মার্চের শেষদিককার পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামের ৮৫ শতাংশ ফসলই ডুবে যায়। বাকি ১৫ শতাংশের মধ্যে কলমা ইউনিয়নের ছয়টি বাঁধের ভেতরের প্রায় ছয় হাজার একর জমির ফসল কোনোমতে টিকিয়ে রাখে কৃষকরাই। গত বুধবার ও গতকাল শুক্রবার দুই দিনের প্রবল বৃষ্টিপাত, ঝড়ঝঞ্ঝা ও পাহাড়ি ঢলে বাকি ফসলও তলিয়ে গেছে।
অষ্টগ্রাম হাওরের কৃষকরা জানায়, স্বেচ্ছাশ্রমেই কৃষকরা টানা ২১-২২ দিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে ছয়টি বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করে। সর্বশেষ দুই দিনের দুর্যোগে সবই গেছে। ফসলের সঙ্গে বাঁধ মেরামতে খরচ করা ৯ লাখ টাকাও জলে গেল তাদের।
কাকুরিয়া গ্রামের কৃষক ও কলমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাধাকৃষ্ণ দাস আক্ষেপ করে বলেন, ‘দাদা গো, আমরার জীবন বাঁচাইবার শেষ অবলম্বনটাও ভাইস্যা গেল। ’ তিনি জানান, অকাল বন্যায় তাঁর ইউনিয়নের মোট ছয় হাজার ৪৭৫ একর জমির ধানই নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষকরা ছয়টি বাঁধ বাঁচাতে দোকান থেকে বাকিতে উপকরণ সংগ্রহ করেছিল। এখন এ ঋণের টাকা শোধ করার সাধ্যও নেই তাদের।
গত বুধবার হাওরাঞ্চলে প্রবল বৃষ্টি হয়। গতকাল ভোরে আবার ঝড়বৃষ্টি হয়। সঙ্গে ছিল পাহাড়ি ঢলও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দুই দিনে জেলার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও তাড়াইল হাওরের কমপক্ষে ১০ হাজার একর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, দুই দিনে পাঁচ-ছয় হাজার একর জমি তলিয়েছে।
কৃষি বিভাগের উপপরিচালক শফিকুল ইসলাম জানান, মার্চের শেষ দুই দিন ও এপ্রিলের প্রথম দুই দিনের পাহাড়ি ঢলসহ এ কয় দিনে জেলার হাওরাঞ্চলের এক লাখ ১৯ হাজার ৪৪৩ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে। তবে কৃষক, জনপ্রতিনিধিসহ হাওরবাসীর ভাষ্য, জেলার মোট ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ দেড় লাখ একরের বেশি হবে।
কৃষক ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইটনার মোট ২৮ হাজার ৫৬৬ হেক্টর জমির মধ্যে গতকাল পর্যন্ত তলিয়েছে ১৮ হাজার হেক্টর জমি। দুই দিনের ঝড়-বৃষ্টি-ঢলে কমপক্ষে তিন হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়েছে। তবে বাদলা, রায়টুটী ও এলংজুরি ইউনিয়নের প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমির ধান এখনো অক্ষত রয়েছে। ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মশিউর রহমান খান জানালেন, কৃষকরা ইতিমধ্যে ১০ শতাংশ জমির কাঁচাপাকা ধান কেটে নিতে পেরেছে।
এদিকে মিঠামইনের হাওরে মোট ৬১ শতাংশ জমির ফসল অসময়ের বন্যায় তলিয়েছে বলে জানিয়েছেন মিঠামইনের ইউএনও তাসলিমা আহমেদ পলি। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, সর্বশেষ দুই দিনের বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে নতুন করে তেমন ক্ষতি হয়নি।
গতকাল অষ্টগ্রামের হাওর ঘুরে দেখা গেছে, কলমা ইউনিয়নের হাওরের ছয়টি বাঁধের এখানে সেখানে শত শত কৃষক কাজ করছে। গতকাল ধসে যাওয়া বাঁধগুলো হচ্ছে গাঙিনার বাঁধ, পাতিদিয়ার বাঁধ, বিল মাসা বাঁধ, নাগরখালি বাঁধ ও কলমা বাঁধ। এসব বাঁধের ভেতরের অন্তত ছয় হাজার একর জমির ফসল গতকাল তলিয়ে গেছে।
কৃষকরা জানায়, বাঁধগুলো ধসে যাওয়ার খবর পেয়ে যায় তারা ভোরেই। পরে যার যা আছে তা নিয়ে আবারও বাঁধগুলো রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
আশপাশের কয়েকটি গ্রামের পাঁচ-ছয় শ কৃষক গতকাল দুপুর পর্যন্ত বাঁধ রক্ষায় হাওরে ছিল। কলমার কাকুরিয়ার কৃষক রামচরণ দাস জানান, একপর্যায়ে তিনিও বুঝতে পারেন, আর লাভ হবে না। পরে ব্যর্থ মনোরথে কৃষকরা বাড়ি ফিরে গেছে।
অষ্টগ্রামের ইউএনও আবু তাহের সাঈদ কালের কণ্ঠকে জানান, আগেই উপজেলার দুটি ইউনিয়ন আদমপুর ও খয়েরপুর-আব্দুল্লাপুরের শতভাগ ফসল তলিয়ে যায়। এদিকে কলমা ইউনিয়নের ছয়টি বাঁধ টিকিয়ে রাখায় কিছু আশা ছিল। ফসলও পেকে আসছিল। আশা ছিল ১৫-২০ ভাগ ফসল তোলা সম্ভব হবে। সর্বশেষ ঝড়-বৃষ্টি ও ঢলে সে আশাও শেষ।
ইউএনও আবু তাহের জানান, হাওরের পানি কালো হয়ে পড়ছে। ছোট মাছ মরতে শুরু করেছে। সে মাছ খেয়ে পাখিও মরছে বলে কৃষকরা তাঁকে জানিয়েছে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজিতপুরের হুমাইপুর হাওরের ফসলও সর্বশেষ দুর্যোগে জলমগ্ন হয়ে পড়ছে। পানি ছুঁইছুঁই করছে ধানগাছের ডগায়। দুই দিনে মিঠামইনের কাজীপাড়া ও ইসলামপুরের ছোট দুটি বাঁধ ধসে গেছে।