ এ বন্যায় লাখ লাখ কৃষকের মাথায় হাত পড়ে। এরপর পানি বিষাক্ত হয়ে মাছ মরা শুরু হয়; তারপর মরতে থাকে হাঁস। এখন তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সব হারিয়ে এখন তারা চোখে অন্ধকার দেখছেন। দরিদ্র কৃষকের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও এখন সাহায্যে জন্য হাত পাতছেন। দুর্গত এলাকায় এখনও কোনো ত্রাণ পৌঁছেনি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে খোলা বাজারে চাল বিক্রি শুরু হয়েছে। তাও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে। ভিজিএফ, ১০ টাকা কেজি দরে চালের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিও চালু হয়নি। ত্রাণের তালিকায় ক্ষতিগ্রস্তদের নাম থাকবে কিনা- এ নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে।
সুনামগঞ্জের বিসম্বপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের সাতগাঁও গ্রামের বাসিন্দা খলিলউদ্দিন বলেন, তার নিজের ৫ বিঘা ও আরও কয়েক বিঘা বর্গা জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন। বানের পানিতে সব তলিয়ে গেছে। এখন বাঁচার তাগিদেই সাহায্যের প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের আশপাশে কোথাও কোনো ত্রাণ বিতরণ, এমনকি খোলা বাজারে চালও বিক্রি হচ্ছে না। উপজেলা সদরে চাল আনতে যাতায়াত খরচ পড়ে ৬০ টাকা। একদিন গিয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছি। তাই আবারও যে পাবেন তার কোনো ভরসা পাচ্ছেন না তিনি।
তিনি বলেন, গ্রামে গ্রামে সম্ভব না হলেও অন্তত ইউনিয়ন পর্যায়ে খোলা বাজারে চাল বিক্রি করা হলে ক্ষতিগ্রস্তরা অনেক উপকৃত হতেন।
একই এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত আরেক কৃষক অনিল বর্মণ বলেন, খোলা বাজারে চাল বিক্রি ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কোনো ত্রাণ কার্যক্রমই শুরু হয়নি। উপজেলা সদরে ওএমএস চালু করায় বিভিন্ন খরচ মিলিয়ে ১৫ টাকা কেজি চাল ২৫ টাকা পড়ে যায়। তার ওপর লম্বা লাইন। দুপুর ১২টার দিকেই সব চাল শেষ হয়ে যায়।
সুনামগঞ্জের বিসম্ভরপুর হাওরের বাসিন্দা নাসিমা বেগম। এবার ফসল উঠলে মেয়ের বিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু আগাম বন্যায় তার সে স্বপ্ন ভেস্তে গেছে। এখন খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা নিয়েই দুশ্চিন্তায় তিনি। তার মতো অনেকেই পড়েছেন বিপাকে। সরকার অতি দরিদ্রদের জন্য ত্রাণ বরাদ্দের ঘোষণা দেয়ায় নাসিমা বেগমের মতো অনেক মধ্যবিত্ত সরকারের ত্রাণ সহায়তা পাবেন না বলে শঙ্কায় আছেন।
সাড়ে ৮ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত : পাহাড়ি ঢলে অকাল বন্যায় দেশের হাওরাঞ্চলের ছয় জেলায় দুই লাখ ১৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আট লাখ ৫০ হাজার ৮৮টি পরিবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওর এলাকা পরিদর্শনে যাওয়ার আগে শুক্রবার হাওর পরিস্থিতি নিয়ে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির বৈঠকে ক্ষয়ক্ষতির হালনাগাদ এ তথ্য তুলে ধরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ওই বৈঠক শেষে কমিটির সদস্য সচিব ও মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মহসীন হালনাগাদ তথ্য সাংবাদিকদের সামনেও তুলে ধরেন।
ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী- সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের দুই হাজার ৮৬০টি বাড়ি সম্পূর্ণ এবং ১৫ হাজার ৩৪৫টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছয় জেলায় ২১৩ দশমিক ৯৫ টন মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে; সুনামগঞ্জে তিন হাজার ৯০২টি হাঁস ও চারটি মহিষ মারা গেছে।