‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে/কাল-বোশেখির ঝড়’। জাতীয় কবির এ পঙ্ক্তির মতোই বাঙালির প্রাণ নতুন চেতনায় জেগে ওঠার দিন আজ। পহেলা বৈশাখ। শুভ বাংলা নববর্ষ। স্বাগত ১৪২৪। সময়ের চক্রে আবারো ফিরে এলো পহেলা বৈশাখ। নতুন বছরের প্রথম দিন। পেছনের সব গ্লানি মুছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দিন আজ। আর এরই মাধ্যমে কালের আবর্তে হারিয়ে গেল আরো একটি বছর। প্রাণে প্রাণে হিল্লোল জাগাতে, ঐকতান রচনা করতে আর মানুষে মানুষে বিভেদ
ঘুচাতে নববর্ষ সবাইকে স্নাত করে নবচেতনায়। কাকডাকা ভোরে পূর্বদিগন্তে বছরের প্রথম সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় বাঙালি চিত্ত অধীর হয়। নতুনকে বরণ করে নিতে নানা আয়োজন চলে গ্রাম-গ্রামান্তরে, শহরে, নগরে। ‘অনাগত আগামীর অফুরান বাদ্য/নতুনের আবাহনে বুঝি প্রতিপাদ্য/জড়তা ঝরাতে আসে পহেলা বোশেখ/রাজা’র পুণ্যাতে হয় বর্ষ অভিষেক’- কবির এমন পঙ্ক্তির মতোই নতুন বছরকে বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির নানা আয়োজনে রঙে-বর্ণে, উৎসবে দেশজুড়ে বরণ করা হবে আজ। আবহমান এ বাংলার দিক-দিগন্ত ঔজ্জ্বল্যে ভরিয়ে দিয়ে, আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে অগ্নিস্নানে শুচি করে তুলতে আবার এসেছে বৈশাখ। বর্ষবরণের উৎসবের আমেজে মুখরিত হবে বাংলার চারদিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে সকালে বের হবে সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রা। ঐতিহাসিক রমনার বটমূলে হবে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। সারা দিন মুখর থাকবে রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। দেশের প্রত্যেক শহর, গ্রামগঞ্জে বাঙালি মেতে উঠবে প্রাণের আবাহনে। বসবে মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
আজ সরকারি ছুটির দিন। জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ সংখ্যা। রেডিও- টেলিভিশনে প্রচার হচ্ছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। সেই সঙ্গে আছে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নানা আয়োজন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বর্ষবরণ উৎসবটি অনুষ্ঠিত হবে রাজধানীর রমনার বটমূলে। এটি প্রায় ৫০ বছর ধরে আয়োজন করে আসছে দেশের শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। কৃষির সঙ্গে বাংলা নববর্ষের ঘনিষ্ঠতা জড়িয়ে আছে এ সন প্রবর্তনের সূচনা থেকেই। বাংলা সনের প্রচলন করেন মোগল সম্রাট আকবর। এর আগে মোগল বাদশাহরা রাজকাজে ও নথিপত্রে ব্যবহার করতেন হিজরি সন। হিজরি চান্দ্র বছর, যা ন্যূনধিক ৩৫৪ দিনে পূর্ণ হয়। কিন্তু সৌর বছর পূর্ণ হয় ন্যূনধিক ৩৬৫ দিনে। বছরে প্রায় ১১ দিনের পার্থক্য হওয়ায় হিজরি সন আবর্তিত হয় এবং ৩৩ বছরের মাথায় সৌর বছরের তুলনায় এক বছর বৃদ্ধি পায়। কৃষকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতে হলে সারা দেশে একটি অভিন্ন সৌর বছরের প্রয়োজন। আর এ ধারণা থেকেই সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালের ১০ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তা কার্যকর হয় তার সিংহাসন আরোহণের সময় অর্থাৎ ১৫৫৬ সালের ৫ই নভেম্বর থেকে। আকবরের নবরত্ন সভার আমির ফতেউল্লাহ খান সিরাজী বাংলা সন প্রবর্তনের কাজটি সম্পন্ন করেন। প্রথমে এর নাম ছিল ফসলী সন। পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। বৈশাখ নামটি নেয়া হয়েছিল নক্ষত্র বিশাখার নাম থেকে। আর সেই থেকে ক্রমান্বয়ে নববর্ষের ব্যাপ্তি আরো বিস্তৃত হয়েছে। খাজনা পরিশোধ, হালখাতা ও মিষ্টান্নের মাধ্যমে আপ্যায়নের সামাজিক পর্বটি রূপান্তর হয়েছে বাঙালি লোকজ উৎসবে। কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরনো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে, সংযোগ ঘটেছে অনেক নতুন উৎসবেরও। এর সঙ্গে হালখাতা জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য হয়ে। তবে পুরনো এ হালখাতার ঐতিহ্য এখন খুব কমই দেখা যায়। যদিও অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়। তবে তা কম। হালখাতার ঐতিহ্যকে ছাড়িয়ে পহেলা বৈশাখে নগর সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছিল পান্তাভাত ও ইলিশ। যদিও ফসলী সন বা বঙ্গাব্দের ইতিহাসের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এ ইলিশ ভোজনের। পহেলা বৈশাখের খাবার তালিকায় ইলিশ মাছ না রাখার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে এবার অনেকেই পহেলা বৈশাখের আয়োজনে রাখছেন না ইলিশ।
দিনটিকে নির্বিঘ্নে উদযাপন করতে রাজধানীজুড়ে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রমনা উদ্যানসহ বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। বৈশাখের নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়ে ১১ই এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিঞা জানিয়েছেন, পহেলা বৈশাখে রাজধানীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১১ হাজার পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। ইউনিফর্ম ছাড়াও পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সতর্ক নজর রাখবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, হাতিরঝিল ও রবীন্দ্র সরোবরে কয়েকস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা ও ক্যাম্পাস এলাকায় বহিরাগত কেউ ঢুকতে পারবে না। রমনা বটমূল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় সবাইকে দেহ তল্লাশির মধ্য দিয়ে ঢুকতে হবে। সব অনুষ্ঠান ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় নজরদারি করা হবে। ভুভুজেলা বিপণন ও বাজানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
রমনা বটমূলে মূলমঞ্চ তৈরির কাজ শেষ হয়েছে গতকালই। সম্পন্ন হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার সব প্রস্তুতি। নববর্ষের শুভেচ্ছাসংবলিত পোস্টার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে রাজধানী। বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়ের মুখে স্থাপন করা হয়েছে বৈশাখের তোরণ। রমনার বটতলায় তৈরি করা হয়েছে পহেলা বৈশাখের মূলমঞ্চ। ছায়ানটের শিল্পীদের সম্মিলিত পরিবেশনা থাকবে এখানে। মূলমঞ্চ ছাড়াও বেশ কয়েকটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। নববর্ষকে ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে সাজানো হয়েছে নবরূপে। এখানে উন্মুক্ত অনুষ্ঠান পরিবেশনা ছাড়াও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বর, হাকিম চত্বর, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ও চলবে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। ক্যাম্পাসের প্রবেশপথসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো রাস্তায় আঁকা হয়েছে বৈশাখের আল্পনা। সকাল থেকে শুরু হয়ে সারা দিনই চলবে নানা অনুষ্ঠান। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করবে বাংলা একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমি। নববর্ষ উদযাপনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজন করছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও জাতীয় প্রেস ক্লাব। একইভাবে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন সকালে বেলুন উড়িয়ে নববর্ষ উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করবে। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, বিরোধী দল নেতা রওশন এরশাদ দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বাংলা নববর্ষে তারা প্রত্যেকেই দেশবাসীর কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। পহেলা বৈশাখে গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে জনগণের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে এবার বৈশাখী র্যালি বাতিল করেছে আওয়ামী লীগ। তবে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে রাজধানীর নয়াপল্টনে শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে জাতীয়তাবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা জাসাস। এ আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
সংবাদ শিরোনাম
নতুন বছরে নতুন আশা
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ১২:৫৯:২৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ এপ্রিল ২০১৭
- ৩৫২ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ