কিশোরগঞ্জ মিঠামইন থেকে:
বিশাল এ হাওরের দক্ষিণে অষ্টগ্রাম, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, পূর্ব দিকে হবিগঞ্জের বানিয়াচং, পশ্চিমে নিকলী, দক্ষিণ-পশ্চিমে কুলিয়ারচর, তারপর ভৈরব। তার মানে তিন জেলা ছুঁয়ে গেছে বিশাল এই বড় হাওর। অকাল ঢলের পানিতে এখন অধিকাংশটাই ডোবা। বাঁধের কাছাকাছি পানির ওপরে মাথা তুলে থাকা ধানগাছগুলো দু’একদিনেই ডুবে যাবে প্রতি মুহূর্তে বাড়তে থাকা পানিতে। হাওরে এবার খাদ্য সঙ্কট শুরু হলো বলে। চিন্তিত রোকেয়া বেগমরা তাই পচা ধানই শুকাতে দিয়েছেন রোদে।
বিশাল হেলিপ্যাডের কোণায় রাখা পচা ধানের গাদা দেখিয়ে রোকেয়া বলেন, এগুলা এখন হাঁস-মুরগিতেও খায় না। কিন্তু আমাদের আর উপায় কি? যেটুকু খাইতে পারি সেটুকুই লাভ।
কালচে বর্ণ নেওয়া ধানের গাদাগুলো ভেজা ভেজা। পচা গন্ধটা নাকে এসে টোকা মারে। রোকেয়া বেগমের ভাষায়, আকাশে তো রোদ নাই। একটু শুকায় ফের ভিজে পচা ধান। দেখে দেখে কলিজাডা ধড়ফড়ায়। কবে জানি ধানের চিন্তায় পরানডাই হারায়া ফেলি!
নব্বই ছুঁইছুঁই বয়সের কুঁজো হয়ে যাওয়া শরীরটা টানতেই হাসফাস দশা চম্পা রাণীর। কিন্তু শরীরের সঙ্গে কাঁচা ধানের গোছাও টানতে হচ্ছে তাকে। ছেলের সঙ্গে নৌকা থেকে অপরিপক্ক ধানের গোছা এনে বাঁধের নিচে খামাল দিচ্ছেন।
একটু দূরে ক্লাস ফোর পড়ুয়া সেতু আর ক্লাস সিক্স পড়ুয়া রনিকে নিয়ে একইভাবে ধানের গোছা টানছেন যমুনা বৈষ্ণব। শাড়ির আঁচলে শরীরের ঘাম মুছে বললেন, আরো কিছু ধান আছে। যদি ডুবাইয়া আনতে পারে।
বাঁধের কাছে জমি হওয়ায় যমুনা আর চম্পারা যদিও কিছুটা ধান তুলতে পেরেছেন, কিন্তু কারো কারো তো সবটাই গেছে। উঁচু বাঁধের ওপর থেকে সব হারানো মানুষগুলো তবু চেয়ে চেয়ে হাওরটাকেই দেখছে। দক্ষিণ থেকে হু হু করে বয়ে আসা বাতাসে ওদের মনের ভেতরে যে হুতাসনের বাষ্প জমছে, তা থেকে মুক্তির পথটাই এখনো খুঁজে পায়নি তারা।
সঞ্জিত চন্দ্র দাস তবু ৩০ বিঘা জমি থেকে মণ চল্লিশেক ধান তুলতে পেরেছেন, কিন্তু সুনীলের ভাগ্যে তাও জোটেনি। পানিতে ডুবে চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু পরিশ্রমটাই বৃথা গেছে। ১৫ বিঘা জমির ধান পুরোটাই হারিয়ে সুনীলের তাই আক্ষেপ, ধান নাই, ধানই নাই। এখন পানি হইলে জমিডা গেলো না তলে।
সত্যিও তো, আর দিন পনেরো/বিশ সময় পেলেই সারা বছরের খোরাকির চিন্তাটা এভাবে মাথা গুলিয়ে দিতে পারতো না ওদের। হাওরের বুক থেকে ঠিকই তুলে আনতে পারতো কাঁড়ি কাঁড়ি ধান। খোরাকি রেখে মহাজনের সুদের টাকাটাও শোধ করে দেওয়া যেতো তাতে।
কিন্তু সে সময় আর কোথায় পেলো নিয়তির কাছে পরাজিত হওয়া ধানজীবীরা! এখন হাত-পা গুটিয়ে স্রেফ বসে থাকা ছাড়া আর উপায় কি! সরকারি সাহায্য ছাড়া জীবন বাঁচানোই দায় হবে এবার।
বিদেশ ফেরত শ্রমিক জিল্লুর রহমান বাঁধের পেছনে পাড়া গুলো দেখিয়ে বলেন, ওই দেখেন, ওই গ্রামগুলা এতোদিনে আড়ালে পড়ে যেতো বড় বড় ধানের গাদার। কিন্তু এখন দেখেন, সব খলা খালি। তারওপর পানিতে ডুবেছে। প্রতিদিন অন্তত আধ হাত করে পানি বাড়ছে এদিকে।
বাঁধের আরো ৫০ মিটার সামনে দিয়ে বাঁধ রাস্তা হচ্ছে নতুন। ওই রাস্তা ইটনা থেকে এই মিঠামইন হয়ে চলে যাবে অষ্টগ্রাম পর্যন্ত। তার মানে হলো, রাস্তাটা হয়ে গেলে দেশের যে কোনো স্থান থেকে সড়ক পথেই যাওয়া যাবে দুর্গম ইটনায়।
কিন্তু উন্নয়নের ওই স্থাপনায় এখন উদ্বেলিত নয় মিঠামইনের মানুষ। তাদের বুকের হাহাকার এখন গিয়ে মেশে নতুন রাস্তার ওপাশের বড় হাওরে। দিগন্ত বিস্তৃত ওই হাওরের সীমানায় আবছা আবছা গ্রাম। উল্টানো গম্বুজের মতো আকাশের নিচে থই থই পানি। শহর রক্ষা বাঁধ ঘেষে কোনোমতে মাথা উঁচু করে থাকা সবুজ মাঠের মতো ধানক্ষেগুলোতে তিরতিরে বাতাসের কাঁপন।
বাঁধের ওপরে দাঁড়িয়ে এখন দিনভার ওসবই দেখে পানির নিচে ধান হারানো মানুষ। ঘুরেফিরে হাওরের ঘোলা জলেই ঘোরে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্বেগে ঝাপসা হয়ে আসা চোখ।
জিল্লুরে ভাষায়, গোটা মিঠামইন শহরের ধানের যোগান তো ওই বড় হাওর থেকেই আসে। এখানকার এক মৌসুমের ধানে গোটা দেশের মানুষের ৩/৪ দিনের খোরাকি হয়ে যাবে।