ঢাকা ০৪:০২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লাখাইর মৌবাড়ি মাঠ এখন মৌ চাষের খামার

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৩৪:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৭
  • ৩৭৮ বার

হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার মৌবাড়ি মাঠে ৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সরিষা আর সরিষা। হলুদে ছেয়ে আছে পুরো এলাকা। ফুলে ফুলে তার মৌমাছির বিচরণ। মৌবাড়ি মাঠকে ঘিরে চলছে মৌ চাষের মহাআয়োজন।

মৌবাড়ি মাঠে প্রায় ৫০০ কৃষক বিষমুক্ত সরিষার আবাদ করেছেন। গাছে গাছে সরিষার ফুল। ফুলে ফুলে মৌমাছি। মৌমাছির বিচরণে মাঠে প্রবেশ করতে পারছে না বিষাক্ত পোকা মাকড়। যার ফলে সরিষায় কেমিক্যাল ব্যবহার করতে হয়নি।

মাঠের স্থানে স্থানে স্থাপন করা হয়েছে বাক্স। এসব বাক্সে মৌমাছিদের বাসা। প্রতি সপ্তাহে বাক্সের বাসায় জমানো মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে। এভাবে চলবে অন্তত দেড় মাস।

এ জেলারই নবীগঞ্জ উপজেলার পাঞ্চারাই গ্রামের বাসিন্দা হাফেজ নিয়ামুল হক কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে এই প্রথম সরিষার ফুলের উপর নির্ভর করে মৌবাড়ি মাঠে বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষ শুরু করেন। যদিও গত বছর এ মাঠে স্বল্প পরিসরে মধু চাষ শুরু করেছিলেন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার জঙ্গল বহুলার বাসিন্দা সুরত আলী। সে সময় আর্থিক অভাবে তিনি পুরোপুরি সফল হতে পারেননি।

এবার এখানে মধু চাষের লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার কেজির। এ লক্ষ্য অর্জনে সফলতার মুখ দেখেছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘ফাতেমা মৌ খামার’। এখানের উৎপাদিত প্রতি কেজি মধু পাইকারের কাছে ৬০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। মোফাচ্ছির মিয়া ও মঈনুল ইসলাম রুমনসহ কয়েক শ্রমিক সার্বক্ষণিক এ মধু চাষে শ্রম দিচ্ছেন। এতে সার্বিকভাবে তত্বাবধান করছেন ছুরত আলী।

মৌ বাক্সে মধু জমানোর প্রক্রিয়া দেখাচ্ছেন চাষি

সূত্র জানায়, হবিগঞ্জে বাড়ি বাড়ি মধু চাষে আগ্রহ বাড়াতে ছুরত আলী দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। তিনি মধু চাষের ওপর নিয়েছেন একাধিক প্রশিক্ষণ।

আলাপকালে সুরত আলী জানান, কাঁঠাল কাঠ দিয়ে বাক্স তৈরি করার পর মৌমাছি সংগ্রহ করে মধু চাষ শুরু করতে হয়। এরপর মৌমাছিরা ফুলে ৫০০ হতে কমপক্ষে ৩০০ বার স্পর্শ করে মধু সংগ্রহ করে। মৌমাছিরা এ মধু চাকে জমা রেখে আবার আহরণে যায়।

তিনি জানান, কয়েকবছর পূর্বে সৌখিনভাবে মৌমাছি চাক সংগ্রহ করে নিজের খাবারের জন্য চাষ শুরু করেন। সফলতা পাওয়ার পরে তিনি বাণিজ্যিকভাবে চিন্তা করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন হবিগঞ্জ বিসিক শিল্প নগরী থেকে। এ সময় থেকে তিনি মধু চাষে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন। তিনি এখন পেশাগতভাবেই মধুচাষি। তার চিন্তা, কীভাবে এ চাষের পরিধি আরো বাড়ানো যায়। এ চিন্তায় তিনি তার বাড়ির আশপাশের বেকার লোকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে মধু চাষে আকৃষ্ট করছেন। অনেকেই তার পরামর্শ নিয়ে নিজ বাড়িতে বাক্স তৈরি করে মধু চাষ শুরু করেছেন। তারাও সফলতা পাচ্ছেন।

বর্তমানে শহরের শায়েস্তাগঞ্জ, মনপুর, তেঘরিয়া, অনন্তপুরসহ জেলার শতাধিক বাড়িতে মধু চাষ হচ্ছে বলেও জানান তিনি। বাড়িতে মধু চাষ হলে ঝুঁকি কম। কারণ, সব সময় শ্রম দেওয়া যায়।

মধু চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে ছুরত আলী বলেন, ‘মৌমাছিরা সরিষা, লিচু, কমলা, আম, বড়ই, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফল গাছের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে চাকে এনে জমা করে। এতে করে একদিকে যেমন মধু পাওয়া যায়। তার পাশাপাশি ফলের চাষ বৃদ্ধি পায়। তাই মৌ চাষ দুদিকেই লাভজনক।’

মৌচাষির সঙ্গে কথা বলছেন প্রতিবেদক

শতপ্রতিকূলতার মধ্যেও মধু চাষ অব্যাহত রেখেছেন সুরত আলী। তার মতে, পুরো বছরই পাহাড়ি এলাকায় মৌচাষ করা যায়। কারণ সেখানে ফলের চাষ ভাল। এ ছাড়া মৌসুম অনুযায়ী হাওর এলাকায় সরিষার মাঠ থেকেও প্রচুর মধু সংগ্রহ করা সম্ভব।

মৌবাড়ি মাঠ পরিদর্শনকালে জানা গেছে, কৃষকরা নিজেদের জমিতে সরিষার চাষ করে ভাল ফলন দেখছেন। যে জমিতে পূর্বে এক ফসল হতো। সেখানে একাধিক ফসল ফলাতে পারছেন কৃষকরা। এরমধ্যে অন্যান্য ফসলের ন্যায় এ মৌসুমে সরিষা চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন কৃষকরা।

স্থানীয় উপকারভোগি কামাল মিয়া, মোস্তফা আলী, শের আলী, সাফি মিয়া, সুরুক আলী, আব্দুল কদ্দুছ, তিতু মিয়া জানান, ‘গভীর নলকূপের মাধ্যমে এই এলাকায় পানি সেচ করা হলে আরো প্রচুর জমি চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব। কৃষিক্ষেত্রে আমরা আরো এগিয়ে যেতে পারব।

পরিবেশপ্রেমিক ডা. বাহার উদ্দিন বলেন, ‘মৌবাড়িতে যুগ যুগ ধরে সরিষাসহ নানা ফসল চাষ হয়ে আসছিল। এক সময় এসে বিষাক্ত পোকা মাকড়ের আক্রমণ শুরু হয়। গত বছর কিছু পরিমাণে মধু চাষ হয়েছে। এবার তার চেয়ে বড় আকারে মধু চাষ করায় সরিষার গাছে গাছে মৌমাছি বিচরণ হচ্ছে। এতে করে বিষাক্ত পোকা মাকড়ের আক্রমণ কমে গেছে।’

হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ ফজলুর রহমান বলেন, ‘মৌবাড়িতে এবার সরিষার বাম্পার ফলন হয়েছে। সরিষার ফলন ব্যবহার করে মধু চাষ হচ্ছে। বিষয়টি শুভ খবর। মৌমাছি থাকায় এবার সরিষায় কেমিক্যাল ব্যবহার করতে হয়নি।’

রাইজিংবিডি

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

লাখাইর মৌবাড়ি মাঠ এখন মৌ চাষের খামার

আপডেট টাইম : ১১:৩৪:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৭

হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার মৌবাড়ি মাঠে ৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সরিষা আর সরিষা। হলুদে ছেয়ে আছে পুরো এলাকা। ফুলে ফুলে তার মৌমাছির বিচরণ। মৌবাড়ি মাঠকে ঘিরে চলছে মৌ চাষের মহাআয়োজন।

মৌবাড়ি মাঠে প্রায় ৫০০ কৃষক বিষমুক্ত সরিষার আবাদ করেছেন। গাছে গাছে সরিষার ফুল। ফুলে ফুলে মৌমাছি। মৌমাছির বিচরণে মাঠে প্রবেশ করতে পারছে না বিষাক্ত পোকা মাকড়। যার ফলে সরিষায় কেমিক্যাল ব্যবহার করতে হয়নি।

মাঠের স্থানে স্থানে স্থাপন করা হয়েছে বাক্স। এসব বাক্সে মৌমাছিদের বাসা। প্রতি সপ্তাহে বাক্সের বাসায় জমানো মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে। এভাবে চলবে অন্তত দেড় মাস।

এ জেলারই নবীগঞ্জ উপজেলার পাঞ্চারাই গ্রামের বাসিন্দা হাফেজ নিয়ামুল হক কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে এই প্রথম সরিষার ফুলের উপর নির্ভর করে মৌবাড়ি মাঠে বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষ শুরু করেন। যদিও গত বছর এ মাঠে স্বল্প পরিসরে মধু চাষ শুরু করেছিলেন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার জঙ্গল বহুলার বাসিন্দা সুরত আলী। সে সময় আর্থিক অভাবে তিনি পুরোপুরি সফল হতে পারেননি।

এবার এখানে মধু চাষের লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার কেজির। এ লক্ষ্য অর্জনে সফলতার মুখ দেখেছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘ফাতেমা মৌ খামার’। এখানের উৎপাদিত প্রতি কেজি মধু পাইকারের কাছে ৬০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। মোফাচ্ছির মিয়া ও মঈনুল ইসলাম রুমনসহ কয়েক শ্রমিক সার্বক্ষণিক এ মধু চাষে শ্রম দিচ্ছেন। এতে সার্বিকভাবে তত্বাবধান করছেন ছুরত আলী।

মৌ বাক্সে মধু জমানোর প্রক্রিয়া দেখাচ্ছেন চাষি

সূত্র জানায়, হবিগঞ্জে বাড়ি বাড়ি মধু চাষে আগ্রহ বাড়াতে ছুরত আলী দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। তিনি মধু চাষের ওপর নিয়েছেন একাধিক প্রশিক্ষণ।

আলাপকালে সুরত আলী জানান, কাঁঠাল কাঠ দিয়ে বাক্স তৈরি করার পর মৌমাছি সংগ্রহ করে মধু চাষ শুরু করতে হয়। এরপর মৌমাছিরা ফুলে ৫০০ হতে কমপক্ষে ৩০০ বার স্পর্শ করে মধু সংগ্রহ করে। মৌমাছিরা এ মধু চাকে জমা রেখে আবার আহরণে যায়।

তিনি জানান, কয়েকবছর পূর্বে সৌখিনভাবে মৌমাছি চাক সংগ্রহ করে নিজের খাবারের জন্য চাষ শুরু করেন। সফলতা পাওয়ার পরে তিনি বাণিজ্যিকভাবে চিন্তা করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন হবিগঞ্জ বিসিক শিল্প নগরী থেকে। এ সময় থেকে তিনি মধু চাষে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন। তিনি এখন পেশাগতভাবেই মধুচাষি। তার চিন্তা, কীভাবে এ চাষের পরিধি আরো বাড়ানো যায়। এ চিন্তায় তিনি তার বাড়ির আশপাশের বেকার লোকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে মধু চাষে আকৃষ্ট করছেন। অনেকেই তার পরামর্শ নিয়ে নিজ বাড়িতে বাক্স তৈরি করে মধু চাষ শুরু করেছেন। তারাও সফলতা পাচ্ছেন।

বর্তমানে শহরের শায়েস্তাগঞ্জ, মনপুর, তেঘরিয়া, অনন্তপুরসহ জেলার শতাধিক বাড়িতে মধু চাষ হচ্ছে বলেও জানান তিনি। বাড়িতে মধু চাষ হলে ঝুঁকি কম। কারণ, সব সময় শ্রম দেওয়া যায়।

মধু চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে ছুরত আলী বলেন, ‘মৌমাছিরা সরিষা, লিচু, কমলা, আম, বড়ই, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফল গাছের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে চাকে এনে জমা করে। এতে করে একদিকে যেমন মধু পাওয়া যায়। তার পাশাপাশি ফলের চাষ বৃদ্ধি পায়। তাই মৌ চাষ দুদিকেই লাভজনক।’

মৌচাষির সঙ্গে কথা বলছেন প্রতিবেদক

শতপ্রতিকূলতার মধ্যেও মধু চাষ অব্যাহত রেখেছেন সুরত আলী। তার মতে, পুরো বছরই পাহাড়ি এলাকায় মৌচাষ করা যায়। কারণ সেখানে ফলের চাষ ভাল। এ ছাড়া মৌসুম অনুযায়ী হাওর এলাকায় সরিষার মাঠ থেকেও প্রচুর মধু সংগ্রহ করা সম্ভব।

মৌবাড়ি মাঠ পরিদর্শনকালে জানা গেছে, কৃষকরা নিজেদের জমিতে সরিষার চাষ করে ভাল ফলন দেখছেন। যে জমিতে পূর্বে এক ফসল হতো। সেখানে একাধিক ফসল ফলাতে পারছেন কৃষকরা। এরমধ্যে অন্যান্য ফসলের ন্যায় এ মৌসুমে সরিষা চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন কৃষকরা।

স্থানীয় উপকারভোগি কামাল মিয়া, মোস্তফা আলী, শের আলী, সাফি মিয়া, সুরুক আলী, আব্দুল কদ্দুছ, তিতু মিয়া জানান, ‘গভীর নলকূপের মাধ্যমে এই এলাকায় পানি সেচ করা হলে আরো প্রচুর জমি চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব। কৃষিক্ষেত্রে আমরা আরো এগিয়ে যেতে পারব।

পরিবেশপ্রেমিক ডা. বাহার উদ্দিন বলেন, ‘মৌবাড়িতে যুগ যুগ ধরে সরিষাসহ নানা ফসল চাষ হয়ে আসছিল। এক সময় এসে বিষাক্ত পোকা মাকড়ের আক্রমণ শুরু হয়। গত বছর কিছু পরিমাণে মধু চাষ হয়েছে। এবার তার চেয়ে বড় আকারে মধু চাষ করায় সরিষার গাছে গাছে মৌমাছি বিচরণ হচ্ছে। এতে করে বিষাক্ত পোকা মাকড়ের আক্রমণ কমে গেছে।’

হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ ফজলুর রহমান বলেন, ‘মৌবাড়িতে এবার সরিষার বাম্পার ফলন হয়েছে। সরিষার ফলন ব্যবহার করে মধু চাষ হচ্ছে। বিষয়টি শুভ খবর। মৌমাছি থাকায় এবার সরিষায় কেমিক্যাল ব্যবহার করতে হয়নি।’

রাইজিংবিডি